স্মৃতিতে রোকেয়া হল

সবিতা
সবিতা

১৯৯৫ সালের ২৫ মে আমি রোকেয়া হলের ‘নিউ বিল্ডিং’-এর ৮ নম্বর রুমে উঠলাম। নিউ মানে একেবারে নতুন তা নয়, মূল ভবনের পর এটি হয়েছে বলে এ নামেই পরিচিত। এটা একেবারে অফিস সংলগ্ন ভবন, মাত্র দোতলা। তিন খাটের কক্ষ, কক্ষে একজন সিনিয়র আপা থাকেন। নাম রুকসানা, তিনি চারুকলার ছাত্রী। একজন জুনিয়র, নাম হ্যাপি। একটা ড্রেসিং টেবিল, তিনটা ডেস্ক, একটা আলনা। রান্নার জন্য রুমের এক কর্নারে একটা বৈদ্যুতিক হিটার রাখা। একটা শেলফে টুকটাক বাসনপত্র। আমাকে যে বিছানাটা দেওয়া হয়েছে, সেখানে যিনি ছিলেন তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে চলে গেছেন। যাক বাঁচা গেল, ডাবলিং (কারও সঙ্গে বেড শেয়ার) করতে হবে না। কারণ এই ডাবলিংয়ের ভয়ে আমি হলে উঠতাম না। অপেক্ষা করেছি বহুদিন। প্রাথমিক অবস্থায় ম্যাডামেরা বলতেন, সিঙ্গেল সিট নেই। এখন রুমমেটদের সঙ্গে ডাবলিং করতে হবে। এটা আমাকে রীতিমতো কষ্ট দিত। চিনি না, জানি না, এমন কোন মেয়ের সঙ্গে বিছানা ভাগাভাগি করব! আমি প্রাইভেট হোস্টেলে বা আত্মীয়ের বাসায় থেকেছি। কিন্তু শেষে গেলাম, যখন বললেন তিনি চলে যাবেন। আসলে প্রথম অবস্থায় এ রকমই ইস্যু করা হয়, কিন্তু রুম গেলে তাদের কোন বন্ধুর রুমে চলে যায় পুরো বিছানা ছেড়ে দিয়ে।
প্রথম দিন গিয়ে দেখি রুমমেটরা (কক্ষের অন্য বাসিন্দারা) কেউ নেই। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে, রুম পরিষ্কার করে যখন ফ্রেশ হয়ে এসেছি, ততক্ষণে বেলা প্রায় তিনটা বেজে গেছে। হলের ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখি কেউ নেই, কোন খাবার তো নেইই। এদিকে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীটা খেয়ে ফেলব। ক্যানটিনে গিয়ে দেখি সেখানেও জনমানব নেই। আসলে দুটা থেকে আড়াইটার মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়। পরে রুমে এসে ড্রেস পাল্টে বাইরে রওনা দিলাম। আমি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে একদিন নীরবে খেলেও এখান থেকে রাস্তা ঠিক চিনি না। তবু রওনা দিলাম টিএসসি বাম দিকে ফেলে যে রাস্তা ডিএমসির পাশ দিয়ে চলে গেছে সে দিকে। প্রচণ্ড রোদ, রিকশাও নেই। ডিএমসির গেটের সামনে এসে খালি রিকশা পেলাম। সেখানে হলের একটি মেয়েকে দেখলাম, তাকে সকালে কয়েকবার বারান্দায় দেখেছি। নিজেই কথা বলে জেনে নিলাম নীরবের ঠিকানা। আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, ওই রিকশাওয়ালার সঙ্গে যান। মানে যে মেয়েটি ঠিকানা বলে দিয়েছে তার রিকশার সঙ্গে। সেও শুনেছি, বলেছে ‘নীরবে চলেন’। আমি মনে মনে নীরবে নীরবের ভর্তা, ভাজি এসব দিয়ে পেট ভরে ভাত খাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ফার্মগেটের অন্বেষা হোস্টেল ছেড়ে সেই সকাল থেকে কাজই করছি। যাক দুটি রিকশায় এসে থামল ডিএমসির পেছনের এক রাস্তা সংলগ্ন নীরব রেস্তোরাঁয়। ওদের অনুসরণ করে ওপরে উঠে দেখি নীরব তো নীরব নয়, একেবারে সরব। মানুষ গম গম করছে। কোন টেবিল খালি নেই। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পরে চারজনের একটা টেবিল খালি হলে ওরা দুজন বসল। মেয়েটা হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? বললাম, না। হলের খাবার শেষ তাই এসেছি। সে কিছুটা জোর করেই বসাল পাশে। তার সামনের সিটে একটা ছেলে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম আমাদের ইয়ারমেট তারা, শুধু বিভাগ আলাদা। এই দুজন আর কেউ নয়, পরে আমার প্রিয় বন্ধু ইসরাত আর রাশেদ। ভালো বন্ধুত্ব হঠাৎ করেই হয়। এটা ছিল ইস্কুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। সম্ভবত ওরা সে দিন আমাকে আর আলাদা বিল দিতেই দেয়নি। সে ছিল নিউ বিল্ডিংয়ের ১ নম্বর রুমে।
রাতে যখন খেয়ে হলের বাথরুমে ব্রাশ করতে গেলাম, তখন ছোটখাটো মিষ্টি একটা মেয়ে কথা বলে পরিচিত হলো। সেও ১ নম্বর রুমের বাসিন্দা। নাম জয়ন্তী, সবাই জয় বলে ডাকে। সে আবার রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের আরেক নেত্রী। পপি আপার সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক কাজে থাকে। কীভাবে কীভাবে জানি, এদের দুজনের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। আস্তে আস্তে রাতের খাবার নিজের রুমে না খেয়ে এদের সঙ্গে খেতে শুরু করলাম। এই জয় ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ নেত্রী। আমাকে নিয়ে যেত মিছিলে স্লোগান দেওয়ার জন্য। আমি হলের বাইরে যেতাম না, তবে ভেতরে ঠিক ওদের সঙ্গে গলা মেলাতাম। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান যে আত্মা স্পর্শ করতে পারে, তা আমি এ মিছিলে গিয়েই বুঝেছি।
তারপর একদিন জয় বলে গেল, শেফালি নামে ৪ নম্বরের একটা মেয়ে আসবে। ওকে যেন ওর রুম থেকে খাবার খেতে বলি। আমি বললে সেই মেয়ে এমন ভাব নিয়ে তাকাল যে, বোঝাই যাচ্ছে আমার আগমন তার পছন্দ হয়নি। সে বলেছে একদিন, ‘আমি শুধু ভাবলাম দুদিন হয় না, কে এই মেয়ে যে এত অল্প সময়ে জয়ের পেটের ভেতর ঢুকে গেল?’ শত্রুর মতো তাকানো এই মেয়েও একদিন আমার খুব প্রিয় বন্ধু হয়ে গেল। সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কাজ করে।
আমরা এই তিনজন বা চারজন এক সঙ্গে কখনো মধুর ক্যানটিনে, কখনো নীরবে, টিএসসির ফুটপাথের টি-স্টলে বা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আইবিএর ক্যানটিনে গোশত-পরোটা খেতে যেতাম। তারপর থেকে কে, কবে কীভাবে প্রিয় হয়ে উঠেছিলাম, ঠিক বলতে পারব না। জয় ছিল গণিতের ছাত্রী। আমি যদি সব পিন পিন বর্ণনা করতে যাই, তাও সব শেষ হবে না সহজে। জয় মাঝেমধ্যে রুমে রান্না করত, বিশেষভাবে মনে আছে তার রান্না করা ডালের সঙ্গে পেঁপে দিয়ে রান্না করা তরকারি। নিরামিষ যে এত স্বাদের হয়, আমার জানা ছিল না। আর ভর্তার জন্য ইস্কু হলো দক্ষ। লাল মরিচ দিয়ে আলু ভর্তা বানাতো সুন্দর করে। আমাদের অনেক রাত কেটে যেতো চা খেয়ে, কার্ড খেলে আর আড্ডা দিয়ে। ওরা অবশ্য আমার হাতের চা খুব পছন্দ করত। আমি ডানোর গুঁড়ো দুধ দিয়ে তখনো চা খেতাম। আমরা চারজন চার দিকে চলে গেছি জীবনের তাগিদে, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা এখনো তেমন আছে।
