আত্মোপলব্ধি

২০১৪ সালের গ্রীষ্মে নিউইয়র্কে গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হলাম। চালকের আসনে আমার এক ছোট ভাই। গাড়িটি কুইন্সের এক চৌরাস্তায় সবুজ লাইটের অপেক্ষায় দাঁড়ানো। হঠাৎ কানে আসল ব্রেক কষার তীব্র ও ভয়ার্ত আওয়াজ। বলতে যাব,আহারে না জানি কার জন্য রইল আজকের এই অভিশপ্ত দিন। বলতে না বলতে আমাদের গাড়ির পেছনে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা। একেবারে আচমকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আসনের ওপরের ‘হেড রেস্ট’ নামের বাড়তি অংশের জোর আঘাত পেলাম ঘাড়ে আর ডান কাঁধে। ১০ সেকেন্ড সময় কিছু বুঝি নাই। পরক্ষণেই মনে হলো, ঘাড় আরা কাঁধে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। প্রায় অচেতন হয়ে সোজা হয়ে বসে আছি। কারও কাছে শুনেছিলাম, ঘাড়ে বা মাথায় কোন ভারী আঘাত পেলে নড়াচড়া না করাই শ্রেয়।
মিনিট পাঁচেকের মাথায় পুলিশ এল, সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ও প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা। খুবই সাবধানতার সঙ্গে আস্তে আস্তে গাড়ির আসন থেকে নামিয়ে আমাদের স্ট্রেচারে তোলা হল। অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে আছি প্রায় অচেতন হয়ে। পরে হাসপাতালে রাত্রিযাপনের পাশাপাশি নানা টেস্ট শেষে ভোর রাতে বাসায় ফিরলাম। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের পরামর্শে যেতে হলো নিউইয়র্কের সেরা শৈল্যবিদ রাসেলের চেম্বারে। তিনি পরে আমার ডান কাঁধে সফল অস্ত্রোপচার করেছিলেন। এর ফলে আমার কাঁধ এবং ডান হাতের উপরিভাগের ব্যথা সম্পূর্ণ সেরে যায়। ডাক্তার রাসেলের চেম্বার ছিল রিচমন্ড হিলের ইহুদি অধ্যুষিত এলাকায়। ছোট ভাই মাসুদুলসহ গেলাম ডাক্তারের বেশ বড়সড় ছিমছাম পরিপাটি দোতলা চেম্বারে। সুন্দর শান্ত পরিবেশ। আরামদায়ক দুই সেট সোফার সঙ্গে রাখা সাইড টেবিলে প্রচুর সাময়িকীসহ দিনের তাজা সংবাদপত্র। রোগীর সংখ্যা একেবারে কম নয়। অভ্যর্থনা কক্ষে রিপোর্ট করে জানা গেল, আমাদের বেশ কিছুক্ষণ বসতে হবে। উপস্থিত সব রোগী চুপচাপ বসে নিরিবিলি নানা সাময়িকী পড়ে বা উল্টেপাল্টে সময় কাটাচ্ছেন।
ঠিক তখনই হঠাৎ নাকে এসে লাগল সিগারেটের তীব্র বিদঘুটে গন্ধ। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী খুবই কড়া ও বিজাতীয় মিশেলের সিগারেট টেনে রুমে এসে ঢুকল। মুহূর্তে মনে হল, পুরো কক্ষটি স্বর্গ থেকে নরকে পরিণত হল। শান্ত সরোবর রূপে আর মুগ্ধ করা মনোরম সুগন্ধি যুক্ত কক্ষটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডে পরিণত হলো ‘হাবিয়া দোজখে’। সিগারেটের পোড়া উৎকট গন্ধে কক্ষে বসা অপেক্ষমাণ রোগীরা এক এক করে বাইরের মুক্ত বাতাসে চলে এলেন। সঙ্গে আমরা দুজনও।
