খুব জানতে ইচ্ছে করে...

-আপনি কি সিলেটের হীরাকে চেনেন?
-কত হীরা আছে, কোন হীরার কথা বলছেন?
-ও ঢাকায় থাকত।
-ওহ্‌, তাঁদের স্থায়ী বাড়িটা সিলেটের কোথায়?
-তাতো ঠিক জানি না, তবে ওরা ছোটবেলা থেকেই ঢাকার নিউ ইস্কাটনে থাকত। ওরা দুই ভাই যমজ, হীরা আর মানিক।
-ওরা আপনার কী হয় ?
-কিছু না, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতাম ।
-ওহ্‌!
-এক সঙ্গে পড়তাম।
-আচ্ছা!
-অনেক ছোটবেলা থেকে সাত বছরের অ্যাফেয়ার ছিল।
-তো আলাদা হলেন কেন?
-হঠাৎ করে ফ্লোরিডা চলে গেল।
-ওহ্‌, তো এখন কী চান?
-কিছু চাই না। এমনি মন চায় জানতে, যাকে জীবনে প্রথম ভালোবাসলাম সে কেমন আছে? কোথায় আছে?
-আপনার তো এখন একটা সুখের সংসার আছে, কী হবে খুঁজে।
-হ্যাঁ তা ঠিক।
-কোন যোগাযোগ নেই?
-না।
-ফেসবুকে খুঁজে দেখুন।
-খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি কখনো।
-আর কোন নাম?
-হ্যাঁ ওর আসল নামেও খুঁজেছি।
-ওহ্‌ স্যাড।
-এখন আমি কী করতে পারি?
-না ভাবলাম আপনার বাড়ি সিলেটে। আবার আমেরিকায় থাকেন। হয়তো চিনতেনও পারেন, তাই।
-ও আচ্ছা, আমি ও রকম কাউকে চিনি না, আমি নিউইয়র্কে থাকি। যাই হোক, আমি দেখব চেষ্টা করে ।
-মাফ করবেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-হ্যাঁ, অবশ্যই।
-আপনাদের বিয়ে হলো না কেন?
-আমরা সিলেটের বাইরের লোক। তার মা মেনে নেবেন না । তার ওপর সহপাঠী ছিল।
-আচ্ছা আমি চেষ্টা করব ,খুঁজে পাই কিনা। ফ্লোরিডায় অবশ্য অনেক পরিচিতজন আছেন। পেলে জানাব।
‘খুব জানতে ইচ্ছে করে
তুমি কি সেই আগের মতোই আছ
নাকি অনেকখানি বদলে গেছ...’
সহজ এই যোগাযোগ ব্যবস্থার দিনে মনে একবার হলেও জাগে মান্না দের সেই গানের কথাগুলো। আমরা সবাই জীবনে একবার না একবার হলেও ‘সার্চ’ নামের বোতামটিতে হাত রাখি, কোন না কোন প্রিয়জনের খুঁজে—দেখিতো ও কেমন আছে? ভালো আছে তো? কে তার সঙ্গী?
এখানে এসে কিছুটা হলেও আনুমানিক একটা আন্দাজ বা ধারণা মিলে বা প্রিয় মানুষটির চেহারা দেখে হলেও একটা প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে। নস্টালজিক করে দেওয়ার জন্য এর জুড়ি নাই। যে খুব আপন ছিল, যার জানা ছিল প্রতিটি মুহূর্তের খবর, সে এক সময় পর হয়ে যায়, যে কিনা পড়তে পারত খোলা বইয়ের মতো, সে কিনা খুব অচিন গ্রহের কেউ এখন? শুধু যে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক তা নয়, বন্ধু-বান্ধবী, চেনাজানা পথ চলতে চলতে অনেক প্রিয় মুখ আছে, যারা কিছু সময়ের জন্য হলেও আমাদের প্রভাবিত করে। কী এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রাখে।
দেখা হলে কি তেমনিই আপন আপন থাকবে? না কি খুব বেখাপ্পা উস্কখুস্ক ভাব করবে? অতীতের রুপালি আয়না ক্ষণিকেই পার করে কত বছর! যোগাযোগ হলে চলে যাই কখনো সেই ফেলে আসা দিনে। শ্বাস আর দীর্ঘশ্বাসে ভরা বর্তমানের দায়দায়িত্ব দেয়াল হয়ে থাকলেও আমরা মেনে নেই। এটাই হয়তো বিধাতার নির্ধারণ। থাক, সে ভালো থাক। তাই বলে প্রথম প্রেম বা গভীর সম্পর্কগুলো কেউ কখনো ভোলে না। সবাই রবীন্দ্রনাথ হলে নলিনীর মতো শেষ জীবনে লিখে ফেলতো নিজেদের প্রেমোপাখ্যান। প্রিয় মানুষের হৃদয়ের আয়নায় খুব প্রিয় কেউ ঠিক তার মুখ দেখতে পায়। হয়তো এই দেখাটুকুও অনেক বড়। জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে প্রেমের একবিন্দু স্মৃতি স্পর্শও শান্তির পরশ আনে। মানব-মানবী ভুলে যায় জীবনের সংঘাতে প্রতিদিন মনের খুন হওয়ার কথা।
সবাই যে সব যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন, এমন না। অনেকেই আছেন একান্তই কিছু ব্যক্তিগত মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো কিছুকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন না। তাদের হয়তো কোন প্রিয়জন তাদের খোঁজ করেই চলেছেন—
যদি দেখা হয় একবার
বছর দশ বারো পর
তুমি কি চিনিবে আমারে ?
