মানবসেবায় সীমানা বাধা নয়

১৯৯২ সাল। তখন জেলা অন্ধ কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আমি। দায়িত্বে থাকার কারণে জেলার নানা জায়গায় আয়োজন করতে হতো ফ্রি আই ক্যাম্প বা বিনা মূল্যে চক্ষু শিবির। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থা, মৌলভীবাজার বাজার শাখার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই চক্ষু শিবির চলতো পক্ষকালব্যাপী। মরহুম ডা. নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫/৬ জন নিবেদিত সদস্যের সহযোগিতায় রোগী বাছাই থেকে শুরু করে বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচারের মতো জটিল কাজ হতো। আর ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আগত সব বয়সী রোগীর নিরাপত্তাসহ রোগীদের খাবারের সুব্যবস্থা করার আয়োজনে থাকত সুনামগঞ্জ জেলা অন্ধ কল্যাণ সংস্থায়। ওই সময়ে জেলা শহরে ভালো কোনো চক্ষু হাসপাতাল না থাকায় জেলার যেকোনো স্থানে চক্ষু শিবিরের আয়োজন হলে রোগীর ভিড় হতো অগণিত। বেশির ভাগ রোগী হতেন বয়স্ক নারী-পুরুষ। যাদের অধিকাংশের সমস্যা ছিল চোখে ছানি পড়াসহ চক্ষু সংক্রমণের নানা রোগ।
সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনা মূল্যের এই সেবা যথাসম্ভব সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। ১৯৯২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বিনা মূল্যে চক্ষু শিবিরের আয়োজন হতো শহরের উত্তরে সীমান্ত লাগোয়া গারো নৃ গোষ্ঠীর এলাকা নারায়ণ তলা মিশন বিদ্যালয়ে। অনুমতি নেওয়ার জন্য ক্যাম্প শুরুর এক সপ্তাহ আগে একজন প্রশাসনিক ব্যক্তিসহ দুজন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বিদ্যালয়টি দেখা মাত্রই চমকে গেলাম। তখনকার সময়ে সারা জেলায় এত সুন্দর পরিপাটি এবং নিয়ম–শৃঙ্খলা মেনে চলা আরেকটি বিদ্যালয় আছে কিনা আমার জানা ছিল না। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে টয়লেট সবই ছিল আধুনিক এবং তা দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন সৎ পরিশ্রমী তিনজন গারো নারী-পুরুষের একটি দল। কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় গারো রাজার সঙ্গে আলোচনা করে দিন তারিখ ঠিক করে ফিরে এলাম শহরে।
খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃপক্ষের শতভাগ সহায়তার আশ্বাস পেয়ে সবার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বিদ্যালয়ের একাংশের বড় বড় দুটি শ্রেণিকক্ষ নিয়ে করা হলো অস্ত্রোপচার পরবর্তী পুরুষ ও নারী রোগীদের সপ্তাহব্যাপী থাকার ব্যবস্থা। অন্য অংশের দুটি কক্ষকে বানানো হলো অস্থায়ী অপারেশন থিয়েটার। সঙ্গে পাশের কক্ষে চিকিৎসক ও বাকি সহযোগীদের থাকার সুব্যবস্থা। পুরো এলাকায় চালানো হলো ব্যাপক প্রচার। স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় নেওয়া হলো বাকি সব প্রস্তুতি। ক্যাম্প উদ্বোধনের আগের দিন দুপুরের পর গেলাম নারায়ণতলায়। সীমান্তের ওপারে সবুজ বনে আচ্ছাদিত মেঘালয় পাহাড়সারি, মাঝে মাঝে কিছু দূর পর পর ওপর থেকে বনের ফাঁক গলে নেমে এসেছে ছোট বড় ঝরনা। সফেদ জলের শব্দহীন মনোরম ধারা। পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে বাংলাদেশ সীমান্তে ১০/১২টি খড়ের চালা দেওয়া ছোট ছোট বাড়িঘর। বেশির ভাগ গারোদের বাস ওই জায়গায়। ওরা বলে পুঞ্জী। তেমনি কয়েকটি পুঞ্জী মিলে গারোদের মূল আবাসস্থল দেখাশোনা করেন এক রাজা। যিনি নিজে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বলেই হয়তো মিশন বিদ্যালয় কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য। খুবই স্বল্পভাষী ও বিনয়ের অবতার।
রাত কাটালাম বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলনায়তনে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে নৈশভোজ সারা হলো। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া স্বেচ্ছাসেবীদের অবিরাম পরিশ্রমে তৈরি হলো অস্ত্রোপচারের নিরাপদ কক্ষ, চিকিৎসক ও সহকারীদের থাকার জায়গাসহ রোগীদের সাময়িক ওয়ার্ড। পরদিন সকাল থেকে ধীরে ধীরে রোগীদের আগমন ঘটতে থাকল। বেলা ১০টা নাগাদ বিদ্যালয়ের সামনের ছোট মাঠটি পূর্ণ হয়ে গেল। সকালে আসলেন প্রয়াত ডা. নূরুল ইসলাম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলামসহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শুরু হলো রোগী বাছাই কার্যক্রম। সাধারণত আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তিন/চার ঘণ্টা পর অনুমান করা যায়, কী পরিমাণ রোগীর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে। ডাক্তার সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনি, তাঁর উষ্মা মিশ্রিত আলাপ। বারবার জিজ্ঞেস করছেন, রূপু ভাই এই এলাকা কি দেশের বাইরে? আমি বললাম না তো, কেন? একটু রাগ করেই বললেন, জিজ্ঞেস করছেন কেন? যান পাশের কক্ষে দেখে আসুন, প্রথম দিনেই কী পরিমাণ রোগী এসেছে। আগামীকাল আরও কী পরিমাণ আসে কে জানে! তাঁর কথা শুনে ভড়কে গিয়ে পাশের রুমে উঁকি দিয়ে চমকে গেলাম। প্রথম দিনেই শয়ের ওপর রোগী! কিন্তু আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় বলে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুই দিনের বাছাই শেষে মোট রোগীর সংখ্যা গড়পড়তা দাঁড়ায় শ দুয়েকের কাছাকাছি বা সামান্য বেশি। কিন্তু এবার মনে হলো, রোগীর সংখ্যা তিন শ ছাড়িয়ে যাবে।
রোগীদের চাপের বিষয়টি প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের জানানোর পাশাপাশি নিজেও মনে মনে তৈরি হলাম বড় আকারের রোগীদের একটি দলের দেখভাল করতে। পরদিন সকালে আবার রোগী দেখা শুরু করে দিনান্তে মোট সংখ্যা দাঁড়াল ২০০ জনের সামান্য বেশি। সন্ধ্যার আগে স্বেচ্ছাসেবকসহ আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ শেষে রাতের খাবার পরিবেশনায় যখন সবার মনোযোগ ঠিক তখন আমার ডাক পড়ল প্রধান শিক্ষকের কামরায়। সেখানে গিয়ে দেখি, বিদ্যালয় থেকে সামান্য দূরে সীমান্ত চৌকির ভারপ্রাপ্ত স্থানীয় অধিনায়ক বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বা বিজিবি) এক সদস্যের সঙ্গে আধা সামরিক বাহিনীর পোশাক পরিহিত একজন অপরিচিত বয়স্ক লোক। পাশে বসার পর পরিচয় পর্বের শুরুতেই চমকে উঠলাম। তা কীভাবে সম্ভব? আমার পাশেই বসা বয়স্ক ভদ্রলোক ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী অর্থাৎ বিএসএফের স্থানীয় ক্যাম্প কমান্ডার। তিনি সংক্ষেপে তাঁর আসার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর উত্তরে বললাম, আমাকে একটু সময় দিন। ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে আসি। সারা দিন প্রায় শ পাঁচেক রোগী দেখে ডাক্তার সাহেব ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে গেছেন। ঠিক সেই সময় তাঁকে গিয়ে জানালাম পাশের দেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা অতিথির অভিপ্রায়।
ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী যাকে সবাই বিএসএফ বলে জানে, সেই বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের বিডিআর বাহিনীর একজনকে সঙ্গে করে বিদ্যালয়ে এসেছিলেন একটি অনুরোধ নিয়ে। সেটি হলো, সীমান্তের ওপারে দীর্ঘদিন যাবৎ কর্মরত অনেক বিএসএফ সদস্য চোখের নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। যদি সম্ভব হয়, তাঁদের সীমান্ত লাগোয়া বিদ্যালয়ে এনে তাঁদের চোখ পরীক্ষা করা যায় কিনা।
সব শুনে আমার মতো ডাক্তার সাহেবও ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠলেন। খানিক সময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, রূপু ভাই আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অসুবিধা না হলে বলে দিন কাল সকাল ৮ টার আগে ক্যাম্পে আসতে। আমি তাঁদের দেখব। সংখ্যায় কতজন হবে তা কোনো বিষয় নয়। মানবতার সেবায় পাসপোর্ট-ভিসা বাধা হতে পারে না, বলে দিন। অতিথিদের বলে দিন কাল সকালেই চলে আসতে। শুনে ছুটে গেলাম দরজার বাইরে। অপেক্ষমাণ দুই দেশের দুজন আধা সামরিক কর্মকর্তাদের যখন বললাম, জী হ্যাঁ, কোনো অসুবিধে নেই। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, তিনি সবার চোখ পরীক্ষা করবেন, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারও করে দেবেন। তা শুনে বিএসএফ বাহিনীর বয়স্ক কর্মকর্তার চোখ থেকে মনে হলো কয় ফোঁটা আনন্দাশ্রু মাটিতে ঝরে পড়ল। দুটো চোখ খুশিতে চক চক করছে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আমার ডান হাত চেপে ধরে হ্যান্ডশেক সারলেন খুশির সঙ্গে। বারবার বলছেন, অনেক ধন্যবাদ আপনাদের, অনেক ধন্যবাদ।
সেবার শুধু বিএসএফ নয়, সীমান্তের অপর পারের আরও আধা ডজন ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ২০ জনের চোখ পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল চশমা।