বাংলাদেশি আলাদ্দিন উল্লাহর 'ডিশওয়াশার ড্রিমস' মঞ্চায়ন

শিল্প, কল্পনা, পরিবার, ইয়াঙ্কি ও আমেরিকান স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আলাদ্দিন উল্লাহর এক দারুণ কৌতুকপূর্ণ একক স্ট্যান্ডআপ কমেডি পরিবেশনা ‘ডিশওয়াশার ড্রিমস’ মঞ্চস্থ হচ্ছে ম্যানহাটনের ৪২ নম্বর স্ট্রিটের ক্যাস্টিলো থিয়েটারে। আলাদ্দিন উল্লাহর কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম আদনান সৈয়দের কাছে। প্রথম আলোয় হাসান ফেরদৌসের লেখা থেকেও জেনেছিলাম তাঁর সম্পর্কে। তাই আলাদ্দিন উল্লাহর শো হবে এই খবর পেয়ে তা দেখার আগ্রহ অনুভব করলাম। সেই ভাবনা থেকেই আমি এবং অধুনা কানেকটিকাট রাজ্যবাসী বাংলাদেশের কিশোর সাহিত্যের লেখক আমার বন্ধু নসরত শাহ গিয়েছিলাম অফ অফ ব্রডওয়ের ওই শো দেখতে।

যে পরিবেশনাটি দেখলাম তাতে আমরা দুজন ছাড়া কোনো বাঙালি দর্শক ছিল না। অথচ আলাদ্দিন উল্লাহর একক সংলাপে বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা এক আমেরিকাবাসীর আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মজিজ্ঞাসা, আমেরিকান স্বপ্নের সঙ্গে বাঙালি সত্তার টানাপোড়েন নিয়ে আমেরিকাবাসের বাস্তবতা ও আমেরিকার স্বপ্নের সহাবস্থানের কথা। আলাদ্দিন উল্লাহ যখন সংলাপ আউড়ে যাচ্ছিলেন তখন দর্শকেরা সজোরে হেসে উঠছিলেন তাঁর সূক্ষ্ম ব্যঙ্গাত্মক পরিচর্যায় সাড়া দিয়ে। একজন বাংলাদেশি হাবিবুল্লাহর কথা শুনে তাঁরা কীভাবে এমন জোরে জোরে হেসে উঠছেন তা নিয়ে একটু ভাবলাম। আমরা যে ধারণা করি বাংলাদেশি জনসমাজের কথা আমেরিকাবাসী অন্যদের জীবনানুভূতিকে স্পর্শ করার কথা নয়, এমনটি ভাবা যে সংগত নয় তার দৃষ্টান্ত আলাদ্দিন উল্লাহর ‘ডিশ ওয়াশার ড্রিমস’! একটা সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অন্য একটা সংস্কৃতির মর্মে পৌঁছাতে পারলে যে তা দর্শকদের কাছে সমাদরণীয় হবে তারও একটা উদাহরণ আলাদিন উল্লাহর এই একক স্ট্যান্ডআপ কমেডি।

কেন অন্য সংস্কৃতির দর্শকেরা সাড়া দিচ্ছিলেন এ প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছে। স্ট্যান্ডআপ কমেডি কথাটি শুনলে মনে হতে পারে বেশ কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসানোর ব্যাপার। বিষয়টি মোটেও তা নয়। তাঁর আত্মকথন বর্ণনায়, সংলাপ উচ্চারণে এমন একটা মুনশিয়ানা আছে যা নিউইয়র্কবাসীর গভীর সাংস্কৃতিক মনোজগৎ উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। আলাদ্দিন উল্লাহর সঙ্গে সময়-সময় নিপুণতার সঙ্গে তবলাধ্বনির ভাবগত ঐক্য স্থাপন করছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত গায়ানার শিল্পী অভিরোধ শর্মা। এ রকম একটি পরিবেশনার আকর্ষণী সামর্থ্যের পেছনে নির্দেশক নেপথ্যচারী গ্যাব্রিয়েল ভেগা ওয়েইসম্যানের উপস্থিতি আমরা টের পাই। সমগ্র পরিবেশনা উপভোগ করতে গিয়ে আমার উপলব্ধি হলো একটি সফল মঞ্চ অনুষ্ঠানের জন্য পরিশীলিত দর্শকের উপস্থিতি কতটা বাঞ্ছনীয়। কারণ প্রদর্শনী শুরুর আগে দর্শকেরা নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন মন সংযোগের। ফলে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলা প্রদর্শনীটি উপভোগে দর্শকেরা যেন পরিবেশনার অংশ হয়ে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে থিয়েটারের ভুবনে স্ট্যান্ডআপ কমেডির অভিজ্ঞতা নেই। যদিও সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে ‘মিরাক্কেল’ অনুষ্ঠানের দর্শকেরা যে পরিবেশনা দেখে থাকেন তাতে স্ট্যান্ডআপ কমেডির স্বাদ পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের মঞ্চে স্ট্যান্ডআপ কমেডি খুব প্রচলিত ও দর্শকনন্দিত। এখানে কমেডি ক্লাব আছে। টেলিভিশনে কমেডি শো হয়, যাতে স্ট্যান্ডআপ কমেডির বেশ বড় স্থান রয়েছে। স্ট্যান্ডআপ কমেডির দর্শকেরাও পরিশীলিত মানসিকতা নিয়ে যুক্ত থাকেন এর সঙ্গে।

