মধ্যবর্তী নির্বাচনে যা কিছু লক্ষণীয়

এবার আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী ও লক্ষণীয় রয়েছে। আট বছর পর ডেমোক্র্যাটদের প্রতিনিধি পরিষদ পুনর্দখল ছাড়াও বেশ কিছু লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে—
১. এবারই প্রথম অনেক বেশি কম বয়সী ভোটারকে ভোট দিতে দেখা গেছে।
২. এবারই প্রথম আগের চেয়ে অনেক বেশি নারী ভোটার ভোট দিতে গেছে।
৩. এবারই প্রথম অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি নারী প্রার্থী ছিলেন।
৪. এবারই প্রথম মুসলিম নারী আমেরিকার কংগ্রেসে প্রার্থী ও জয়ী হয়েছেন।
৫. এবারই প্রথম ‘ওপেন গে অ্যান্ড লেসবিয়ান’ বা সমকামী পুরুষ ও নারী প্রার্থী ছিলেন এবং তারা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর থেকে শুরু করে অন্যান্য পদে প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন।
৬. এবারই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী প্রার্থী হয়েছিলেন এবং তিনি জয়ী হয়েছেন।
৭. এবারই প্রথম কোনো ‘আফ্রিকান আমেরিকান নারী” অঙ্গরাজ্যের গভর্নর হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যেটা কল্পনার বাইরে ছিল। তিনি অল্প ভোটে হেরে গেলেও পরাজয় স্বীকার করেননি। ভোট আবার গণনা করার জন্য ধরনা দিয়েছেন।
8. ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে একটি সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় ১০ লাখ ভোটার আবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেল।
৯. এবারের নির্বাচনে অদ্ভুতভাবে ‘টিট ফর ট্যাট’ টাইপ খেলা হয়ে গেল। ডেমোক্র্যাটরা যেমন অনেক আসন রিপাবলিকানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে, তেমন রিপাবলিকানরাও ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকে কিছু সিনেট আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। প্রথমটার তুলনায় দ্বিতীয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আগেই ছিল, এখন কেবল একটু পাকাপোক্ত হলো। কিন্তু একটা হাউস চলে যাওয়া মানে ঠিক হাত মচকানো নয়, হাতটা পুরো ভেঙে গেল।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের ওপরের লক্ষণীয় এসব বিষয়কে এবার একটু উল্টে–পাল্টে দেখা যাক—
এবারে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম দুজন মুসলিম নারী প্রার্থী জয়ী হয়ে কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন। প্রথম নারীর নাম রাশিদা তালিব। তিনি মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ১৩ নম্বর ডিস্ট্রিক্ট থেকে অপ্রতিদ্বন্দী প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন। তিনি এতই জনপ্রিয় যে, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পাননি। এর আগে তিনি প্রাথমিক বাছাইয়ে নিজ দল ডেমোক্রেটিক পার্টির পাঁচজনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। রাশিদা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, পেশায় আইনজীবী।
অন্যজন হলেন মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের ৫ নম্বর ডিস্ট্রিক্ট থেকে নির্বাচিত ইলহান ওমর। তিনি একজন সোমালীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান মুসলিম নারী যিনি এক সময় স্টেট রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলেন। তিনি ভূতপূর্ব আফ্রিকান আমেরিকান মুসলিম কংগ্রেসম্যান, কিথ এলিসনের স্থলাভিষিক্ত হলেন। তাই তাঁর বিজয় রাশিদার চেয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল।
