যেহীন আহমেদ: এক আলোর দিশারির প্রস্থান

সিলেটে নাগরিক আয়োজনে লোকশিল্পীদের সম্মেলন হবে প্রথমবারের মতো। অনুষ্ঠান আয়োজনে আমরা তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছি। সংকলন বের হবে। এতে লোকজ উপাদানের বিষয় নিয়ে নানাজন লিখবেন। প্রকাশনাটির একটা নাম ঠিক করতে হবে। সিলেট স্টেশন ক্লাবে বসে আছেন নিভৃতচারী মানুষটি। বললেন, সংকলনটির নাম ‘ধামাইল’ রাখা হোক। সিলেট অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়েই সংকলন ‘ধামাইল’ বের করা হলো।

২০১৭ সাল। নিউইয়র্কে সিলেট বিশ্ব সম্মেলন হবে। আয়োজক সংগঠকদের একজন ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তাঁর সঙ্গে কথা বলি। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকায় সিলেট বিশ্ব সম্মেলন নিয়ে আমরা বিশেষ প্রকাশনার উদ্যোগ নিলাম। ডা. জিয়া জানালেন, তাঁর হাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা এসেছে। পাঠালেন। লেখক যেহীন আহমেদ। দ্রুত লেখাটি নিয়ে নিমেষেই পড়ে ফেললাম। যেহীন আহমেদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কারণে নয়, দেখতে চাচ্ছিলাম কী লিখেছেন তিনি।

‘সাধারণ সিলেটীদের অসাধারণ প্রয়াস’ শিরোনামে লিখেছেন যেহীন আহমেদ। কবীর আহমেদ, এ কে শেরাম, মোস্তাক আহমেদ দীন, সান্ত্বনা দেবী, মঈনুস সুলতান, অশোক বিজয় রাহা ও অনাদি কুমার দস্তিদারকে নিয়ে লিখেছেন যেহীন আহমেদ। ভূমিকায় লিখেছেন, যাঁরা নীরবেই নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন—এমন অনেক নিভৃতচারীর খবর কেউ জানেন না। আরেক নিভৃতচারী যেহীন আহমেদের কলমে উঠে আসে তাঁদের কর্মের কথা।

লেখাটি দেখে কান্না আসে। আমার দেখা নীরবে কাজ করে যাওয়ার উদাহরণ যেহীন আহমেদ নিজে। তাঁর কলমে অন্যান্য নীরব কর্মবীরের কথা বেরিয়ে আসছে। লেখাটি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণের ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ছাপি, যা অনলাইনে প্রকাশিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। দেশে গিয়ে পত্রিকার একটা কপি হাতে তুলে দেব। যেহীন ভাই ভাবলেশহীন চোখে বসতে বলবেন। এমনটি আর হবে না। ২৮ অক্টোবর তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। যাঁদের সন্দেহ হয়, বাংলাদেশে এনজিও খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জীবন আচরণ নিয়ে—তাঁদের একটু যেহীন আহমেদের খোঁজ নিতে বলা যেতে পারে। কোন পরিবার থেকে তাঁর আসা, তিনি কী রেখে গেছেন? কেমন ছিল তাঁর জীবনচিন্তা? নিজের ব্যক্তিচিন্তা পরিহার করে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে আলোর বিভা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়া এক নাম যেহীন আহমেদ।

কিছুদিন আগে আমাদের অগ্রজ আ ন স হাবিবুর রহমান চলে গেলেন। তাঁর জন্য শোকসভা হবে সিলেটে। জানাচ্ছেন, এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন, আবদুল করিম কিম। কথা হচ্ছিল, হাবিব ভাইকে নিয়ে সবচেয়ে ভালো বলতে বা লিখতে পারবেন যাঁরা, তাঁদের অনত্যম যেহীন। কিমকে জানালাম, তোমার কিছুই করতে হবে না। যেহীন ভাইয়ের কাছে যাও। বসে কথা বলো। তিনি যা বলেন, তা লিখে ফেলো। তাবৎ কাজ নিয়ে নিত্য ব্যস্ত আবদুল করিম কিম তাঁর সঙ্গে আর বসতে পারেনি। কিমের কাছ থেকেই তাঁর অসুস্থতার কথা আবারও জানলাম। জীবিত থাকতে এ মানুষটাকে নিয়ে বসার কথাও বলেছিলাম। অনেক কিছুই আমাদের হয়নি, হয়ে ওঠেনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন ধারণার একজন কর্মী হিসেবে যেহীন আহমেদ তাঁর কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজেই গ্রাম উন্নয়নবান্ধব—এফআইভিডিবি নামের সংস্থা গড়ে তোলেন। বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়নের যে সাফল্য আমরা শুনতে পাই, তাঁর এক নীরব কর্মবীর ছিলেন যেহীন। মৃদুভাষী, নিভৃতচারীসমৃদ্ধ এই মানুষটির কাছে যাঁরা গেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন—কতটা জ্ঞান থাকলে মানুষ বিনয়ী হতে পারে। আশি বা নব্বইয়ের দশকে সিলেটে নানা কাজে সক্রিয় যুব–তরুণ অনেকেই যেহীন ভাইয়ের আলোর উত্তাপ পেয়েছেন। কাউকে সহকর্মী বানিয়েছেন, কাজ দিয়েছেন, উন্নয়নে নিজের ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন বহুজনকে।

আ ন স হাবীবুর রহমান, মঈনুস সুলতান, এনামুল হক, নাজমুল হক, মঞ্জুরুল ইসলামসহ বহুজনের কর্মস্থল তখন এফআইভিডিভি। আমিও গেলাম। যেহীন ভাই কাজ দিলেন। নিজেই এনজিও করব সিদ্ধান্ত নিলাম। যেহীন ভাইয়ের কাছে পরামর্শ নিই। নিজেকে একজন সার্বক্ষণিক পেশাদার উন্নয়নকর্মী হিসেবে দেখতেন। ব্যক্তিগত কোনো জীবন ছিল না তাঁর। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন যেকোনো ভালো কাজে।

সিলেট অঞ্চলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা যেহীন ভাইয়ের বড় ভাই অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী। আইন পেশায় গিয়ে আইনজীবী রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করি। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আইনজীবীদেরও আইনজীবী। আইন বিষয়ে জ্ঞানের সাগর। তিনি অকৃতদার ছিলেন। যেহীন আহমেদও বিয়ে করেননি। তাঁর কোনো সংসার ছিল না। উন্নয়ন–ভাবনা আর লেখাপড়া নিয়েই ছিল তাঁর ব্যস্ত সময়।

শহরের মীরের ময়দানে তাঁদের বাড়িটি সিলেটের বাসা-বাড়ির ঐতিহ্য ধারণ করে টিকে আছে। অনেক দিন পর দেশে গিয়ে তা দেখেও এলাম। রিকশা থামিয়ে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম, কত দুপুর-বিকেলে যেহীন ভাইয়ের একটু দেখা পাওয়ার জন্য বাসাটিতে গিয়েছি। সদা ব্যস্ত এই মানুষটিকে কখনো একাকী পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। দেশি-বিদেশি সংস্থা যাদের সঙ্গে উন্নয়ন নিয়ে কাজ, তাদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম নিয়ে ব্যস্ত নিত্যদিন। তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার বৈশিষ্ট্য দেখে অবাক হয়েছি। ব্যবহারিক শিক্ষার কর্মকৌশল নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। যেহীন আহমেদ একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে আলোচনা শেষ করলেন। বহুবার দেখেছি, যখন ইংরেজিতে আলোচনা করছেন, ইংরেজিই বলছেন। বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটি ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করতেন না। শেলি, কিটস, তলস্তয়, শেক্‌সপিয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ—সব নিয়ে যেহীন ভাইয়ের পাণ্ডিত্য অগাধ। চলচিত্র, সংগীত, ক্রীড়া সব বিষয়ে খবর রাখতেন। তবে কখনো নিজেকে জাহির করতেন না।

