স্টপ নাউ

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর। এ বি সি নিউজে দেখলাম, পিটসবার্গের এক বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে এক নারীর চিৎকার, ‘আমাদের এলাকায় তুমি এসো না। দুঃখিত, তোমাকে স্বাগত জানাতে পারছি না।’ এদিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পিটসবার্গ সিনাগগ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে পিটসবার্গের ইহুদি সম্প্রদায় দুভাগ হয়ে যায়। এক অংশ তাঁর সফরের বিরোধিতা করছিলেন। কারণ, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হোতা একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং ট্রাম্পের অনুরক্ত। ট্রাম্পের সফরের বিরোধীরা ওই দিন বিরাট বিক্ষোভেরও আয়োজন করেন। ‘ওয়ার্ডস ম্যাটার্স’ প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছিল মিছিলে। ইহুদি নেতৃবৃন্দ এ সময়ে ট্রাম্পকে ওখানে না যেতে বারণ করছিলেন। কিন্তু পিটসবার্গের ইহুদি উপাসনালয়ের রাব্বি ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান না করায় তিনি সস্ত্রীক সফরে যান। সঙ্গে যান ইহুদি জামাতা কুশনার ও ধর্মান্তরিত মেয়ে ইভাংকা।
ওই সপ্তাহটি ছিল আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনাবহুল। ডাকযোগে একে একে পাইপ বোমা গেছে ক্লিনটন-ওবামাসহ ডেমোক্র্যাট নেতাদের ঠিকানায়। পাইপ বোমা পাঠানো হয়েছে সিএনএনে, ট্রাম্পের সমালোচকদের নামে। চাঞ্চল্যকর, লোমহর্ষক প্রতিটি মুহূর্ত। অবশেষে ফ্লোরিডায় ধরা পড়ল সন্দেহভাজন সেই পাইপ বোমা পাঠানো ব্যক্তি। বেতারে শুনলাম, ওই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন। সিএনএনে দেখলাম, ট্রাম্পের সভায় ওই ব্যক্তিটি ‘বয়কট সিএনএন’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপরেই ঘটল পিটসবার্গের ইহুদি উপাসনালয়ে মর্মান্তিক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। খুনি রবার্ট বাওয়ারস। ট্রাম্প বললেন, ম্যাড ম্যান (পাগলাটে লোক)। আরও বললেন, সশস্ত্র পাহারাদার থাকলে উপাসনালয়ে এ ঘটনা ঘটতো না। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া হয়। তাহলে স্কুল, চার্চ, গ্রোসারি—সব জায়গায় কি সশস্ত্র পাহারাদার বসাতে হবে?
পিটসবার্গের ঘটনায় পুরো আমেরিকা স্তম্ভিত। সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়ার ভাষ্যমতে, বিশ্বে ইহুদিদের সবচেয়ে নিরাপদ বসবাস ইসরায়েল ও আমেরিকায়। সেই আমেরিকায় এ বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এক হয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করলেন, নিন্দা জানালেন এবং নিহত ব্যক্তিদর আত্মার শান্তি কামনা করলেন।
এরপর ধীরে ধীরে বের হতে লাগল পরিসংখ্যান। ট্রাম্পের শাসনামলে হেইট ক্রাইম (ঘৃণাপ্রসুত অপরাধ) বেড়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সালে এসে বেড়েছে ২৮ শতাংশ। বেড়েছে অ্যান্টি– সেমিটিজম বা ইহুদিবাদ বিদ্বেষী ঘটনা। বর্ণবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তৎপরতা ও দাপট দুটিই বেড়েছে। ‘কে কে কে’ নামাঙ্কিত টি-শার্ট পরা একজনকে ট্রাম্পের সভায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল টেলিভিশনে।
ট্রাম্প নিজেকে পরিচয় দেন ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তাবাদী হিসেবে। বলেন, ‘আমি গ্লোবাল নয়, ন্যাশনালিস্ট। কারণ আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমার কাছে আমার দেশই প্রথম।’ তাঁর এই জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। এ জন্য ট্রাম্পের মত তারাও আমেরিকার উগ্র জাতীয়তাবাদী। ট্রাম্পের মত তারাও আমেরিকামুখী হন্ডুরাসের শরণার্থী স্রোতকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে। ট্রাম্প ইতিমধ্যে সেই ‘আগ্রাসন’ রুখতে সীমান্তে সৈন্য পাঠিয়েছেন। তাঁর পক্ষের গণমাধ্যমগুলো ‘আগ্রাসন’, ‘আগ্রাসন’ আওয়াজ তুলে হইচই ফেলে দিয়েছে। ওই শরণার্থীর স্রোতে ট্রাম্প সন্ত্রাসী খুঁজে পেয়েছেন। যদিও প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, এর কোনো প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।
ট্রাম্পের এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে আমেরিকার সামনে যে ওলট–পালট হয়ে যাচ্ছে, তার খবর কি তিনি রাখেন? তিনি কি জানেন, ভবিষ্যতের হুমকি মুসলিম নয়, উগ্র শ্বেতাঙ্গ মানুষ! সর্বশেষ তিনি এ দেশে জন্ম নেওয়া অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব না দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা করতে চাচ্ছেন নির্বাহী আদেশে। অবশ্য স্পিকার ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট এটি করতে পারবেন না। এ জন্য দরকার সংবিধান সংশোধন।
একজন বিশেষজ্ঞের মতে, আমেরিকার অর্থনীতি ভালো। তাই ট্রাম্পের এসব ‘পাগলামি’ পার পেয়ে যাচ্ছে। যদি কখনো অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে আমেরিকা, তখন যে অরাজকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে তা কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ হবে। তাই এখনই প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজন, এই ‘বিদ্বেষ ছড়ানোর আন্দোলন’ বন্ধের। এবিসি নিউজের ওই নারীর মত আমারও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে - ‘স্টপ নাও’ ।
অবশ্য ট্রাম্পকে বলা হয়েছিল, এবার গলার স্বর একটু নামান। উল্টো তিনি বললেন, না। আমার আর রিপাবলিকানদের ওপর অবিচার হচ্ছে। নামাব না, বরং উচ্চকণ্ঠ হব। যোগ করলেন আরও, গণমাধ্যম, এই গণমাধ্যমই হচ্ছে জনগণের এক নম্বর শত্রু। এরাই জাতিকে বিভক্ত করছে।
এই অপরিণামদর্শী খেলার শেষ কোথায়, জানি না। শুধু প্রার্থনা করি, ঘৃণার বদলে আসুক ভালোবাসা। মানবতার জায়গা হোক সবার ওপরে।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক