এ কেমন বাড়ি ফেরা!

সামারে বাচ্চাদের নিয়ে দেশে যাচ্ছে সিমু। টানটান উত্তেজনা। বড় ছেলে দশ বছরের, আর ছোটটির বয়স ছয়। ওরা প্রায় সাত বছর পর দেশে যাচ্ছে। সিমুর বিয়ে হয়েছে বারো বছর হলো। বাবার বন্ধুর ছেলে আফতাব, পিএইচডি করছিল তখন ক্যামব্রিজে। বিয়ের এক বছর পর সিমুও চলে আসে লন্ডনে।
আরও এক বছর পর পল্লবের জন্ম হয়। দশ বছর বয়স এখন। ও পড়ে ফাইভে। ছোটটির বয়স ছয়; ওয়ানে পড়ে। কল্লোল নাম ওর। কল্লোল এবারই প্রথম বাংলাদেশ যাচ্ছে। বাংলাদেশে সিমুর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। যদিও ওরা ঢাকায়ই বড় হয়েছে। সিমু ঢাকার বদরুন্নেছা সরকারি কলেজে বাংলায় অনার্স করেছিল। মাস্টার্স করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে যখন ভাবল, তখনই বিয়ে হয়ে গেল।
লন্ডনে বাঙালি কমিউনিটি পরিচালিত একটি স্কুলে সে পড়ায়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় ওর হাজব্যান্ড। ওরা সবাই মিলে যাচ্ছে দেশে; থাকবে দেড় মাস।
সিমুর ছোট ভাই মোহিতের বিয়ে। বিয়ের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। হলুদ, বিয়ে ও বউভাত-সাত দিন, তারপর গ্রামের বাড়িতে চার দিন, তারপর ঢাকায় ফিরে বাবার বাড়ি থাকবে। সিলেটের চা বাগান দেখতে নিয়ে যাবে বাচ্চাদের। আর কক্সবাজারেও যাবে বলে ভাবছে।
প্লেনের বিজনেস ক্লাসে টিকিট কেটেছে আফতাব। ও বলে, যে লং জার্নি। আরাম করে না গেলে সাত দিন রেস্ট নেওয়া লাগবে।
ব্রিটিশ এয়ারলাইনসের বোয়িং উড়োজাহাজ। খাবারও চমৎকার। দেখতে দেখতে থাইল্যান্ড পৌঁছে গেল। আহ আর বেশি না। দুই ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ট্রানজিট। ট্রানজিটের সময়টুকু বোরিং। দেশে ফিরছে। আব্বা-আম্মা, ছোট ভাই-বোন, শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবর-জা; কত আত্মীয়। আর বন্ধুরা তো রয়েছেই—কলেজের হোস্টেলে ওরা এক রুমে ছিল। ইতির বিয়ে হয়ে আলজেরিয়া চলে গেছে, এনি আর আফসানা আছে ঢাকায়, রীনা থাকে যশোরে, শিউলি রাজশাহী, ইভা লন্ডন, আর ঝুনু আমেরিকায়।
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাটি স্পর্শ করল প্লেনটি। রিসিভ করতে এসেছে সিমুর ভাই মোহিত, আর আফতাবের ভাই মেহতাব। মামা ও চাচার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে গেল কল্লোল ও পল্লব দুজনেই। আফতাবদের শংকরের বাসায় পৌঁছে গেল দেখতে দেখতে। বিশাল লিভিং রুম; সবাই অপেক্ষায়। শ্বশুর-শাশুড়ি বাচ্চাদের পেয়ে খুব খুশি। ওদের রুমগুলো খুলে ঝেড়ে মুছে নতুন বিছানার চাদর পেতে রাখা হয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে ওরা খেতে বসল। সিমুর কী যে ভালো লাগছে। সবাইকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। শাশুড়ির পানের থালা থেকে পান খাচ্ছে। সিমু ঘুরে ঘুরে গল্প করছে জা-ননদ সবার সঙ্গে। সবাইকে, সবকিছু তার ভালো লাগছে।
পরদিন পল্টনে মায়ের বাসায় গেল। বিয়েবাড়ি বলে কথা। পুরা বাড়ি ঝলমল করছে। নতুন রং করা হয়েছে। ফার্নিচারও বদল হয়েছে। মা-মেয়ে একদফা কান্নাকাটিও হলো। ভাইয়া-ভাবি, ভাইয়ের ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে কত যে খুশি লাগছে, ওরা আসায় ষোলোকলা পূর্ণ হলো।
সিমু বলে, মোহিতের বিয়ের পর বাচ্চাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবে। গ্রাম দেখবে ছেলেরা। নদী দেখবে, মাছ ধরা দেখবে, নিজেরা ধরবে, গরু-ছাগল দেখবে, হাঁসমুরগি দেখবে। রাতের গাঢ় অন্ধকারে জোনাকির আলো দেখবে। সরিষার ক্ষেতে ভোমরা, আর প্রজাপতি দেখবে। শাপলা-শালুক দেখবে, মৌচাক দেখবে, ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করা দেখবে, পিঠাপুলি খাবে। ফিরে এসে ঢাকায় সব আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবে। অনেক প্ল্যান নিয়ে এসেছি এবার। দেড় মাস থাকব। কলেজের বন্ধু এনি-আফসানা; ওদের সঙ্গেও কথা হয়।