ছোট ভাই মাসুদুল জিজ্ঞেস করল, রূপু ভাই, ওরা কী জাতের সিগারেট টেনে আসল। এত উৎকট আর দুর্গন্ধ তো জীবনে আমার নাকে আসেনি। আপনি তো ধূমপান করতেন, তারপরও আপনি সহ্য করতে না পেরে বাইরে চলে এলেন। ততক্ষণে আমি পড়ে গেলাম বিরাট ভাবনায়। ২০১৪ সালে আমার বয়স ৫৬ বছর। অনিয়মিত ধূমপান শুরু করেছি ১৬ বছর বয়স থেকে। তার মানে গত ৪০টি বছর বিরামহীন এই দুষ্কর্মটি করেই গেলাম। মজার বিষয়, ৪০ বছরের মধ্য আনুমানিক ৩০ বছর দামি নানা ব্র্যান্ডের ধূমপান করেছি বিনা পয়সায়, তাও আবার বাবার মালিকানাধীন সিগারেট এজেন্সি ‘সুরমা এজেন্সি’ থেকে। মনে পড়ে ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে প্রথম বর্ষে পড়াকালে ফেবারিট ব্রান্ড ছিল ট্রিপল ফাইভ। দাম ছিল ৯ টাকা থেকে ১১ টাকা। খুব কম লোকের তখন ট্রিপল ফাইভ কেনার সামর্থ্য ছিল। সে সময় হোস্টেলে খাওয়া-দাওয়ায় মাসিক খরচ ছিল ১৬ টাকা মাত্র। এরপর ছিল ক্যাপস্ট্যান নামের নীল সাদা ডিজাইনের আরও একটি অভিজাত ব্রান্ড।
যাই হোক, এখন মূল বিষয়ে আসা দরকার। সে সময়ে আমি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি, কম বেশি ১৫/১৬ মাস আগে। ডাক্তারের কাছে গেলাম গলায় সংক্রমণের ব্যথা নিয়ে। টর্চের লাইট ফেলে ডাক্তার যখন আমার গলা দেখছেন হঠাৎ খেয়াল করলাম, ডাক্তারের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। বেশ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, ভাই সাহেব আপনার গলার সমস্যা অনেক দূর চলে গেছে। কয়েকটি জরুরি টেস্ট করতে হবে তা হলেই বুঝব ঘটনা কী? এই কথা শোনামাত্র আমার সারা শরীর বেয়ে বয়ে গেল ভয়ের ঠান্ডা স্রোত। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই বললেন, আপনার এই সমস্যা ধূমপানের জন্য হয়েছে। এখনো যদি ধূমপান করেন, তাহলে তা চালাতে পারেন, আবার আরও কয়টা দিন বাঁচতে চাইলে ছাড়তেও পারেন। শোনামাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম, আজই ধূমপান ছেড়ে দেব। সঙ্গে সঙ্গে চেম্বারের বাইরে এসে সদ্য কেনা বেনসন অ্যান্ড হেজেজ ব্রান্ডের প্যাকেট নিমেষে পায়ের নিচে ফেলে কয়েক দফা পিষতে পিষতে মনে মনে বললাম, আমাকে আরও কয়টি দিন বাঁচতে হবে। আর কয়টি বছর। কিছু না হলেও দুটো মেয়ের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। সেই যে ধূমপানকে ‘বাই’ বলেছি, আজ প্রায় ছয় বছর হলো আর কখনো সিগারেটের সঙ্গে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, আশা করি আর হবেও না। তবে কখনো কখনো মনে আসে, ধূমপান করে কত আপনজন আত্মীয়স্বজনকে বিব্রত করেছি, অসুবিধায় ফেলেছি। বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে অনেক আপনজনের পরিবার নয়তো ছোট ছোট শিশুসহ গাড়িতে চড়েছি। বাইরে তাড়াহুড়া করে ধূমপান করে গাড়ির ভেতর বসে পুরো পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক (শিশুদের জন্য) করেছি। কেউ হয় বিবেকের তাড়নায় বা সম্মান দেখাতে গিয়ে বা লজ্জায় কিছু বলেননি। আর আমার অন্যায় কাজের শিকার হয়েছে কচি কচি কোমলমতি শিশুরা। যারা সবাই আমার আপনজন।
অবিবেচক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীদের মতো কারও বাসার বসার ঘর কোন ক্ষেত্রে শোয়ার ঘরকেও করেছি কলুষিত এবং মরণব্যাধি ক্যানসারের সূতিকাগার। আপন ভেবে স্বজন ভেবে দেশ-বিদেশের কত স্বজন নীরবে সহ্য করেছে আমাদের এই অবিবেচক আচরণ। আজ তাদের কথা মনে হলে নিজে নিজে লজ্জিত হই, শরমিন্দা হই। আর মনেপ্রাণে বছরের পর বছর এই কলুষিত কাজটি স্বজ্ঞানে করার জন্য সবার উদ্দেশ্যে বলছি, জেনেশুনে বড় অন্যায় কাজ করেছি। তাই বলে ছোট বড় সবার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। আমার এই দীর্ঘদিনের অপকর্মের জন্য দয়া করে আমায় ক্ষমা করে দিয়েন।