ভ্রান্তিবিলাস

টিউশনিতে যাওয়ার পথে কলা ভবনের সামনে ভিড় দেখে রিকশা থেকে নামলাম। প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন চলছে। আগের দাবি পূরণ না হওয়ায় এখন নতুন দাবি উঠেছে— ‘উপাচার্যের পদত্যাগ চাই’। স্লোগানরত ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়ের মধ্যে জিকুকে দেখতে পেলাম। ও আমার বন্ধু রাজীবের পরিচিত, ক’দিন আগে অল্প পরিচয় হয়েছিল। সোসিওলজি না পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এমনি কোনো একটা ডিপার্টমেন্টে পড়ে। এর বেশি কিছু জানি না। সে-ও আমাকে চিনতে পেরেছে। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে সঙ্গে হাত মেলালাম। দু/একটা কথা হলো। এমন সময় খবর এল, কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ আবারও হই-চই করল। কিন্তু, সেটি স্তিমিত হয়ে আসতে দেরি হলো না। ভিড়টা ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসতে দেখে আন্দোলনের ভবিষৎ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। ওদিকে পড়ন্ত বিকেলে রোদের আঁচও ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে এসেছে।
জিকুকে বললাম, এখন কোথায় যাবে?
সে মুখে ক্লান্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, কর্তৃপক্ষ তো আজ সন্ধ্যার মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে। ঢাকা শহরে হল ছাড়া আমার আর থাকার কোনো জায়গা নেই, তাই এখন আমাকে দাউদকান্দির বাস ধরতে হবে। কিন্তু, সামনে আবার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা। কী-যে করি!
জিকুকে-কে আমার বাসায় নিয়ে এলাম।
নিয়ে এলাম মানে ও-ই ব্যাগ গুছিয়ে আমার ঠিকানায় চলে এল সন্ধ্যা নাগাদ। আমি টিউশনি সেরে আগেই ফিরেছি। আমার বাসা মানে আমাদের মেস। জিগাতলায় তিন তলা একটা বাড়ির ওপরের তলায় আমরা নানা বয়সের ক’জন ছাত্র ভাড়া নিয়ে থাকি। বড় রাস্তায় রিকশা ছেড়ে দিয়ে ড্রেন আর ট্যানারির দুর্গন্ধে নাক চেপে গলিপথে অনেকখানি হেঁটে আসতে হয়। রাজীবসহ মেসের বাকি দু’জন বাড়ি গেছে। মেসটি তাই আপাতত খালি। জিকুকে রাজীবের ঘর দেখিয়ে দিলাম।
সালমা নামে এক বুয়া রাতে রান্না করে দিয়ে যায়। জিকুর জন্য রান্নার কথা আজ আগেভাগে বলতে পারিনি। বুয়াকে তাই একটু তরকারি কিনে আনতে হোটেলে পাঠালাম। বুয়া চলে গেলে হঠাৎ মনে একটা খটকা লাগল। বাথরুমের দরজায় টোকা দিলাম, ‘কী-রে জিকু, তুই কি হিন্দু-না-কি-মুসলমান রে? আমি তো গরুর মাংস কিনতে পাঠালাম।’
আমাদের সম্বোধন ইতিমধ্যে তুমি থেকে তুইয়ে নেমে এসেছে। জিকু গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হলো। মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি। শুনতে পায়নি ভেবে আমি আবারও বললাম, ‘আমি বুয়াকে হোটেলে পাঠিয়েছি গরুর মাংস কিনতে। তুই কি গরুর মাংস খাস?’
জিকু চুল মুছেই চলেছে, মুখের হাসি মোছেনি। বলল, ‘তোর কথা আমার অনেক দিন মনে থাকবে রে! আমরা কেউ কারও নামটুকুও ভালো করে জানি না তারপরও তুই আমাকে বাসায় এনে আশ্রয় দিলি। ধর্ম-টর্মতো পরের ব্যাপার। যা দিবি তা-ই খাব।’

২.
রাতে রাজীব ফোন করল। কথা প্রসঙ্গে জানালাম, জিকু আমাদের এখানে।
এ কথা শুনেই আমাকে অবাক করে দিয়ে সে হায় হায় করে উঠল। বলল, ‘করেছিস কী? ও-তো একটা সমকামী? ঢাকা কলেজ থেকে ও আমার জন্য পাগল। একবার নর্থ হোস্টেলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। তুই এই পাগলরে আমার ঘরে থাকতে দিছিস? এক্ষুনি ভাগা!’