সিমু জানায়, তোমরা কিছু আয়োজন করে রেখো, যেন একসঙ্গে হতে পারি। বন্ধু-বান্ধবীদের ফোন করে বলে দিও। গ্রামের বাড়ি থেকে এসে আমরা তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তখন কোনো রেস্টুরেন্টে বসব একসঙ্গে সবাই সবার পরিবার নিয়ে। চায়নিজ রেস্টুরেন্টই ভালো হবে। সবাই একসঙ্গে বসতে পারব।
বাচ্চারা বিয়ের অনুষ্ঠান হলুদ, মেহেদি, বিয়ে, বউভাত সব অনুষ্ঠানে ওরা সেজেগুজে মামা-মামির সঙ্গে খুব এনজয় করল। দুই বাড়িতেই হলুদ মেহেদি উৎসবে গেল। একদিন হলুদ পাঞ্জাবি পরল ছেলেরা। মেয়েরা হলুদ শাড়ি একদিন। আরেকদিন সবুজ পাঞ্জাবি পরল ছেলেরা, মেয়েরাও পরলো সবুজ শাড়ি।
ভিডিও করা হলো মেয়ের বাড়ির দিক থেকে। মোহিতের বউ মুক্তার বড়বোন জার্মানিতে থাকে; আসতে পারেনি। তার জন্য ভিডিও করা হচ্ছে। আফতাবের ক্যামেরায় ওর ছোট ভাই মেহতাব ছবি তুলছে। ওরা সব জায়গায় সুন্দর করে ছবি তুলছে। সে সময় মোবাইল মানে সেলফোন ছিল না।
বউভাতের পরদিন সিমু ওর শাশুড়িকে বলে, আম্মা আমরা ওই বাসায় যাই আজ। কাল চলে যাব গ্রামের বাড়ি।
-আচ্ছা কয়দিন থাকবে ওখানে।
-চার দিন থেকে চলে আসব।
-ঠিক আছে দুপুরে খাওয়ার পরে যাইও।
দাদা দাদির কোলে উঠে পাপ্পি দিল বাচ্চারা। পল্লব বলে, লাভ ইউ দাদিমা।
-তুমি গ্রামে গিয়ে কী করবা ভাই? থেকে যাও ভাই আমার কাছে।
-আমিত ভিলেজ দেখে চলে আসব দাদু। আমি গরু, ডাক, চিকেন, গোট, ফিস দেখতে চাই।
-ও আচ্ছা দাদু।
-সি ইউ সুন দাদু।
বিকেলবেলা মায়ের বাসায় গেল। নতুন বউসহ মোহিত ফিরানিতে গেছে। রাতে মোহিতের চাচা শ্বশুরের বাসায় দাওয়াত; এলিফ্যান্ট রোডে। দাওয়াত খেয়ে ড্রাইভারকে বলল, আচ্ছা এই অ্যাড্রেসটা কি কাছে?
-জি ম্যাডাম। একদম কাছে।
-তাহলে চল একটু দেখা করে যাই।
এলিফ্যান্ট রোডে আফসানার বাসায় গেল সিমু। বলল, দশ মিনিট বসেই চলে যাব।
আফসানার ছেলে শিশিরের সঙ্গে খুব মিশে গেল কল্লোল আর পল্লব।
-চল চল। আফতাব বলে।
-আজ চল যাই। সিমু বলে। আমরা গ্রাম থেকে ঘুরে এসে এদের নিয়ে অনেক ঘুরব বেড়াব।
সকাল নয়টার দিকে ওরা রওনা দিল। ওরা চারজন ছাড়াও সিমুর ছোট বোন রুমু, ঝুমুও গেল। একদিন পর মোহিত, আর ওর বউও যাবে। আম্মার শরীর একটু খারাপ, তাই আব্বা-আম্মা যেতে পারলেন না।
মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে ওদের দাদাবাড়িতে ঢুকে নস্টালজিক হয়ে পড়ল সিমু। ছেলেবেলার দিন মনে পড়ে। বৃষ্টির মধ্যে কাগজ ভাঁজ করে করে নৌকা বানিয়ে উঠোনে জমা পানিতে ভাসাত তারা। নৌকা দুলে দুলে কিছু দূর গিয়ে আটকে যেত। তখন বুড়ো নুরুচাচা সরু কোদাল দিয়ে নালা বানিয়ে দিতেন। আর তখন নৌকাগুলো দুলে দুলে চলে যেতো। সিমু যেন তার বালিকা বেলায় ফিরে যায়। ওর কাজিনদের সঙ্গে দেখা করে। ছুটে যায় পুকুর ঘাটে। পল্লব-কল্লোলকে একদিনে সব দেখিয়ে দিতে চায়। পল্লব কবুতর, আর তিতির দেখে খুব খুশি হয়।
-মা দিজ আর লুক লাইক পিকক।
-ঠিকই বলেছ।
কবুতরগুলো ধান দিলে হাতের কাছে এসে বাকবাকুম বাকবাকুম করে ধান খাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।
‘অন্ধকারে রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে
আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক।’
-দেখ বাবু এগুলো বক।
-মা আই স, সাম আর ব্ল্যাক। ওইগুলোও কি বক?
