কেন তারা পিছিয়ে পড়ছে?

সব মা-বাবার মধ্যে উচ্চাশা কাজ করে যে বড় হয়ে সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। কেউ চায় না তাদের ছেলেমেয়ে নায়ক-গায়ক হোক বা অন্য কিছু। খুব কম মা-বাবা আছেন যে, কিছুই আশা করেন না বা ভাবেন যে, সন্তান বড় হয়ে তার পছন্দ মতো কিছু হোক। হিন্দিতে বহুল ব্যবহৃত একটি কথা হচ্ছে, ‘রিশতা নিভানা।’ মানে সম্পর্ক ঠিকঠাক মতো পালন করতে পারা বা দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা। একজন মানুষ সংসারের দায়-দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তার সম্পর্ক ঠিক রাখে। একজন অফিসকর্মী যে রকম তাঁর কর্মের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেন, ঠিক তেমনি একজন ছাত্রের দায়িত্ব তার পড়াশোনা ঠিক রাখা। সে যখন এটা ঠিক রাখতে পারে, তখন তার মা-বাবার সঙ্গে একটা অন্য রকম সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সন্তানের এমন দায়িত্ব পালনে মা-বাবা মুগ্ধ হন।
বাচ্চারা যখন তাদের পড়াশোনার কাজ যথাযথভাবে পালন করতে পারে না, তখন মা-বাবার মধ্যে বাসা বাঁধে হতাশা। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চারাও হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন পারছে না—এ কথা কেউ কি ভাবেন? দেশ বা বিদেশ সব জায়গায়ই বাচ্চারা কমবেশি সমস্যায় রয়েছে। কোনো মা-বাবাই বাচ্চার মেধা কতখানি, সে ব্যাপারে জানতে আগ্রহী নয়। খুব কমসংখ্যক রয়েছেন, যারা অনুধাবন করতে পারেন, ‘আমার বাচ্চা মানসিকভাবে বা মজ্জাগতভাবে তেমন মেধার অধিকারী নয়।’ যদি করতেন, তাহলে কোচিং সেন্টারগুলোতে সন্তানের মেধা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সবাই অংশ নিতেন না। এই নিউইয়র্কেও এ প্রতিযোগিতা আছে। তবে দু-একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা শুনে মনে হলো এ ব্যাপারটা আমাদের সামনে আনা উচিত। ‘কেন তারা পিছিয়ে পড়ছে?’ এ প্রশ্নের মীমাংসা না হোক, এ নিয়ে আলোচনাটা জরুরি।
প্রথমত আমরা মা-বাবারা সবাই দিন দিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠছি। আগে কিন্তু এ ‘ট্রেন্ড’ বা ‘ক্রেজ’ ছিল না। বাচ্চারা নির্মল হেসে-খেলে মাঠে-ঘাটে চরে বড় হয়েছে। এর মধ্য থেকে কতিপয় ‘অসাধারণ’ বের হয়েছে। যারা পড়াশোনা করেনি, তাদের হয়তো সপ্তাহে একবার উত্তমমধ্যম দিয়ে মা-বাবা ক্ষান্ত হয়েছেন, কিংবা কঠিন কোনো শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়েছেন একেবারে বেতসহ। শিক্ষকের সঙ্গে কাটানো সেই দু-এক ঘণ্টা কঠিন হলেও ডানপিটে ছেলেমেয়ে নিজের মতো করে বড় হয়েছে। তাদের মা-বাবার কোনো চাহিদা ছিল না যে এটা-ওটা হতেই হবে। সন্তানকে উকিল-ব্যারিস্টার বানানোর স্বপ্ন দেখতেন নিতান্ত অভিজাত পরিবারের কেউ কেউ। এখন বাচ্চাদের সেই স্বাধীনতা কোথায়? সব বাচ্চাই এখন চাপের মধ্যে থাকে। কারণ তাদের নিজেদের স্বপ্ন নয়, মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। অনেকটা ওই ‘থ্রি ইডিয়ট’ সিনেমার মতো ছেলে ফারহানের জন্ম হতেই বাবা তার গায়ে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ সিল সেঁটে দেওয়ার মতো। মা-বাবার ইচ্ছের কাছে পর্যুদস্ত ফারহানের আত্মপীড়নের নমুনা পাওয়া যায় একটি সংলাপে। ফারহান বলছিল, ‘সালা কিসিনে ইয়ে ভি নেহি পুছা তু কেয়া বন্না চাতি?’ আমরাও এ রকম সচেতন মা-বাবার বাইরে নই। পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুর ছেলেমেয়ে ভালো করছে, এটা রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ, আর সেই চাপে চ্যাপ্টা হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা। মেধা বা আইকিউ কম-বেশির ব্যাপার আছে বলেই প্রতিষ্ঠানগুলোও সেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। যাদের অসাধারণ মেধা রয়েছে, তারাই যাবে ভালো স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে—এটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতাকে হটিয়ে কোচিং টেকনিকের ইঁদুর দৌড়ে নেমে অনেকে সুযোগ পেলেও পরে সেটা হয়ে যায় বদহজমের মতো।
এখানে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় হাইস্কুলে ভর্তির তোড়জোড়। বাংলা কিছু কোচিং সেন্টার আছে, যাদের মূল কাজ ডলার গোনা। বাচ্চা কতটুকু শিখছে সে ব্যাপারে সত্যি বলতে কোনো আগ্রহ নেই; কিন্তু বাচ্চা যখন ভালো স্কুলে চলে যায়, তখন সব সাফল্য চলে যায় তাদের ঝুলিতে। আমরা মা-বাবারা কুমিরের বাচ্চার মতো সন্তানদের দিয়ে আসি শেয়ালের কাছে শিক্ষিত হতে। সবার মতো আমিও দৌড়ে অংশ নিয়েছিলাম। তবে সে পথের শুরুতেই দৌড় বন্ধ করে পিছিয়ে এসেছিলাম। কারণ মেয়ে একদিন বলেছিল, ‘মম ওরা যে (লেকচার) শিট দেয় সেগুলো আমি লাইব্রেরি থেকেও আনতে পারি। শিট দিয়েই বসিয়ে রাখে চার ঘণ্টা। তুমি তোমার টাকা নষ্ট করছ। আমার সাপ্তাহিক ছুটি চলে যায় হোমওয়ার্ক আর কোচিংয়ে। আমি কোনো আগ্রহ পাই না।’ শিক্ষার্থীদের ‘না-পারা’ বিষয়গুলো আগ্রহ নিয়ে কখনোই শুধরে দিতে দেখিনি ওদের। মেয়ের দুর্বলতা আমি জানি, অঙ্ক। যদিও বলে, ‘Don’t worry I could survive’। অঙ্কে দুর্বলতার মূল কারণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে না পড়া। তাই বড় অঙ্ক পারলেও অনেক সময় তুচ্ছ কিছু বিষয়ে আটকে যায়। ঘরে একজন শিক্ষক রেখে দিলাম, যিনি বাংলাদেশের; এখানকার কলেজে অঙ্ক শেখান। উনি একদিন বললেন, ‘আপনি দেখবেন আমাদের কমিউনিটির মা-বাবারা, যারা কোনো রকমে কলেজে গেছেন বা এসএসসি-এইচএসসি পাস করেছেন, তাঁরাই বেশি সিরিয়াস; যেন স্টাইভেসেন্ট ছাড়া কোনো স্কুল নেই এখানে। এমন অনেকে আছে, যারা অনেকটা ভাগ্যগুণেই ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু পরে সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়।’
তাঁর কথার সত্যতাও পাওয়া যায়। আমি যেসব বিদেশিনীর সঙ্গে চলি, তাদের সবার বাচ্চা কমবেশি ভালো স্কুলে পড়ে, সাধারণ স্কুলেও যায়। তাদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। কিন্তু এ ধরনের কোনো ক্রেজ নেই তাদের মধ্যে। তাদের ভাষ্য, ‘যদি সে সুযোগ পায় খুবই ভালো, না পারলেও ক্ষতি নেই। কারণ সব স্কুলই ভালো।’ তাদের যেমন উচ্চাশা নেই তেমন হতাশাও নেই।
