সময়-কারিগরের খোলা গল্প

‘আইগ্লাস’ চোখে, খোলা হাতঘড়িতে গভীর মনোযোগে একাধারে কাজ করে চলেছেন একজন সময়-কারিগর মানে ঘড়ি-মিস্ত্রি। গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি, মাথায় সাদা চুল। মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। বয়স ৭৩-এর কাছাকাছি। ৫৬ বছর ধরে একই কাজ করছেন। পাশের টেবিলে একই কাজে ব্যস্ত তাঁর আরেক ভাই; চার বছরের ছোট। তবে দুজনই আর আগের মতো ব্যস্ত নন। এখন দিন বদলেছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে মানুষ হাতঘড়ি পরা ছেড়েছে। চাবি দেওয়া ঘড়ির বদলে ব্যাটারিওয়ালা ঘড়ি এসেছে। অ্যালার্ম দেওয়া টেবিল ঘড়ির এখন আর দরকার হয় না। মোবাইলের ঘড়িই অ্যালার্ম দেয়। বাড়িতে বাড়িতে দেয়াল ঘড়ি টাঙানোর রীতি পাল্টেছে। ঘড়ি সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। এখন ঘড়ি নষ্ট হলে তা আর মেরামত না করে মানুষ নতুন ঘড়ি কিনে ফেলে বলে জানিয়েছিলেন মফস্বল শহরের এক বয়স্ক সময়-কারিগর। সেই পুরোনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই কখনো না ঘুমানো শহর নিউইয়র্কে আবিষ্কার হলো আরও একজন সময়ের কারিগর, যার নাম মার্ভিন স্নাইডার (৭৯)। তিনিও ঘড়ি সারাই করেন, ঝাড়-মোছ করে রাখেন পুরো বছরজুড়ে। তবে সেই ঘড়ি কিন্তু হাতঘড়ি নয়; কিংবা নয় কারও বাসার টেবিল ঘড়ি। তিনি সারিয়ে তোলেন নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন ৫৫টি উঁচু ভবনে স্থাপিত ঘড়ি। তাঁর দাপ্তরিক পদবি হলো ‘ক্লক মাস্টার’; যার মূল কাজ ঘড়ি সারাই।
মজার ব্যাপার হলো মার্ভিন কিন্তু কোনোকালেই ঘড়ি মিস্ত্রি ছিলেন না। ১৯৮০ সালে তিনি কাজ করতেন নগর ভবনের প্রশাসনিক বিভাগে। টুকটাক গাড়ি সারাই করবার অভিজ্ঞতা ছিল বটে। ঘড়ি সারাইয়ের কাজ করতে হবে তা স্বপ্নেও চিন্তা করেননি। তবে হ্যাঁ ছোটবেলায় নিজের হাতঘড়ি কয়েকবার নষ্ট হওয়ায় তাঁকে প্রায় নিয়মিত যেতে হয়েছিল ঘড়ি মিস্ত্রির কাছে। পরিণত বয়সে অফিসে যাওয়ার পথে লোয়ার ম্যানহাটনের ৩৪৬ ব্রডওয়ের ওয়ার্থ স্ট্রিটে এক নগর ভবনের চূড়ায় চারমুখো টাওয়ার ঘড়িটি দেখতেন। ১৯৭০ সাল থেকে অচল ছিল ঘড়িটি, যা মার্ভিন স্নাইডারকে বেশ পীড়া দিত। নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক দেন-দরবার করে মার্ভিন তাঁর এক সহযোগী এরিক রেইনারকে নিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের ছুটির সময় শুরু করলেন সেই ঘড়ি মেরামতের কাজ। যদিও এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না স্নাইডারের। কিন্তু বিস্ময়করভাবে স্নাইডার ও এরিক অচল সেই চারমুখো ঘড়িটি মেরামত করে চালু করে দিলেন। তখন ১৯৯২ সাল। তৎকালীন মেয়র ডেভিড এন ডিনকিন্স মার্ভিন স্নাইডারকে নগরের ক্লক মাস্টার পদে নিযুক্ত করেন, যা শূন্য ছিল ১৮০০ সাল থেকে।
নগরীর অধিকাংশ উঁচু ভবনের টাওয়ার ঘড়িগুলোর তৈরির সময়ে লাগানো কলকবজা এখনো সচল। কিছু কিছু টাওয়ার ঘড়ি এখন বিদ্যুৎ চালিত। তবে অধিকাংশ ঘড়ি আজও হস্তচালিত। স্নাইডারের হাতে ঘড়ি রক্ষণাবেক্ষণের তালিকায় রয়েছে স্ট্যাটান আইল্যান্ডের বরো হাউস থেকে শুরু করে পুরোনো হার্লেমের ১২১ স্ট্রিটের কোর্ট হাউস, লোয়ার ম্যানহাটন ব্রডওয়ের সাবেক সান বিল্ডিংসহ হ্যারল্ড স্কোয়ার্ডের ‘বেল রিংগার্স মনুমেন্ট ক্লক’ পর্যন্ত।