থিয়েটারীয় এই আঙ্গিকের সঙ্গে বাংলাদেশের কথকতার খানিকটা মিল আছে। কথকতাকে ভিত্তি করে বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আল দীন ‘কথানাট্য’ নামে যে আঙ্গিক উদ্ভাবন করেছেন এর সঙ্গে মিল আরও একটু বেশিই পাওয়া যাবে। সেলিম আল দীনের কথানাট্য পরিবেশনের সময় বৈচিত্র্যপূর্ণ মঞ্চসজ্জা ও আলোকসজ্জা থাকে। কারণ এর উপস্থাপনায় নির্দেশক একটি পরিপূর্ণ থিয়েটার-আঙ্গিকই উপস্থাপন করতে চান। স্ট্যান্ডআপ কমেডিতে থাকে সূক্ষ্ম কৌতুক। সংলাপের তির্যকতা ধরতে হলে দর্শককেও থাকতে হয় উৎকর্ণ হয়ে। অভিনেতার বক্তব্যের খোঁচা অমনোযোগ হেতু ফসকে গেলে দর্শক রস থেকে বঞ্চিত হবেন। স্ট্যান্ডআপ কমেডি পরিবেশনের জন্য মঞ্চসজ্জাকে খুব একটা জাঁকজমকপূর্ণ করা হয় বলে মনে হলো না। এই মাধ্যমের শক্তি এর কথা রচয়িতা ও অভিনেতার সামর্থ্য।

আলাদ্দিন উল্লাহর বাবা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নিতান্ত তরুণ বয়সে আমেরিকায় এসেছিলেন। তাঁর নাম হাবিবুল্লাহ। জাহাজের খালাসি হিসেবে আমেরিকায় এসে রয়ে গিয়েছিলেন। আশ্রয় মিলেছিল স্প্যানিশ হার্লেমে যেখানে ছিল প্রধানত কালো মানুষদের বাস। সেখানে আরও ছিল পুয়ের্তোরিকো থেকে আসা মানুষদের বসতি। যে সময় হাবিবুল্লাহ এসেছিলেন তখন হার্লেম এলাকাটি ছিল মাদক ব্যবসার জন্য কুখ্যাত অপরাধ-প্রবণ এক বিভীষিকাময় এলাকা। আলাদ্দিন তাঁর ‘ডিশওয়াশার ড্রিমস’ কমেডিটিতে যে সব কথা আউড়ে যান তাতে তিনি মূলত তাঁর বাবার কথা বলেন; বাবার প্রথম পুয়ের্তোরিকান স্ত্রী-সন্তানের কথা বলে চলেন; সেই স্ত্রীর মৃত্যুর পর ৫২ বছর বয়সে বাবার প্রায় কিশোরী বয়সী দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা বলেন যাকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে এবং যে স্ত্রীর গর্ভের সন্তানই এই স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান আলাদ্দিন।