-না ওগুলো বাদুড়। ব্যাট।
পদ্মানদীর তীর ধরে ফেরার পথে অস্তগামী সূর্য দেখিয়ে বলে বাচ্চাদের, একটু পরেই জোনাকি দেখতে পাবে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে মিটমিট করে জ্বলতে থাকে জোনাকিরা। হাসনাহেনার ঘ্রাণ ভেসে আসে। হাঁসের মাংস দিয়ে চালের আটার রুটি খেয়ে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন ভোরবেলায় গরু জবাই হয়; খাসি জবাই হয়। মোহিত, আর ওর বউ দুপুরের আগে এসে পৌঁছায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বিলের ধারে মাছ ধরা দেখতে যায় সবাই। আফতাবও খুব এনজয় করে। সিমু বলে, জান এই গ্রামের মাঝিরা পদ্মার ইলিশ ধরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি পড়েছ না? উনি এই গ্রামেরই। এটা কুবের মাঝির গ্রাম।
রাতে টাটকা মাছের ভাজা গরম ধোঁয়া-ওঠা ভাত, হরেক রকমের ভর্তা, সঙ্গে মুগ ডাল। বিখ্যাত সরের দই। বাচ্চারা ফিসফ্রাই, আর দই খেয়ে ঘুমাল।
পরের দিন বিকেলবেলা নৌকাভ্রমণ, আর নদীর ওই পারে থাকা চাচার বড়িতে দাওয়াত। বিকেলবেলা একটা বড় সাইজের ছই লাগানো নৌকায় ঘুরতে বেরোয় সিমু। সঙ্গে আফতাব, মোহিত, মুক্তা, রুমু, ঝুমু, আছিয়াবু, সকিনাবু, ময়না, সাব্বির, আর নৌকার মাঝি ও তার তিনজন সঙ্গী।
ওরা নদীপথে চমৎকার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছাল। খাওয়ার পরপরই রওনা হয়ে গেল। আকাশের এককোণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। রুমুর কোলের কাছে কল্লোল। পল্লব ওর বাবার কাছে। সিমু পাশেই। হঠাৎই ঝড় উঠল। সবাই সাবধান হওয়ার আগেই একটা বাতাসের তাণ্ডবে নৌকা বাঁকা হয়ে গেল। দুই তিনজন পানিতে পড়ে গেল। ঝোড়ো বাতাসে নৌকা ওলট-পালট হয়ে গেল। কে কোনদিকে পড়ল। কিছুই ঠাহর করা গেল না। আফতাব শুধু পল্লবকে ধরে রাখল। অন্ধকারে কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ঝড় বৃষ্টি অন্ধকার। নৌকা ডুবে গেল। সিমু হাবুডুবু খেতে খেতে কল্লোল কই, পল্লব কই, বলছে। চিৎকার চেঁচামেচি হৈ-হুল্লোড়। পাশের নৌকাগুলো সাহায্য করতে এগিয়ে এল।
ঝড় থেমে গেছে। নদীর পানি স্থির। কোনো ঢেউ নেই। হ্যাজাক জ্বালিয়ে জাল ফেলে ফেলে খোঁজা হচ্ছে। আফতাব, সিমু, মোহিত, মুক্তা, রুমু, ঝুমু, আছিয়াবু, সকিনাবু, ময়না, সাব্বির, আর পল্লবকে পাওয়া গেলেও কল্লোলকে পাওয়া গেল না।
রুমু আর কল্লোল প্রথম ধাক্কায় পড়ে যায়। রুমু কল্লোলকে হারিয়ে ফেলে। আকাশ বাতাস কাঁদছে ঝুমু, আর রুমুর সঙ্গে। সিমু বারবার সেন্সলেস হচ্ছে। আফতাবকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সে ছুটে যাচ্ছে পানির দিকে। পুলিশ, ডুবুরি, জেলেদের চেষ্টায় ভোরবেলায় পাওয়া গেল কল্লোলকে। কিন্তু তখন আর তার দেহে প্রাণ নেই। নিথর নির্বাক।
‘না না না, আমার ছেলেকে, আমার বাবুকে আমি ফেলে রেখে যাব না’, আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে সিমু। আল্লা গো আমার মানিক কেন কথা কয় না। ওর কান্নায় চেনা অচেনা সকলেই কেঁদে বুক ভাসায়।
ব্রিটিশ এয়ারলাইনসের বিজনেস ক্লাস। সিমু আর আফতাবের মাঝে পল্লব বসেছে। ওরা আজ কল্লোলকে ছাড়াই লন্ডন ফিরে যাচ্ছে। সিমু আর আফতাব কেঁদে চলেছে অনবরত।