‘বলিস কী-রে!’- আমি ঢোক গিললাম।
ফোন রেখে ও ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি জিকু ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়ছে। সামনে আমারও পরীক্ষা, তাই ওর সিরিয়াসনেসটা অনুভব করতে পারি। রাজীবের ওই কথায় কেমন করে ও-কে চলে যেতে বলি!
রাজীব আবারও ফোন করে তাগাদা দেয়, ‘ওই-টারে ভাগাইছিস?’
ওর চাপাচাপিতে একটু বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘ও-তো আমার কোনো সমস্যা করছে না। সুবিধামতো চলে যাবে। আর তুই ফিরতেও তো আরও ক’দিন বাকি।’
দু’দিন পর জিকু চলে গেল।
এই ক’দিন রাজীবের ফোনের পাশাপাশি বাড়ির মালিক এরশাদ ভূঁইয়াও ‘নতুন মেম্বার’, ‘নতুন মেম্বার’ বলে উসখুস করছিল। ঢোকার পথে গেটে দেখা পেয়ে তাকে বললাম, ‘জিকু নতুন মেম্বার হলো কেমন করে? এটাতো একটা মানবিক ব্যাপার। একটা মানুষ বিপদে পড়েছিল বলেই এখানে এসেছিল। নিয়মিত ক’জন মেম্বার তো এখন নাই। সে হিসেবে আপনার পানি, বিদ্যুৎতো বাড়তি খরচ হয়নি। মানুষের বিপদ-আপদ বুঝবেন না?’
এরশাদ ভূঁইয়া বিড়বিড় করে বলল, ‘বিপদেতো পড়েছি আমিও।’
‘আপনার কী বিপদ?’
প্রশ্নটি শুনল বলে মনে হলো না। উত্তর না দিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে চলে গেল।

৩.
“গুরুকার্য মাথায় ল’য়ে
কী করি আর কোথা যাই... কোথা যাই
রাত পোহালেই পাখি বলে
দে-রে খাই! দে-রে খাই! দে-রে খাই!...”
সকালে ঘুম ভাঙল খোলা গলায় এই গানের আওয়াজে। সঙ্গে একতারার টুং টাং।
এরশাদ ভূঁইয়ার কথিত ‘বিপদ’ গতরাতেই আমার এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। মেসের যে রুমটা ভাড়া হয়নি সেটির তালা খুলে বাড়ির দারোয়ান শাহ আলম একটি লোককে রেখে গেছে। বাউলা চুলের বেশির ভাগ পাকা, মুখে দাড়ি, পরনে সাদা লুঙ্গি, সাদা কুর্তা, হাতে একটা একতারা। চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে বুঝতে দেরি হয়নি যে লোকটি অন্ধ।
শাহ-আলম মানে দুনিয়ার বাদশাহ্‌। দারোয়ানের আচার-আচরণে একটা বেপরোয়াভাব আগেই ছিল। এখন বয়াতিকে খাবার-দাবার দেওয়ার অছিলায় আমাদের মেসে তার আসা-যাওয়া বেড়ে গেছে। গতকাল বাসায় ফিরছি এমন সময় একরকম হুড়মুড় করে সে দরজা খুলে নিচে নেমে গেল। ঢুকে দেখি গায়কের ঘরের ওদিক থেকে পড়নের শাড়ি ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসছে সালমা বুয়া। আমাকে দেখে স্পষ্টত অপ্রস্তুত। অপরাধী ভঙ্গিতে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘ভাই জান, আমার ক’লাম কোনো দুষ নাই! শাহ-আলমই আমারে চাইপে ধরছে!’ দেয়ালে হেলান দিয়ে বয়াতি ভদ্রলোক তখনো বসে আছেন। মুখে মিটি মিটি উপভোগের হাসি। দেখে মনে হয় উনি সব কিছুই দেখছেন। 

সালমা বুয়া আবার বলল, ‘চাচারে জিগায়া দেহেন। চাচায় সব দেকছে!’