হলের মাঠে বেগম রোকেয়ার শ্বেতমূর্তির নিচে পূর্ণিমা রাতে বসতো আমাদের আড্ডা। ঠিক যেখানটায় সবিতা বসে আছে। জয় খুব সুন্দর করে রবীন্দ্র সংগীত গাইত, ওর কণ্ঠে ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা/কহো কানে কানে, শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা’ গানটা শুনলেই কেন জানি না চোখ ভিজে উঠত। তখন আমাদের তেমন কোনো দুঃখবোধ ছিল না, তবে বছর তিনেক আগে আব্বা-আম্মাকে হারানোর কষ্ট, না থাকার অভাববোধ কষ্ট দিত। হয়তো সে জন্যই চোখে পানি আসত। নতুবা অল্পবিস্তর আনন্দেরই ছিল সে জীবন।
ইস্কু আর আমিও মাঝে মাঝে এখানে এসে বসতাম। ওর যখন রাশেদের সঙ্গে মান অভিমান হতো বা আমারও কোন কারণে প্রেমিক প্রবরের সঙ্গে অমাবস্যা চলতো, রাতে এসে এখানে বসতাম। বেগম রোকেয়ার নীরব মূর্তি মেয়েদের সুখ দুঃখের এক নীরব সাক্ষী। সামনের মাঠ থেকে ধূধূ বাতাস বইতো, আকাশ থেকে চাঁদের আলো এখানে বসার পর দুঃখ যেন কোথায় মুছে যেতো।
আজ অনেক দিন পর হলেরই এক ছোট বোন সবিতার ছবি দেখে স্মৃতিগুলো কেমন ভেসে উঠল। ও ছিল মূল ভবনের ৪৭ নম্বর রুমে। তার অবশ্য দীর্ঘ জীবন হলে কেটেছে। পরে এমএড ও এমফিল করেছে। এখনো হলের কাছাকাছি আছে। উদয়ন স্কুলের শিক্ষিকা।
গত ২ নভেম্বর হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পঞ্চম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান ‘আনন্দ ধারা’। যেখানে বহু বছর আগের অতি যৌবনা রমণীরা, জীবনের ক্রান্তিলগ্নে ফিরে ফিরে আসেন শুধু স্মৃতির পাখায় ডানা মেলে, সেই পুরোনো দিনে। দিন চলে গেছে শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে, এ স্মৃতি যে বড় মূল্যবান! সবাই ছুটে আসেন পুরোনো দিনগুলোর কথা জীবন্ত করে তুলতে। আমি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য। একবারই অংশ নিতে পেরেছি। এ বছর অনেক জুনিয়র–সিনিয়রের মেয়েদের ছবি দেখলাম। সবাই কেমন আনন্দে আত্মহারা।
যাক সময়ে সময়ে অনেক হলের জন্ম হবে, এ বিশ্ববিদ্যালয়র ছাত্রীসংখ্যা বাড়বে, কিন্তু রোকেয়া হল রোকেয়া হলই থাকবে। অনেকটা পরিবারের সব বড় বোনের মতো। আমি গর্বিত যে আমি এই হলে যাপন করেছি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর দিনগুলো। পথ চলতে পেয়েছি কিছু অকৃত্রিম বন্ধু, জুনিয়র, সিনিয়র। শিক্ষাঙ্গনের মধুর স্মৃতি মানেই বন্ধুরা, রুম মেটরা। আজ দূর থেকে তাদের কথা মনে হচ্ছে বারবার। হল নিয়ে লিখতে গেলে সীমিত শব্দে হবে না। লিখতে হবে অনেক কিছু, অনেকের কথা। আজ আমরা সবাই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছি দেশ-বিদেশে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিগুলো এখনো জীবন্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের আবারও বেঁধেছে অদৃশ্য ডোরে, তাই কেউই আমরা তেমন দূরে নয়।