শৈশবেই সন্তানকে আদর্শ শিক্ষা দিন

কয়েক মাস আগের কথা। সেদিন ছিল আমার সাপ্তাহিক ছুটি, না গরম না ঠান্ডা। প্রকৃতিতে আমার দেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ছিল। বসন্তের ফুলগুলো আংশিকভাবে ঝরে গিয়ে এই শহরের প্রকৃতি সবুজে জেগে উঠেছিল। ছকবাঁধা সপ্তাহের অন্যান্য দিনে আমার ঘুম ভাঙে ঘড়িতে অ্যালার্মের শব্দে। একমাত্র ছুটির দিন রোববার আমি ঘড়ির অ্যালার্ম, মুঠোফোন বন্ধ করে রাখি। সকালে ঘুম ভাঙার পরও জেগে জেগে আয়েশ করে মনের ঘরে রং-বেরঙের স্বপ্ন বুনি। মন ভালো হয়ে যাওয়ার অভিধানে ঢুকে সুখের পায়রাগুলো উড়িয়ে দিই। মুক্ত আকাশে ওদের উড়তে দেখে মুগ্ধ হই। তাদের সঙ্গে আমিও উড়ে উড়ে হারিয়ে যাই বহুদূরে। বেলা করে বিছানা ছাড়ি। বিদেশের কর্মব্যস্ত জীবনে সপ্তাহের এই একটি দিন মনে হয় আমি আমার বাবার রাজকন্যা। কিন্তু বিধি বাম। ঘড়ির অ্যালার্ম আর মুঠোফোনটি বন্ধ থাকলেও সকাল ৯টার দিকে বাসার ল্যান্ড ফোনে কল করে আমাকে কাজে যেতে বলা হয়। কারণ যিনি আজ কাজ করার কথা উনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর জায়গায় আমাকে কাজ করতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই! কাজের উদ্দেশে তৈরি হয়ে শেষরাতের রেলগাড়ির মতো ধীরে ধীরে বিষণ্ন মনে হাঁটতে লাগলাম। মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়েছে। আমার মন খারাপে হয়তো আজ প্রকৃতিরও মন খারাপ। ঝুম বৃষ্টি। সকালের ঝিলিমিলি আলোর পরিবর্তে চারপাশ ম্লান আলোতে ছেয়ে আছে। এমন দিনে ইচ্ছে করে বৃষ্টির জলে অবগাহন শেষে ঘরের কোণে বসে যেমন খুশি কবিতা লিখি। হৃদয়ের সারল্য সুখে ভিজি। বৃষ্টির দিনে মন অকারণে কত কথা বলে। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে মন এলোমেলো হয়ে পড়ে। চলতি পথে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পরম আদরে আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি অভিভূত হই। কল্পনায় সৌন্দর্যে বাঁধা জীবন আর বাস্তবের জীবনবোধে বাঁধা জীবন দুটোই যে আলাদা। বৃষ্টি দিনের আকুলতা দূরে ঠেলে দিয়ে কর্মস্থলে ঢুকে পড়ি।
দোকানে ঢুকেই রেজিস্ট্রার ও ডিপোজিট বক্সে গতকালের রেখে যাওয়া টাকা-পয়সার হিসাব দেখছিলাম মনোযোগ দিয়ে। এমন সময় জুতার তীব্র খটখট শব্দে কাচের কাউন্টারের ভেতর থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি হাইহিল পায়ে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে এক কিশোরী দোকানে ঢুকেছে। লক্ষ্য করলাম মেয়েটি থেমে থেমে ফোনে কথা বলছে আর শপিং বাস্কেটে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখছে। বেশ সময় নিয়ে সে তার জিনিসগুলো সংগ্রহ করে আমার সামনে কাউন্টারে এনে রাখল। আমি বাঙালি মেয়েটি বুঝতে না পারলেও তার ইংরেজির সঙ্গে বলা ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমি বুঝেছি, সে বাঙালি। তার কথা থেকে নিশ্চিত হলাম, সে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েটির কথা শুনে সাতসকালে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করে। ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে এসব কী বলছে। লজ্জায়, কষ্টে আমার শরীর অবশ হয়ে পড়েছিল। আমার থেকে কেনা মেয়েটার কিছু জিনিসের ওপর চোখ পড়তে আমি আঁতকে উঠি। অবাক হই। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা বোধ করি। সকালের নরম স্নিগ্ধ এমন সুন্দর আবহাওয়ার মধ্যেও আমি ঘামতে থাকি। কারণ আমারও যে এই মেয়েটির বয়সী একটি কন্যা সন্তান আছে।
মেয়েটির সাজসজ্জা দেখে বিস্মিত হই। চোখে লাগানো নকল আই-ল্যাশ, রংচঙে চুল, বড় বড় নখের দিকে তাকিয়ে থাকি। শরীর, মনের রসায়ন নিয়ে কথা বলা মেয়েটার মুখনিঃসৃত ভাষা চেষ্টা করেও সাদা কাগজের বুকে কালো কালিতে ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না। মেয়েটি আমাকে তার জিনিসপত্রের দাম পরিশোধ করে চলে যায়। আমি তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি আর স্মৃতির মহাসড়কে উঠে হারিয়ে যাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় শৈশবে। যে সময়টি আজও প্রতিটি মুহূর্তে প্রিয় বেলি ফুলের গন্ধ ছড়ায় আমার শিরা উপশিরায়। মনে পড়ে শৈশবের কোনো এক ঈদের দিন হাই হিল পরে ঠক ঠক আওয়াজ তুলে হাঁটার সময় আম্মা কাছে নিয়ে আদর করে বলেছিলেন, এভাবে শব্দ করে হাঁটা অভদ্রতা। তা ছাড়া এমন শব্দ অন্যের বিরক্তির কারণ হতে পারে। মাটির ওপর দিয়ে এভাবে হাঁটলে মাটি কষ্ট পায়। পায়ের নিচে পড়ে কত অসহায় পোকামাকড় মরে। সেদিন থেকে হাই হিল পরে সব সময় চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব কম শব্দ করে আস্তে ধীরে পথ চলতে।
মেয়েটি যখন শরীর, মন, রাগ, অভিমান—এসব নিয়ে কথা বলছিল তখন আমার শুধু মনে পড়ছিল, এমন বৃষ্টির দিনে মেয়েটা কি কখনো তার মায়ের বুকের ওমে নিশ্চিন্তে স্বর্গীয় সুখে ঘুমিয়েছে? আমার শৈশবে বৃষ্টির দিনে মায়ের বুকের ভেতরে কীভাবে হাত-পা গুটিয়ে ঘুমাতাম, তা আমার মনে আছে আজও। মায়ের গায়ের ঘ্রাণে বিভোর হয়ে আরও শক্ত করে মাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতাম। আজ আমার মা বেঁচে নেই। কিন্তু শৈশবে মায়ের গায়ের সে গন্ধ আজও আমার নাকে এসে লাগে। বৃষ্টির দিনে দাদার বড় চাদরের ভেতরে ঢুকে মাটির উনুনের পাশে বসে তাপ নিতাম। দাদা আদর করে কত গল্প শোনাতেন আর নারিকেল, গুড়, মুড়ি মাখিয়ে খাওয়াতেন। জীবনের আকাশে কিংবা মাথার ওপরের আকাশ কালো হয়ে যখন বৃষ্টি নামে দুচোখ বন্ধ করে আমি উষ্ণতা খুঁজি দাদার চাদরে। এমন ঝুম বৃষ্টির দিনে স্পষ্ট শুনতে পাই আম্মা খিচুড়ি, ডিম ভাজি করে খেতে ডাকছেন। আমরা সব ভাই-বোনেরা মায়ের গা ঘেঁষে মাটির উপরে শীতল পাটি বিছিয়ে খাচ্ছি। জীবনের মরুপথ পাড়ি দিতে শৈশবের এই অকৃত্রিম ভালোবাসার সুখানুভূতি আজও আমাকে সাহস জোগায়।
এমন বৃষ্টিভেজা ছুটির দিনে খোলা মাঠে আকাশের দিকে মুখ করে গলা ছেড়ে গান গাওয়ার অদ্ভুত আনন্দের অভিজ্ঞতা মেয়েটির হয়েছে কিনা জানি না! তবে এমন বৃষ্টির দিনে আমার শৈশবের বেশির ভাগ ছুটির দিনগুলো কাটতো মাঠের মাঝখানে। নৌকা চালিয়ে আমি মাঠের মাঝখানে গিয়ে বৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইতাম। কাগজের নৌকা ভাসাতাম। প্রতিটি নৌকা ভাসিয়ে দেওয়ার আগে মনে মনে সুন্দর ইচ্ছে পুষতাম। শাপলা তুলে আনতাম। কিছু শাপলা আম্মাকে দিতাম রান্না করতে, বাকিগুলো সুই, সুতা দিয়ে মালা বানাতাম। সে মালা পুতুলের গলায় পরাতাম। শালুক তুলে খেতাম। আহা! জীবনের বড় বেলায় যখন দিনের পর দিন হাসতে ভুলে যাই, তখন শৈশবের সে অবুঝ দিনগুলোর কথা মনে করে হাসি পায়।
আমার বড় ফুফু তখন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর আম্মার হাতের রান্না করা হাঁসের মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। আম্মা হাঁসের মাংস রান্না করে আমাকে বললেন, বড় ফুফুর বাড়িতে দিয়ে আসতে। প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলাম না। আম্মা সেদিন আমাকে একটা গল্প শোনালেন। যে গল্পের সারকথা, অসুস্থ রোগী দেখতে গেলে সৃষ্টিকর্তা খুশি হন। আম্মার জাদু মাখা গল্প শুনে ছাতা হাতে বৃষ্টির মধ্যে আমি ফুফুর বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়ি। ছোটবেলায় বৃষ্টির পানিতে পিঁপড়াদের ভেসে যেতে দেখে কত কেঁদেছি। তাদের ডাঙায় তুলে শুকনো জায়গায় ছেড়ে দিয়েছি। ভেজা জবুথবু পাখির বাচ্চাদের ঘরে এনে হারিকেনের উত্তাপে রাতভর সেবা করেছি। বাড়ির পোষা কুকুর, হাঁসগুলো ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষায় বসে থেকেছি। আম্মার কাছে শৈশবে প্রথম শিখেছিলাম, ‘জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’। আমার শৈশবে আম্মার থেকে মানবিক শিক্ষাগুলো পেয়েছি। তিনি সময় নিয়ে খুব যত্ন করে আমাকে এই শিক্ষাগুলো দিয়েছেন, যা আমি সব সময় মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি জীবনে।
বৃষ্টি শেষে সবুজ ঘাসের বুকে জমে থাকা বৃষ্টির জলে পা ভিজিয়ে প্রজাপতিদের পেছনে দৌড়ানোর আনন্দ যে কতটা নির্মল, তা শুধু জানে আমার জীবনের শৈশবকাল। এখন চাইলেও সে আনন্দে ডুব দিতে পারি না। তবে শৈশবের সেসব দিনের কথা ভেবে মনে আনন্দ পাই। বৃষ্টির পর প্রকৃতিকে মনে হতো রূপের রানি। আর আমি প্রকৃতির সে রাজ্যে পরি হয়ে চুলে দু বেণি দুলিয়ে পুরো বাড়ি চষে বেড়াতাম। পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম। বৃষ্টির সময় পুকুরের পানির যত গভীরে যাওয়া যায়, তত বেশি পানির উষ্ণতা বেড়ে যায়। শৈশবে পানির এই উষ্ণতাটুকু নিতে বৃষ্টির মধ্যে কত যে পুকুরে পড়ে থেকেছি, তার হিসাব নেই। জীবনের দুরন্ত সে শৈশব হারিয়ে গেলেও মনের দেয়ালে ছবি হয়ে আছে শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো। এসব হাতড়ে সুখ পাই অহর্নিশ।
এই লেখাটি লেখার সময় আমার কিশোরী মেয়েটা কয়েকবার এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে গেছে। কারণে-অকারণে আমার মেয়েটা সব সময় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। বুকের ভেতর লেপ্টে থাকে। বারবার জিজ্ঞেস করে, আমার কিছু লাগবে কিনা? যদি বলি কিছু লাগবে না, তখন এক গ্লাস পানি খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। মেয়েটা সার্বক্ষণিক আমার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। কোথায় যাবে, কতক্ষণ থাকবে, কেন যাবে—সব কাজের ব্যাখ্যা দেয়। তবু আমি ভয়ে থাকি। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠে। আমি জানি চারপাশের পরিবেশ মানুষকে প্রভাবিত করে। কে জানে? আমার সকালবেলার ওই বাঙালি গ্রাহক কিশোরী বয়সের মেয়েটি হয়তো আমার মেয়ের পরিচিত একজন হবে। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে গোটা পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। ছেলেমেয়েদের এত সময় দিয়ে পরে ফলাফল যদি দেখি শূন্য, সে আতঙ্কে নিজের ভেতরে নিজে দুর্বল হয়ে পড়ি।
শৈশব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। শৈশবে বাবা, মা সন্তানের মনে যে বীজ বপন করে, জীবনের বড় বেলায় গিয়ে তেমন ফসল ফলে। বাবা, মা, পরিবার থেকে পাওয়া শৈশবের শিক্ষাগুলো মনের শরীরে কাদামাটির মতন লেপ্টে থাকে। সব বাবা, মায়ের কর্তব্য তাঁদের সন্তানের শৈশবের স্মৃতির ভান্ডার যেন সততা, মানবতা, সরলতা, ন্যায়নিষ্ঠায় পূর্ণ হয়—সেদিকে বেশি বেশি সময় দেওয়া। মানুষ অভ্যাসের দাস। শৈশবে সন্তানের মস্তিষ্কে যেমন চাষাবাদ করবেন বাবা-মা, বড় হয়ে তারা বেশির ভাগ সময়ে তেমন আদর্শ ধারণ করে এবং আমৃত্যু তা ধরে রাখে। ব্যতিক্রম আছে, তবে সেটি খুব কম। শৈশবে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও তাঁদের দেখানো পথ ধরেই মানুষ জীবনের বড় বেলায় পথ চলে। শৈশব-ই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়!