আরেকটি বিষয় হলো ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে একটি আইন ছিল, যাদের নামে কোন ‘ফেলোনি’ মামলার গন্ধ আছে, তাদের ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হতো। ফ্লোরিডায় প্রায় ১৮ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এই আইনে বেশি ভুক্তভোগী ছিল। সংবিধানের ৪ নম্বর সংশোধনী অনুযায়ী এই আইন তুলে নেওয়ার ফলে প্রায় ১০ লাখ ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেল। এই আন্দোলনের পেছনে তৃণমূল স্তরে অনেক সমর্থন ছিল, যেমন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন, ফ্লোরিডা ফর এ ফেয়ার ডেমোক্রেসি, ফ্রিডম পার্টনার্স ইত্যাদি।
ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ১০ নম্বর কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্টে একনিষ্ঠ এনআরএ সাপোর্টার, রিপাবলিকান বারবারা কমস্টককে হারিয়ে ডেমোক্র্যাট জেনিফার ওয়েক্সটন জিতেছেন। এনআরএর পুরো নাম আমেরিকান রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন। এরা বেশ শক্তিশালী একটা গ্রুপ। আমেরিকায় এত বেশি খুন খারাবির জন্য অতি সহজে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়ার জন্য এরাই প্রধানত দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনেক পয়সা। শক্ত লবির জন্য কেউ তাদের ওপর আঁচড় কাটতে পারেনি। তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত থেকেছে। সেই অবস্থা চিন্তা করলে এই হারাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
* ফ্লোরিডার কি-ওয়েস্ট শহরে প্রথম সমকামী মহিলা টেরি ওয়েস্টন শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে তিনি এই শহরের কমিশনার ছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আরেক নারী প্রার্থী মার্গারেট রোমেরো।
* এই প্রথম একজন সমকামী জ্যারেড পোলিস কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদে জয়ী হয়েছেন। আমেরিকার ইতিহাসে এই নজির প্রথম। তিনি এর আগে কলোরাডো অঙ্গরাজ্য থেকে প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর এজেন্ডাগুলো প্রণিধানযোগ্য। তিনি সর্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিনা পয়সায় শিশুশিক্ষা ও রাজ্যে শতভাগ ‘রিনিউবেল এনার্জি’ প্রবর্তনের পক্ষে কাজ করেন।
* টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে প্রথমবারের মত দুজন ল্যাটিন মহিলা (স্প্যানিশ ভাষী) কংগ্রেসে নির্বাচিত হলেন। প্রথম জন সিলভিয়া গার্সিয়া ২৯ নম্বর কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট থেকে রিপাবলিকান ফিলিপ অ্যারোনফকে পরাজিত করেন। অন্যজন ভেরোনিকা এসকোবার ১৬ নম্বর ডিস্ট্রিক্ট থেকে রিপাবলিকান রিক সিবার্গারকে হারান।
* কানসাস অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট লরা কেলি ট্রাম্প সমর্থিত প্রিয়পাত্র রিপাবলিকান ক্রিস কোব্যাককে হারিয়ে দেন। ক্রিস কোব্যাক আগে সেক্রেটারি অব স্টেট ছিলেন। তিনি ভীষণ দক্ষিণপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী ছিলেন। অন্যপক্ষে কেলি ছিলেন স্টেট সিনেটর। চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর ও গভর্নর ব্রাউনব্যাকের অর্থনৈতিক নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন।
* প্রথম নেটিভ আমেরিকান শেরিস ডেভিডস কানসাসের ৩ নম্বর কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট থেকে আমেরিকান কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনিও একজন সমকামী নারী এবং আগে মার্শাল আর্টস ফাইটার ছিলেন। তিনি রিপাবলিকান কেভিন ইয়োডারকে পরাজিত করেন।