আমিই ছিলাম তোমার মনের ঘরে
ভীষণ এক ঝড়!
ঝড় থেমে গেছে, জীবন পাল্টে গেছে নিষ্ঠুর নিয়তির সঙ্গে সঙ্গে। বদ অভ্যাসগুলো ছাড়তে কষ্ট হলেও আমরা মানব-মানবী মানিয়ে নিই জীবনের অমোঘ সত্যগুলো। ফ্রেমে হাসি বাঁধা জীবনের মূল্যে ঢাকা পড়ে অনুভূতি নামের ক্ষুদ্র মরীচিকাগুলো। কত কারণেই প্রিয় মানুষগুলো একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরে চলে যায়। তাদেরই একজন একদিন ওপরের বার্তাটা পাঠালেন মেসেঞ্জারে।
আমরা সবাই বাংলাদেশের মানুষ। সবাই এক মুখে এই কথা বললেও অঞ্চল ভেদে রয়েছে আমাদের বৈচিত্র্য এবং নিজেকে আলাদা করে দেখার এক প্রবণতা। এই প্রবণতার সর্বোচ্চ আসনে আছেন আমাদের সিলেটীরা। আজকাল অনেক শিক্ষিত পরিবার মেনে নিলেও অনেকেই মেনে নেন না। প্রগতিশীল হয়েও আমরা আমাদের সংকীর্ণতা আর মনের দৈন্য থেকে বের হয়ে আসতে পারি না। ভালোবাসার কাছে যেখানে একান্ত অন্য ভাষা, ধর্ম পরাজিত সেখানে নিজের দেশের মানুষ কেন এখনো হেরে যায়? এটাকে অনেকে সিলেটীদের আভিজাত্য মনে করলেও আমার কাছে গোঁয়ার্তুমি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। নিজেদের মধ্যে একতা থাকা ভালো। তাই বলে অন্যকে একাত্মতা জানানো যাবে না, ওটা কেমন কথা? গত কয়েক দিনে এ রকম দুটি ঘটনা শুনলাম। আরেকটা আমাদের খুব কাছের এক বন্ধুর ভাইয়ের, সিলেটে বসবাসরত অন্য জেলার মেয়েকে বিয়ে করেন। মেয়েকে মা মেনে নেননি, ছেলে ১৪ বছর স্ত্রী নিয়ে আলাদা থেকেছে, মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও সেকি প্রতিদিন কিছু অপ্রাপ্তির ভেতর দিয়ে যায়নি? এই অপ্রাপ্তি, উদ্বেগ হয়তো নিষ্ঠুরভাবে প্রতিদিন তার আয়ু কমিয়ে দিয়েছে। তিন সন্তান হওয়ার পর মা যখন নিজের বাড়িতে একমাত্র ছেলেকে জায়গা দিলেন, সেই ছেলে এক বা দুবছরের মাথায় মারা গেল। এ কি শুধুই নিয়তি? আমাদের পাপের ভার আর কত নিয়তির ঘাড়ে চাপাব?
এই যে ঘটনা, এ কি প্রকৃতির কোন শোধ? না কি আমাদের অহংকারের পতন? এসব শুনলে মনে হয় আমরা কত অসহায়? কত তুচ্ছ আমাদের ক্ষমতা! তবে কিসের এত অহংকার আমাদের? কেন আমরা মেনে নিতে পারি না দুজন মানুষের ভালো লাগার জীবন? তাহলে হয় তো কোনোদিন আর কাউকে খুঁজতে হতো না কোন হীরাকে। যে বেঁচে আছে, তার কথা জানার অপার আগ্রহ ভুলে জীবন এগিয়ে যায় গোপন দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে। যে চলে যায়, তার কথা জানার আগ্রহ হয়তো থাকে না, থাকে শুধু কষ্ট। জীবন চলে যায় ঠিক কিন্তু অবুঝ মন যখন মানে না তাঁর প্রিয়তমা নিশ্চয় হেডফোনটা কানে লাগিয়ে শুনতে থাকে...
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয় ও ও
চাঁদ হয়ে রব আকাশের ও গায়
বাতায়নে খুলে দিয়ো...।
সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক, কিছু প্রেম হৃদয়ের মাঝে পরম আদরে গোপন থাক। হাজার বছর পরে হলেও মনে হয়, প্রিয় মানুষটিকে যদি একবার দেখা যেত। অনেকের দেখা হয়, অনেকের হয় না। আবার পুরোনো প্রেম কারও কাছে বিষাক্ত সাপের মতো। তবে এমন যাদের অনুভব, সেগুলো হয়তো প্রেমই ছিল না ।