একবার হ্যারল্ড স্কোয়ার্ডের টাওয়ার ঘড়িটি সামান্য ত্রুটির কারণে সারাক্ষণ বাজত। স্নাইডার যখন ত্রুটি সারিয়ে নিচে নেমে এলেন, একদল গৃহহীন লোক তাকে ঘিরে উল্লাস করতে থাকল। তাদের একজন বলল, ‘ধন্যবাদ খোদাকে। গত দুদিন যাবৎ আমরা ঘুমাতে পারছি না। ধন্যবাদ তোমাকেও সময়মতো ঘড়িটি মেরামত করার জন্য।’
গত বিশ বছর ধরে এ সব টাওয়ার ঘড়ির সঙ্গে পূর্বতন অনেক নগর মেয়রের নানা স্মৃতি জড়িত। কিন্তু ঘড়িগুলো বন্ধ হয়ে থাকায় এই স্মৃতি যেন ম্লান হয়ে আসছিল। মেয়র ডিকিন্সের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের মধ্যে শত বছরের পুরোনো ঘড়িগুলো সচলে গৃহীত পদক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরে মেয়র জুলিয়ানি ও ব্লুমবার্গও সচেষ্ট ছিলেন এসব আইকন যেন ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়। তবে ব্লুমবার্গের অভিযোগ ছিল তাঁর ভবনের ঘড়িটি নিয়ে। কারণ তাঁর কম্পিউটারের সময়ের সঙ্গে ওই ঘড়ির সময়ের হেরফের ছিল ১৫ সেকেন্ড।
তবে সত্যিকারের বড় রকমের সময়ের হেরফের হয়ে যায় ব্লাজিওর সময়কালে। তখন সিটি হলের ঘড়িতে প্রদর্শিত সময় কয়েক মিনিট হেরফের দেখা যায়। অবাঞ্ছিত এসব ঘটনার জন্য দায়ী পুরোনো যন্ত্রাংশ ও বিরূপ আবহাওয়া। এই ত্রুটিও সারাই করেন স্নাইডার। তাও দ্রুততম সময়ে। স্নাইডার জানান, যথাসম্ভব কম সময়ে সমস্যা সারাতে পেরেছি শুধুমাত্র দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে। কখনো কোনো পুরোনো ঘড়ির ক্ষয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশ যেমন লিভার, চেইন, অথবা পিতলের তৈরি সময় নির্দেশক কাঁটা ইত্যাদির জরুরি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। তখন নগর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি এগিয়ে আসেন পাবলিক আর্ট ফর মিউনিসিপ্যাল আর্ট সোসাইটির সভাপতি পিলিজ কোহেন। টাওয়ার ঘড়িগুলোর পরিবর্তন বা মেরামতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় পাশাপাশি থাকেন এই নগরবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
স্নাইডারের মতে ঘড়ি মেরামতের এ কাজটি এখন প্রায় ‘মৃত শিল্প’। অল্পসংখ্যক মানুষ এখন এই শিল্প জানে-বোঝে। তাদের হাতেই রয়েছে নগরের ৫৫টি ভবনের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের এই কঠিন দায়িত্ব। পুরো বছরের রক্ষণাবেক্ষণের তালিকায় রয়েছে সময় মেলানো, পুরোনো পার্টস বদলে দেওয়া, ঘষা-মাজা ও সব যন্ত্রাংশে প্রচুর তেল দিয়ে সচল রাখা। বর্তমানে স্নাইডারের বড় সন্তুষ্টি হলো মাসে ১০ সেকেন্ড সময়ের হেরফের মেনে নিয়েছেন মেয়র ডি ব্লাজিও। তাঁর দৃষ্টিতে, ‘এটা মেনে নেওয়ার মতো সংগত সময়ের হেরফের।’
নিউইয়র্কে বছরে দুবার সময় পরিবর্তন হয় দিনের আলো বাঁচাতে, যার একটি করা হয় শরৎকালে সময় এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে; অন্যটি বসন্তে এক ঘণ্টা এগিয়ে এনে। সেই সময়ে নির্ধারিত তারিখের মার্ভিন স্নাইডার ও তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোগী ৬৮ বছর বয়সী ফরেস্ট মার্কউইজ যখন মধ্যরাতে সিটি হলে প্রবেশ করেন, তখন সেখানে কর্তব্যরত নিরাপত্তা প্রহরীরা কখনো তাঁদের কাছে পরিচয়পত্র চান না। কারণ তাঁরা জানেন, এরা এসেছেন সময় বদলে দিতে। কিছুক্ষণ পরই সিটি হলের চারমুখো টাওয়ার ঘড়ির সময় এক ঘণ্টা পিছিয়ে যাবে, ১২টার বদলে শোনা যাবে ১১টার ডিংডং ঘণ্টাধ্বনি। এই চলে আসছে বহু বছর ধরে। বছরে দুবার অবধারিতভাবে সময় বদলে দেওয়া স্নাইডার শুধু ঘড়ি মিস্ত্রি নন তাই। নিশ্চিতভাবেই তাঁরা সময়-কারিগর।