* আরেকজন নেটিভ আমেরিকান নারী ডেব হ্যাল্যান্ড নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ১ নম্বর কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি রিপাবলিকান জ্যানিস আরনন্ড জোনসকে পরাজিত করেন। তিনি পুয়েবলোর লাগুনা ট্রাইবাল গ্রুপের।
* ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ভোটে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াদের ওপর থেকে পক্ষপাতমূলক অত্যাচারী আইনের অবসান ঘটল। পাবলিক প্লেস যেমন রেস্তোরাঁ, হোটেল ও হাসপাতালে তাদের চাকরি করতে আর অসুবিধা থাকবে না। এই আন্দোলনের তারা নাম দিয়েছিল,‘ইয়েস অন নম্বর থ্রি’।
* এবারের নির্বাচনে ২৬২ জন নারী প্রার্থী ছিলেন। ২০১৬ সালে ছিলেন মাত্র ৮১ জন। এদের মধ্যে ৪২ জন গভর্নর বা লে. গভর্নর পদপ্রার্থী, যেটা ২০১৬ সালে ছিল মাত্র ৮ জন। এদের মধ্যে আছেন মা, সংগীত শিল্পী, মিলিটারি কম্ব্যাট ভেটারান ও ফাইটার পাইলট, হিজড়া, সমকামী, বর্ণবাদবিরোধী এমন সব গ্রুপ যারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। এখন পর্যন্ত কংগ্রেসে মাত্র ২০ ভাগ ও সিনেটে ২২ ভাগ নারী সদস্য আছেন। ৫০ জন গভর্নরের মধ্যে মাত্র ছয়জন নারী। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মেধা ও কর্মক্ষমতা পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
কয়েকজন বিশিষ্ট নারী প্রার্থীদের নাম করা যাক, যদিও কারও কারও নাম আগে উল্লেক করা হয়েছে—
১. এম জে হেগার—টেক্সাসের ডেমোক্র্যাটি প্রার্থী। তিনি ভূতপূর্ব মেজর ও এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের পাইলট।
২. স্টেসি অ্যাব্রামস—জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে গভর্নর পদে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী । তিনি বারাক ওবামা, ওপরা উইনফ্রে ও উইল ফারেলের মতো সেলিব্রিটিদের আশীর্বাদ পাওয়া একজন আফ্রিকান আমেরিকান নারী। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, ৮টি নামকরা বই লিখেছেন।
৩. ম্যালোরি হেগান—আলাবামা স্টেট থেকে কংগ্রেস প্রার্থী। তিনি ট্রাম্প সমর্থিত রিপাবলিকান মাইক রজার্সের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তার বয়স মাত্র ২৯ এবং রাজনীতিতে একজন আউটসাইডার।
৪. অ্যালিস গ্যালভিন—ডেমোক্র্যাট সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী, আলাস্কা অঙ্গরাজ্য থেকে রিপাবলিকানের বিপক্ষে প্রার্থী ছিলেন।
৫. ক্রিসটেন সিনেমা—তিনি অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্য থেকে সিনেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যদি জেতেন তিনি হবেন অ্যারিজোনার প্রথম বাই-সেক্সুয়াল নারী সিনেটর। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মার্থা ম্যাক্সালিও একজন নারী। যেই জিতুন, অ্যারিজোনা এবার প্রথম একজন নারী সিনেটর পাচ্ছে।
৬. স্টেফানি রোজ স্পলডিং—কলোরাডো অঙ্গরাজ্য থেকে কংগ্রেসনাল প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান নারী প্রার্থী। তিনি অধ্যাপক ও ধর্মযাজক। এ ছাড়া অত্যাচারিতদের জন্যও অনেক সময় দেন।
৭. এমি ম্যাকগ্রাথ—কেনটাকি অঙ্গরাজ্য থেকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। তিনি প্রথম নারী মেরিন যিনি যুদ্ধের সময় এফ-১৮ ফাইটার বিমান চালিয়েছিলেন। জিতলে তিনি এই অঙ্গরাজ্যের প্রথম নারী কংগ্রেসম্যান হবেন।
৮. লুসি ম্যাকব্যাথ—জর্জিয়া থেকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। তাঁর ছেলেকে একটা গ্যাস স্টেশনের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই থেকে তিনি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১০. মিকি শেরিল—নিউজার্সি অঙ্গরাজ্য থেকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। তিনি ফেডারেল প্রসিকিউটর ও একজন নেভি হেলিকপ্টার পাইলট।