আলাদ্দিন উল্লাহ্‌র এই একক পরিবেশনা থেকেই জানতে পারলাম হলিউডের একটা সিনেমায় অভিনয়ের আহ্বান পেয়েছিলেন। একজন মুসলমানের নেতিবাচক ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে যেখানে চরিত্রটি একজন ‘টেররিস্ট’। মুসলমান মানেই তাদের কাছে কেন টেররিস্ট মনে হয়? তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এই দৃষ্টিতে দেখা কি যুক্তিসংগত? আলাদ্দিনের বাবাও তো মুসলমান! তাহলে তিনিও কি টেররিস্ট ছিলেন? এই প্রশ্ন তুলে তিনি সেই ছবিতে অভিনয় করেননি সে কথাও বলেছেন এই কমেডিতে। নিশ্চয়ই অনুমান করা যায় এই সভ্য দুনিয়ায় আমেরিকানদের মানসিকতা যদি এখনো এই রকম হয় তাহলে তাঁর বাবা বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে যখন আমেরিকায় এসেছিলেন তখন তাঁর অবস্থানটা কত করুণ ছিল! তখন জাতিগত বিদ্বেষ বা বর্ণবাদ ছিল খুব সাধারণ বিষয়। এর শিকার হতেন তাঁর বাবার মতো সাধারণ মানুষ। তাঁরা সে সময় ইংরেজি তো দূরের কথা বাংলাও ঠিকমতো লিখতে পড়তে পারতেন না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের ‘অড জব’ বেছে নিতে হতো। তাঁরা কেউ হতেন ডিশওয়াশার, কেউ হটডগ বিক্রেতা, কেউ হতেন ডোরম্যান, কাউকে কাউকে হয়তো কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি পেশা বেছে নিতে হতো। তাঁর বাবা হাবিবউল্লাহ কাজ করতেন রেস্তোরাঁয় ডিশওয়াশার হিসেবে। তাঁর কাছেই শুনেছেন তিনি কত বিচিত্রভাবেই না এই আমেরিকার সমাজে ঘৃণার শিকার হতেন। এখন সময় বদলেছে। আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থায় ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতার। তার পরও দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা সেই মানসিকতার খুব একটা বদল ঘটেনি। বলা যায় ‘ডিশওয়াশার ড্রিমস’ কমেডিকে আশ্রয় করে আলাদ্দিন উল্লাহ তাঁর একক উচ্চারিত সংলাপ মালায় শৈল্পিক ভাবে অবলীলায় প্রকাশ করে চলেছেন তাঁর অন্তরের ক্ষোভকে।

আলাদ্দিনের বাবা পঞ্চাশের দশকে বাঙালি রেস্তোরাঁ চালু করেছিলেন ‘বেঙ্গল গার্ডেন’ নামে। বছর দু-একের বেশি চালাতে পারেননি। আশ্চর্য যে আলাদ্দিন বাঙালি অভিবাসীর টিকে থাকার গল্প, তার স্বপ্নের গল্প একাকী বলে দর্শকদের বন্দী করে রাখছেন ব্রডওয়ের ৫৪৩ ওয়েস্ট ৪২ নম্বর স্ট্রিটের ক্যাস্টিলো থিয়েটারের মিলনায়তনটিতে যেখানে বাঙালি দর্শক প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা দুই বাংলাদেশি ছাড়া তাঁর এ পর্যায়ের প্রায় পনেরোটি প্রদর্শনীর কোনোটিতে কোনো বাংলাদেশি দর্শক ছিল বলে মনে করতে পারেননি আলাদ্দিন।

না, আলাদ্দিন উল্লাহ আমেরিকার কোনো অখ্যাত ব্যক্তি নন, আমেরিকার ন্যাশনাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের অভিনেতা তিনি। তিনি অভিনয় করেন চ্যানেল এইচবিওতে, কমেডি সেন্ট্রাল-এ, এমটিভি, ভিএইচ-১-এ। পিবিএস ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘ডেসিস: সাউথ এশিয়ানস ইন এনওয়াই’-এর অভিনেতা তিনি। তাঁর একক অভিনয় দেখার পর লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস মন্তব্য করেছিল, ‘দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা সেরা কমেডিয়ান।’ তাঁর শো কালারব্লাইন্ডকে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছিল ‘জঘন্যভাবে মজার’! তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে সারা আমেরিকায় পাবলিক থিয়েটারে—নিউইয়র্ক থিয়েটার ওয়ার্কশপ, ভিক্টরি গার্ডেনস, ‍সিল্ক রোড রাইজিং, দ্য লার্ক প্লে ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে। তিনি অভিনয় করেছেন এখানকার স্বাধীন চলচ্চিত্র আমেরিকান দেশিতে, অভিনয় করেছেন পুরস্কৃত অ্যানিমেশন ফিল্ম সিতা সিংস দি ব্লুজ-এ, আইএটিভির জনপ্রিয় সিরিজ হিসেবে পুরস্কৃত আনকল মরটিস ডাব শেক শো-এর নিয়মিত অভিনেতা তিনি। এখন নির্মাণ করছেন বিবেক বল্ডের সঙ্গে মিলে ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘বেঙ্গল হারলেম’। ব্রোশিওরে তাঁর অনেক কৃতিত্বেরই পরিচয় আছে, যার গুরুত্ব আমাদের মতো অজ্ঞজনদের অজানা!