আমি বললাম, আচ্ছা আপনি যান।
সালমা বুয়ার অভিযোগের ব্যাপারে শাহ-আলমকে নিচে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সে সরাসরি অস্বীকার করল। শেষে দোষ চাপাল বয়াতির ওপর।
আমি বললাম, ‘একটা অন্ধ বয়স্ক মানুষকে নিয়ে বাজে কথা বলতে আপনার একটুও বাঁধে না?’
শাহ-আলম ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘এহ! আন্ধা হইলে আমিও সাধু হইতাম!’
এ কথার দু’দুটি অর্থ হতে পারে। তাঁকে আর না ঘাঁটিয়ে চলে এলাম। ভাবলাম এরশাদ ভূঁইয়াকে শাহ-আলমের বাড়াবাড়ির বিষয়ে জানাতে হবে।

৪.
সালমা বুয়া এই বিল্ডিংয়ের প্রায় সব বাসায় কাজ করে। কাছাকাছি থাকে বলে নিজের বাচ্চাটিকে সব সময় দেখতে পারে। আর গৃহকর্ত্রীর খবরদারির বালাই নাই বলে ব্যাচেলরদের বাসায় কাজ করলে তার লাভ আর সুবিধা দু’টোই বেশি। তাই এই বিল্ডিংয়ের কাজ ছাড়ার কথা সে ভাবে না। বয়াতি তার ঘরেই থাকেন সারা দিন। এরশাদ ভূঁইয়ার বাসা থেকে বয়াতির জন্য খাবার-দাবার আসে। সে সুবাদে শাহ-আলমের আনা-গোনা ও দৌরাত্ম্যে ভাটা পড়েনি।
বয়াতিকে মেসে ঢোকানোর পর থেকে এরশাদ-ভূঁইয়ার খবরদারি, হম্বিতম্বি আশ্চর্যজনকভাবে কমে গেছে। আগে মাঝে মাঝেই ওপরে এসে গম্ভীর ভঙ্গিতে সবকিছু দেখে যেত। ইদানীং আর আসছে না। এর ফলে অন্য কারও লাভ-হোক-না-হোক, যার হতো সে এসে আবারও উপস্থিত হলো।
সেদিন হঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টিতে বাইরে যেতে না পেরে ঘরে বসে আছি। সোঁদা গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন সময় ভেজা গায়ে ব্যাগ হাতে জিকু এসে উপস্থিত হলো। আমার অপ্রস্তুত ও উৎসুক চেহারা দেখে দ্রুত কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল, ‘না, আমি হলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু, ক্যানটিন এখনো বন্ধ। তাই চলে এলাম। সপ্তাহ খানেক পর ক্যানটিন খুলে যাবে। তখন চলে যাব।’
এবার জিকুকে দেখেও এরশাদ ভূঁইয়ার উসখুস আর আগের মতো দেখা গেল না। আমাকে দেখেও আগের চেয়ে একটু বেশিই হাসিমুখে কথা বলে।
জিকু বাড়ি থেকে সঙ্গে করে অনেকগুলো বই এনেছে। ভগবৎ গীতা, আর স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতার বইগুলো বের করে কী মনে করে আমার বইয়ের শেলফে সাজিয়ে রাখতে লাগল। আমাকে বলল, ‘মা জোর করে সঙ্গে দিয়ে দিলেন।’

৫.
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ থাকলেও পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আমার পরীক্ষার আর বেশি দিন বাকি নাই। এ সময় পড়াশোনার ভীষণ চাপে নাভিশ্বাস উঠে যায়। সেদিন লাইব্রেরি থেকে বাসায় ঢুকে বুক শেলফের দিকে চোখ গেল। লক্ষ করলাম শেলফে রাখা কোরআন শরিফ নিচে রেখে তার ওপর জিকুর মায়ের দেওয়া ভগবৎ গীতাটি রাখা। আমি ওপর থেকে গীতাটি সরিয়ে বই দুটি পাশাপাশি রেখে দিলাম। জিকুকে কিছু বললাম না।
তিন দিন পর দেখি গীতা আবারও তার পুরোনো অবস্থানে আসীন হয়েছে। এবার একটু উষ্মা হলো! কোরআন শরিফটা আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন তাই এর প্রতি আমার আলাদা টান। এত দিন ওখানেই ছিল, কেউ কখনো ধরেনি। এর ওপর অন্য কোনো কিছু রাখার কথা ভাবতে পারি না। আমি এবার ওলটপালট করে কোরআন শরিফটা ওপরে রেখে গীতাটিকে নিচে রাখলাম। জিকুকে এবারও কিছু বললাম না। ও আজকাল বয়াতির ঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটায়। এখনো ও ঘরে বসে আছে। ভাবলাম, আর তো মাত্র ক’টা দিন, তারপর চলেই যাবে।
বয়াতির সঙ্গে আমারও ইদানীং একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ঘনিষ্ঠতার চেয়ে আসলে আমার কৌতূহলই বেশি। তার কথাবার্তা একটু এলোমেলো। কথার মাঝে মাঝে গা-ঝাড়া দিয়ে গান গেয়ে ওঠেন। কোনো কথার সরাসরি উত্তর দেন না। গায়ে কেমন যেন একটা রোদে পোড়া গন্ধ। কিন্তু, জামা-কাপড় চোখে পড়ার মতো সাফ-সুতরো।
তাঁকে বললাম, ‘গান কেমনে শিখলেন?’