আমাদের বাঙালি একজনের বাচ্চা ছেলে প্রথম বছর ব্রঙ্কস সায়েন্স হাইস্কুলে সুযোগ পেয়েছিল। পরেরবার আবার চেষ্টা করে স্টাইভেসেন্ট স্কুলে চান্স পেয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। মা-বাবা প্রচণ্ড খুশি। আটটা বিশেষায়িত স্কুল আছে। গত বছর সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছে স্ট্যাটেন আইল্যান্ড। স্টাইভেসেন্ট ছিল সপ্তম বা অষ্টম অবস্থানে। অথচ বাঙালি ও এশীয়দের মধ্যে একটা অন্যরকম দুর্বলতা কাজ করে স্কুলটির প্রতি। যেন এটাতে না পড়লে ছেলেমেয়ের জীবনে আর কিছু হবে না। তবে খুব বড় সত্য হলো, আমেরিকার সবগুলো পাবলিক স্কুলই ভালো।
সম্প্রতি শুনলাম এক মা চিন্তিত। কারণ স্কুল থেকে নোটিশ দিয়েছে, ছেলে ভালো করছে না, এ রকম হলে আগামী ক্লাস পরীক্ষার পর তারা তাকে বিদায় জানাবে। এ জিনিসটা আমি আগেও শুনেছি, মেয়ে ব্রুকলিন টেকে পড়া চালিয়ে যেতে পারছে না। কোনো ভালো স্কুলে সুযোগ পাওয়ার চেয়ে সেখানে পড়া চালিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে যায়, যদি না সে যথাযথ মেধাবী ও পরিশ্রমী না হয়। বাচ্চাদের মাঝে দেখা দেয় হতাশা। প্রচণ্ড পড়ার চাপ থাকে। সব পরিপূর্ণভাবে শেষ করতে না পারার ভয়ে এরা মুষড়ে পড়ে। এদের কাউকে কাউকে এ চাপের কারণে আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিতে দেখা যায়। এই খবরটা আমার মেয়ে দিয়েছিল, সেই গৃহশিক্ষকও এতে সমর্থন জানান। দেশেও এ রকম প্রতিযোগিতার চাপ খাঁড়া হয়ে ঝুলছে বাচ্চাদের ঘাড়ে। প্রতি বছর ফলাফল বের হওয়ার পর দেখা যায় নানা দুঃসংবাদ।
সব শেষে বলতে চাই, মা-বাবাকে বুঝতে হবে একটা বাচ্চা কতটুকু বোঝা বহন করতে পারবে। তাকে জীবনের শুরুতেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি না পাঠিয়ে সহজ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিত। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বেড়ে উঠলে যে কোনো বাচ্চাই রাজু দস্তগীরের মতো বলতে পারবে, ‘আপনি জিন্দেগি কি সাথ কুচনা কুচ তো ধান্দা করলেংগি।’ জীবনে এই আত্মবিশ্বাস খুব জরুরি। কোচিং করলে, গাইড পড়লে, যেকোনো ভর্তি পরীক্ষা উতরে যাওয়া যায়; কিন্তু প্রকৃত মেধা না থাকলে লড়াইয়ে টিকে থাকা যায় না। আশা অবশ্য বড় হবে। তবে সেটা নিজের মধ্যে থাকতে হবে। যে বাচ্চার মধ্যে এটা আছে, তারা প্রতিকূল অবস্থায়ও জীবনে কিছু করতে পারে। অবশ্যই আমরা আমাদের স্বপ্নের চেয়ে বড়, তবে সেই স্বপ্ন হতে হবে একান্ত নিজের। তাহলেই তা সফল করা সম্ভব। অন্যের চোখে দেখা স্বপ্ন সফল করে তোলা দুরূহ ব্যাপার। আমরা বড়জোর সন্তানদের উৎসাহ দিতে পারি, চাপ নয়। একজন অভিভাবক যদি বাচ্চাকে বলতে থাকেন, ‘পারলে কিছু হয়ে দেখা’। তাহলে সেই বাচ্চা শুরুতেই থমকে যেতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ সবার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।