নব্বইয়ের দশকে আন্তনগর ট্রেনে সিলেট-ঢাকায় যাতায়াত করতাম। সেরা সঙ্গী ছিলেন যেহীন আহমেদ। ১০ ঘণ্টার যাত্রা ১০ মিনিটের মনে হতো। তাঁর কাছে সাহিত্য–সংস্কৃতির নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছিল বহুবার। রাজনীতির নানা পাঠ, রেনেসাঁ থেকে বিশ্বের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নানা বাঁক নিয়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তাঁর আলোচনায় বারবার মুগ্ধ হয়েছি। একজন মানুষের কী পরিমাণ পড়ালেখা থাকলে এমন পাণ্ডিত্য অর্জন সম্ভব, তা ভেবে অবাকই হয়েছি বারবার।

২০০৪ সালে নিউইয়র্কে হঠাৎ দেখা যেহীন আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে। সিলেট সম্মেলনে এসেছেন। দূর থেকে আমাকে দেখে কাছে ডেকে নিয়েছেন। দ্রুতই বসলাম তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে। তত দিনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। দেশে এনজিওদের সমন্বয় সংস্থা এডাব গঠনের সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলাম। এসব নিয়ে নানা কথা বললেন। বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়নের কাজ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরুর গল্পটি আবার শোনালেন। আবারও জানালেন, উন্নয়নকর্মে নিজের জড়িয়ে যাওয়ার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন কোনো রাজনীতি–নিরপেক্ষ বিষয় নয়’। বাংলাদেশে উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে রাজনীতি আর নিরপেক্ষতার সূক্ষ্ম দড়িতে নিজেদের অবস্থান নিতে হচ্ছে। তাঁর সাক্ষাৎকার সেদিন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকায় ছাপতে দিলাম। ছাপতে দেওয়ার আগে তিনি একবার দেখেও নিলেন।

অ্যাডভোকেট শহীদুল ইসলাম শাহীনসহ নিউজার্সির বারান্দায় বসে যেহীন ভাইয়ের কথা আলোচনা করেছি অনেকবার। ২৮ অক্টোবর শাহীনই খুদে বার্তায় জানালেন, যেহীন আহমেদের মরদেহ ঢাকা থেকে সিলেট আসছে। দরগাহ প্রাঙ্গণে জানাজার পর তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হবে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারসংলগ্ন এলাকায়।

দেশে গিয়ে যেহীন ভাইকে পাইনি, দেখা হয়নি। বরাবর কাছের মানুষ হিসেবে মনে করেছি। এ সমাজের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ে আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করেছেন সারা জীবন। জাতীয় পর্যায়ে যাঁরা বেসরকারি উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের সমীহ ছিল তাঁর প্রতি। এমনকি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে যেহীন আহমেদ ছিলেন পরিচিত মুখ। তাঁর সঙ্গে জানা–পরিচয় আছে, এমন বার্তাই অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল।

যেহীন আহমেদের কাজের ব্যাপ্তি পরিমাপ করার যোগ্যতা আমাদের অনেকের নেই। তাঁর মতো মানুষ আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই, আসবেনও না। হাইব্রিড উর্বরতার জমিতে আরেকজন যেহীন আহমেদের বেড়ে ওঠার প্রত্যাশা এখন সুদূর পরাহত। বহু নিভৃতচারী স্বপ্নচারীর হৃদয়ে আলোর দিশারি হয়ে বেঁচে থাকবেন সদা বিনয়ী, নির্মোহ ব্যক্তিত্বের আলোকিত এই মানুষটি।

সমাজকর্ম আর উন্নয়নকে সংসার মনে করে জীবন কাটানো যেহীন আহমেদের কবরে দাঁড়িয়ে তাঁর কোনো সন্তান হয়তো ফুল দেবে না। সে প্রত্যাশাও তাঁর ছিল না। দূর দেশ থেকে স্মৃতিকাতর এক অক্ষম অনুজের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তাঁর জন্য। কীই–বা আর করতে পারি? আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্যে ছিলাম, বাংলার খাঁটি মাটি ছুঁয়ে তাঁর মতো কর্মবীরের জয়গান গেয়ে যাব বাকিটা জীবন।