বললেন, খুব ছোটবেলায় তিনি অন্ধ হয়ে যান। তখন চোখের আলো ছিল না ঠিক, কিন্তু, অন্য ইন্দ্রিয়গুলো ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী আর সংবেদনশীল হয়ে গিয়েছিল। সুর তাঁকে ছোটবেলা থেকে টানতো। তাঁর ‘কান’ যেন শুধু গানই শুনতো। সে কারণেই অন্ধ হয়ে তিনি সুখী। অন্ধ না হলে তাঁর কান তাঁকে বয়াতি বানানোর সুযোগ পেত না। তখন অন্য ইন্দ্রিয়গুলো জীবনের নিয়মে তাঁকে হয়তো নিয়ে যেত অন্য কোথাও।
তাঁকে জিজ্ঞেস করি, আপনার ধর্ম কী?
হেসে উঠে বলেন, আমি তো পাখির মতো। পাখির আবার ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম লাগে, সীমানা লাগে, আমার লাগে না। আরে, আমি তো কিছু দেখিও না! আমি কী শুনি জানি না। যা শুনি সবই কি বুঝি? জানি না। যা বুঝি তা কি কইতে পারি? জানি না। যা কই, তার কতটুকু তুমি শোনো, আর যা শোনো তার কতটুকু বোঝ? জানি না। যে এত কিছু জানে না, তাঁরে সত্য-মিথ্যা তত্ত্ব জিজ্ঞেস করে লাভ আছে?
বয়াতি আবার গান ধরেন:
“বেধ-বিধির পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার
এ-সব দেখি কানার হাট-বাজার”
গানের সঙ্গে সঙ্গে জিকু মাথা দোলায়। সে গায়কের সঙ্গে মিলিয়ে ইদানীং সাদা পোশাক ধরেছে। চুলও বড় করছে। ও-কে বললাম, ‘কী-রে! ভণ্ডামি ছাড়। তোর এই ভক্তি কি আর উনি দেখতে পাচ্ছেন?’
ও হাসে হো হো করে।
সেদিনও বয়াতির ঘর থেকে আসার সময় শেলফের দিকে তাকিয়ে দেখি গীতা ওপরে আর কোরআন নিচে।
জিকুর সঙ্গে একটু একটু করে আমার দূরত্ব বেড়েছে। সেদিন জিজ্ঞেস করায় বলল, ক্যানটিন খোলেনি বলে সে আরও কিছুদিন থাকবে।
আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, ‘রাজীব আসছে আগামী পরশু। রুমটা তোকে ছেড়ে দিতে হবে।’
ও অবাক হয়ে তাকাল।
এবার একটু জোরে শুনিয়ে বললাম, ‘ও তোর সঙ্গে এক ঘরে থাকতে চাইবে না। তুই কালই চলে যাস্‌।’
ও এবারও কিছু বলল না। শুধু মাথা কাত করে বলল, ‘আচ্ছা।’
রুমে ফিরে একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু, তিরটা ছোড়া হয়ে গেছে।

৬.
পরদিন জিকু চলে গেল।
দিন সাতেক পর বাসায় ঢোকার সময় ও-ঘর থেকে সালমা বুয়ার খিলখিল হাসির শব্দ কানে এল। একটু পর শাহ-আলম বেরিয়ে যাচ্ছিল। বুঝলাম, সমঝোতা বা বশ্যতা হয়েছে। আমাকে দেখে শাহ আলম ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমার চোখে পড়ল ওদের দু’জনের ধ্বস্তাধ্বস্তিতে ধাক্কা লেগে শেলফের বইগুলো মাটিতে পড়ে আছে। পড়ে আছে কোরআন শরিফ, গীতাসহ অন্যান্য বই! আমার মাথায় এবার খুন চড়ে গেল। শাহ-আলমের কলারে ধরে হিড়হিড় করে ওকে টেনে নিচে নিয়ে এলাম।
বললাম, ‘এই বাসা কি তোর বদমায়েশি করার জায়গা? তোকে এরশাদ ভূঁইয়ার কাছে নিয়ে যাব। দেখি সে কী বিচার করে।’
শাহ-আলম একটুও নমনীয় না হয়ে বলল, এরশাদ ভূঁইয়া আমারে কিছুই কইব না না। কইলে হের খবর আছে।
‘মানে?’, একটু অবাক হলাম!
শাহ-আলম বলল তার মা-ও এ বাড়িতে কাজ করত। এ সুবাদে সে এই বাড়ির আদ্যোপান্ত জানে মহল্লায় নতুন বসতি গড়া লোকগুলো যা জানে না। একটি লুকানো সত্য হলো এই বয়াতি এরশাদ ভূঁইয়ার একমাত্র ভাই। কোনো এক অসুখে ভুগে ১১ বছর বয়সে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গানের ঝোঁক ছিল বলে অবস্থাপন্ন পিতা তাকে তার মতো বড় হতে দেন। পিতার মৃত্যুর পর ছোট ভাই এরশাদ ভূঁইয়া সম্পত্তি বাড়িঘর ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ নেয়। অন্যদিকে বড় ভাই ধীরে ধীরে সংসার বিবাগি ও সম্পত্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কয়েক বছর পর পর মাঝে মাঝে হঠাৎ দেখা দেন। আর সে সময়টায় এরশাদ ভূঁইয়ার অস্বস্তি-দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। এরশাদ ভূঁইয়া চায় না বয়াতি যে তার ভাই সেটি জানাজানি হোক। এলাকায় কু-মন্ত্রণা দেওয়ার মতো লোভী-ধান্দাবাজ লোকের অভাব নেই। বড় ভাই সংসার বিবাগি, তা এরশাদ ভূঁইয়ার জন্য স্বস্তির বিষয়। কিন্তু কারও প্ররোচনায় বড় ভাই বিয়ে করে বসলে মুশকিল হবে। তখন অনাহূত ঝামেলায় সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ভয় আছে।
শাহ-আলমকে ছেড়ে দিয়ে ওপরে চলে এলাম।
ফিরে এসে দেখি সালমা বুয়া পড়ে যাওয়া বইগুলো আবার গুছিয়ে রেখেছে। গীতাটি যথারীতি ওপরে আর নিচে কোরআন শরিফ।
তাকে শাসানোর মতো করে বললাম, আপনিই তাহলে এত দিন শেলফ গুছাতে গিয়ে এই কাজ করতেন? এটা কী করলেন? কোরআন শরিফ হিন্দু বইয়ের নিচে রাখলেন?
বুয়া বললেন, ‘ভাই জান আফনে কোন বইয়ের কথা কচ্ছেন। আমি তো বই চিনি নে। আমি শুধু বইগুলা মুইছে ছোট বড় দেইখে একটার নিচে আরেকটা রাখি।’
আমি একটু চুপ থেকে বললাম, আচ্ছা আপনি যান। দারোয়ানের নামে এরশাদ ভূঁইয়ার কাছে নালিশ করে লাভ নেই। আপনি অন্য বাসায় কাজ খোঁজেন। আমি মাসের ভাড়া মিটিয়ে দেব। কাল থেকে আর আসার দরকার নেই।
বুয়া কিছু বলল না। চুপ করে শুনল।
বললাম, বয়াতি চাচা কী খেয়েছেন? আপনি যাওয়ার আগে বয়াতি চাচাকে আমাদের রান্না থেকে নিয়ে খাইয়ে দেন।
বুয়া বলল, উনি তো আইজ সকালের পরই চইলে গেছে।