অন্তহীন বিষণ্নতা

২০০৭ সাল। ম্যানহাটনের ৭৮৭ ভবনের এক নিউজ স্ট্যান্ডে কাজ করি। ঘরের সঙ্গেই বাস স্ট্যান্ড বলে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা বাসেই করি। ভোর ৬টা ৪৫ মিনিটের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। প্রতিদিন একই রুটিন। অফিস যাতায়াতের পথে বাস স্ট্যান্ডে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। কিছুদিন ধরে আমি ও একজন স্প্যানিশ বৃদ্ধা—আমরা দুজন একই বাসের যাত্রী। দীর্ঘদিন একই বাসে আসা-যাওয়ার পথে পরিচয় এবং দুজনের মধ্যে হাই হ্যালো হয়। আমি যাওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা সব সময় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমি যাওয়ার পর সরে দাঁড়িয়ে তাঁর পেছনে দাঁড়ানোর জন্য ইশারা করতেন। আমিও তাঁর কথা মতো পেছনে দাঁড়িয়ে যেতাম। প্রথম পরিচয়ের দিন তিনি আমাকে দেখে স্প্যানিশ ভাষায় অনুরোধ করে বললেন, ‘তুমি কি কিউ ৩২ বাসের জন্য অপেক্ষা করছ? আমি অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু বাস আসছে না। বাস আসলে তুমি কি আমার ব্যাগগুলো একটু বাসে উঠিয়ে দেবে?’
স্প্যানিশ ভাষা পুরোপুরি বুঝিনা। তবু আমি অনুমান আর তাঁর ইশারায় বুঝে নিচ্ছিলাম উনি কি বলছেন; তবুও তাঁকে জানাই যে আমি স্প্যানিশ জানি না। তিনি বললেন, কিন্তু তোমাকে দেখে আমার কাছে স্প্যানিশই মনে হচ্ছে। আমি কথা বাড়াই না। বাস আসলে রাস্তার ওপরে রাখা ব্যাগ দুটো বাসে উঠিয়ে দিই। তিনি বাসের আসনে বসার পর আমি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই একই সময়ে ওই বৃদ্ধার সঙ্গে বাস স্ট্যান্ডে আমার দেখা হয়। তিনি একই জায়গা রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন আমার জন্য। আমি এলে তাঁকে বসিয়ে দিই। কখনো আমি তাঁর পাশে বসে, কখনো দাঁড়িয়ে দুজনে নীরবে কিংবা টুকটাক কিছু গল্প করতে করতে যার যার গন্তব্যে পৌঁছাই। এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিন।
মাঝেমাঝে ওই বৃদ্ধা বলেন, তোমার সময় হলে তোমার কোনো ছুটির দিন বসে গল্প করব; যাবে? একদিন সুযোগ পেলেই তাঁকে বললাম, চল সিটিতে কোন পার্কে গিয়ে গল্প করি। তিনি প্রস্তাব করলেন, সেন্ট্রাল পার্ক যাবে? রাজি হয়ে গেলাম এক বাক্যে। যে কথা সেই কাজ; দুজনে মিলে বাসে চেপে ব্রায়ান্ট পার্কে চলে যাই এবং সেখানে বসে গল্প চলে দুজনের। কখনো তাঁর ছেলেবেলার গল্প তো কখনো তরুণী বয়সের গল্প। তাঁর শৈশব কাটে ইউরোপের কোন এক ছোট্ট শহরে। মা ইউরোপীয়, বাবা পুয়ের্তোরিকান। মা একসময় তাঁকে বাবার কাছে রেখে চলে যান অন্য পুরুষের সঙ্গে। বাবা পরে এক স্প্যানিশ-আমেরিকান নারীকে বিয়ে করে মেয়ে নিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন। এরপর এই নিউইয়র্ক শহরেই থেকে যাওয়া। স্কুল শেষ করে কলেজে গিয়েই ১৯ বছর বয়সে প্রথম প্রেমিকের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস শুরু করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি এক কন্যা সন্তানের মা হন। ছেলে বন্ধুটি তাঁর চেয়ে ২/৪ বছরের বড় ছিলেন। একসময় দুজন বিয়ে করেন। স্বামী অ্যালকোহলিক, মাদকাসক্ত। অত্যাচারী স্বামীর সঙ্গে প্রায় সে ২১ বছর কাটিয়ে দেন তিনি। এরপর একদিন তাঁর স্বামী মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। সেদিন তিনি বাধ্য হয়ে পুলিশের হাতে স্বামীকে তুলে দিয়ে মেয়ে নিয়ে চলে যান তাঁর বাবা আর সৎ মায়ের কাছে।
বাবার বাসায় যাওয়ার পর বৃদ্ধার সৎ মা তাঁকে বলেন, তুমি নার্সিংয়ে অ্যাসোসিয়েট কোর্স করে একটা চাকরি শুরু করে দাও। আর তুমি চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার মেয়ে আমাদের সঙ্গেই থাকুক। মেয়েকে নানা আর সৎ নানির কাছে নিরাপদে রেখে নিউইয়র্কে ফিরে মামলা লড়ে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ফ্লাশিংয়ের এক প্রতিষ্ঠান হতে নার্সিংয়ের কোর্স শুরু করেন। দুই বছরের অ্যাসোসিয়েট কোর্স শেষ করে ৪২ বছর বয়সে নার্সিংয়ের কাজ নেন মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে। এরপর জীবনের বাকিটা সময় কাটিয়ে দেন একই হাসপাতালে রোগীদের সেবা করে। বিয়ে-থা আর করেননি। মাঝখানে বাবা-মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে এনে পড়ালেখা করান। মেয়ে কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে ফেরে লাশ হয়ে। কুইন্স বুলেভার্ডে রাস্তা পার হওয়ার সময় এক মাতাল চালকের গাড়ির নিচে পড়ে মারা যায় সে।
কিছুদিন কাজ থেমে থাকলেও জীবন থেমে থাকেনি। হাসপাতাল আর ঘর—এই দুই-ই ছিল তাঁর জীবন। এরপর একে একে বাবা ও সৎ মাকেও হারান। বার্ধক্যজনিত কারণে বাবা মারা যাওয়ার সময় যে বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়িটি মেয়ের নামে দিয়ে যান। মেয়ে সে বাড়ি বিক্রি করে এলমহার্স্টে একটি বাড়ি কিনে নেন। সেই বাড়ি থেকেই প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন।
আহারে জীবন! আমি মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকি। হঠাৎ ভদ্রমহিলা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘বেঁচে থাকলে আমার মেয়েটা তোমার বয়সী হতো। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিন আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমার মেয়ে থাকলে হয়তো আজ তোমার মতোই আমাকে সাহায্য করত, হয়তো আমি আর মেয়ে এক সঙ্গে কাজে আসা-যাওয়া করতাম, দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম, বিকেলে মা-মেয়ে ডগ ওয়াক করাতে নিয়ে যেতাম।
আমি নিঃসঙ্গ এই মানুষটার দিকে বিষণ্ন মনে চেয়ে থাকি। বন্ধুর পথে হেঁটে চলেছে তাঁর জীবন; এক সমুদ্র তেষ্টা নিয়ে, বুকের ভেতর ভীষণ ব্যাকুলতা নিয়ে। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই চোখের পানি লুকোতে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেন বৃদ্ধা। আমার চোখের ভেতরও জ্বালা করে ওঠে, টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়লে ভাবি, একটু বৃষ্টি পড়ুক, কারও দৃষ্টি পুড়ুক—বৃদ্ধা এই মায়ের অকাল শোকে অঝোরে কান্না ঝরুক।