কাকতাডুয়া

জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে লিনা। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে খেলছে মন্টু ও ঝিনি। সঙ্গে ভাড়াটে বাসার অমল ও সুরভি। বোন মিলা যেতে যেতে ডেকেছিল তাকে। রান্নাঘর থেকে মা-ও ডেকে বলল, ‘যাস নারে লিনা ওদের সঙ্গে। বাইরে গেলে ভালো লাগবে। যা না, যা! ভাবল মাকে বলবে, না মা আমার ভালো লাগে না বাইরে যেতে। কিন্তু কিছুই বলল না।
বাইরে এক দৃষ্টিতে কী যেন দেখতে থাকল। তার সব চাওয়া-পাওয়ায় বেশ ফারাক হয়ে গেল জন্ম হতে। প্রথমে মা-ই জেনেছিল। তারপর একে একে সবাই। বাইরে যাবে বলে বিছানা থেকে নেমে ক্রাচটি হাতে নিল লিনা। কিন্তু কী ভেবে আবার রেখে দিল ক্রাচটি। না, যাবে না। ওর চার পাশ, নিজ বোন, মা-বাবাকে জানতে গিয়ে জানল, তার অনেক শখ এবং ইচ্ছা সীমিত হয়ে আছে প্রাকৃতিকভাবে।

ছোটবেলা মা নিয়ে বেরোতেন। বাবা অফিস হতে এসে বাসার পাশে ছোট পার্কে নিয়ে যেতেন। হাত ধরে হাঁটাতে চাইতেন। বড় হলে বোনকে নিয়ে বাসার সামনের মাঠে আসত। সবাই খেলত, লিনা সবুজ ঘাসে নয়তো মাঠের পাশের বেঞ্চিতে ঠায় বসে থাকত। সবাই মাঠে গেলে অনুপম এসে পাশে বসত, পাড়ার ছেলে। দুই বাসা পরে ওদের বাসা। হাত ধরে টানাটানি করে বলত আমাকে ধর। বলে হাতটি বাড়িয়ে দিত। লিনার মন চাইত না। বলত, না রে অণু ভালো লাগে না হাঁটতে। তুই পাশে বস, গল্প করি। অণু গল্প করত আর মিষ্টি করে হাসত, নানা গল্প। স্কুলের গল্প, স্যারদের গল্প। কোনো বন্ধু একবার দুষ্টামি করে সাপের বাচ্চা নিয়ে এল স্কুলে। পরে পিটি স্যারের হাতে বেদম মার খেয়ে বেহুঁশ। লিনা সব শুনে খিলখিলিয়ে হাসে। কোথায় যেন একটু একটু করে ভালোলাগা জমা হয় ওর ছোট্ট কিশোরী মনে।

সন্ধ্যা নামে। বাড়ি যাওয়ার তাড়া। মিলা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পাশে বসে। জিজ্ঞেস করে আপু হেঁটে যাবি, না রিকশা ডাকব! উত্তর দেয় না লিনা। ভাবে আজ হেঁটেই যাব, ক্রাচ ছাড়া। বাসায় হাসতে হাসতে হেঁটেই যাব। ঘরের দক্ষিণের জানালা দিয়ে মা দেখবে তার লিনা কল কল শব্দ তুলে একা একা হেঁটেই আসছে। কী করবে তা দেখে? প্রথমে চিৎকার করে কেঁদে উঠবে। পাড়ার সবাইকে ডাকবে। বাবাকে ফোন করে বলবে। না, দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে কাঁদবে। নয়তো ডেকে ডেকে সবাইকে বলতে থাকবে। কোথায় গেলে তোমরা? দেখ! দেখ আমার লিনা হাঁটছে। সে হাঁটতে পারে। নিজেই মাঠ হতে একা হেঁটে বাসায় এসেছে।

ফিরে এল মিলার ডাকে। কী রে আপু, কী বিড়বিড় করছিস। রিকশা ডাকব, নাকি হেঁটেই যাবি? লিনা বলে উঠল, চল আজ হেঁটেই যাই। বাসার উত্তর দিকে ছোট একটি ঝিল। তারই পাড় ঘেঁষে কয়েক টুকরো চাষের জমি। কোনে হাতে চাপার সেচযন্ত্র। ঝিলের কোনায় বাঁশ বেঁধে ঘাটের মতো রাখা। বুড়োমতো একজন এসে বাঁশে দাঁড়ায়। ওপরে ওঠানো সেচের যন্ত্রকে টেনে ওপর-নিচ করতে থাকে। পুকুরের জল জমিনে আস্তে আস্তে জমতে থাকে। রোপা চারা গাছগুলো পানি পেয়ে বড় আর বেশি সবুজ হতে থাকে। একদিন বুড়ো লোকটি বালিকা আদলের একটি কাকতাড়ুয়া এনে জমিনের মাঝখানটায় বসিয়ে দিল। রঙিন চক্কর-বক্কর ডিজাইনের হাঁটু অবধি ফ্রক। নীল রঙের পায়জামা পরিয়ে যত্ন করে মাথার পেছনে দুটো বেণি ঝুলিয়ে দেয়। সবকিছু ঠিক রেখে দুটো চোখ বাঁকা করে এঁকে দেয়। দেখলে মনে হবে বালিকা কাউকে ভেঙাচ্ছে। লিনা প্রতিদিন ওই ধান খেতের পাহারাদার মেয়েটিকে দেখে। জানতে ইচ্ছে হয়, ওই মেয়ের কী নাম রেখেছে লোকটি? নিশ্চয় একটি নাম দিয়েছে, আর ওকে ওই নামে ডাকেও বোধকরি। সকালে ঘুম হতে উঠে সোজা জানালায় কাছে যায় লিনা।

নাম না-জানা কাকতাডুয়া মেয়েকে দেখে। মাঝে মাঝে মেয়েটি বাতাসে ডানে-বামে দোলে। ভাবখানা যেন কোনো জনপ্রিয় গান শুনে শুনে সে দুলছে। কোনো দিন জানালার পাশে বসে সকালের নাশতা শেষ করে লিনা। টের পায়, কী এক অজানা মায়ার টানে এসে বসে থাকে সে। লিনা দেখে সেই মেয়েকে, আর বারবার দেখে। বুড়ো লোকটি মেয়ের সাজ মাঝেমধ্যে বদলে দেয়। কখনো দুটো বেণির একটি সামনে এনে ডান বুকের ওপর ফেলে রাখে। ওমা! লাল একটি চিকন কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে বেণিটি।

ছোটবেলা মিলা সাজতো। মুখে দাড়িগোঁফ লাগিয়ে ওকে এসে ভয় দেখাত। মুখ ভর্তি দাঁড়ি দেখে ভয় পেত না লিনা, তবে মজা পেত। শুকনা কচুরিপানার কালচে লম্বা মূল দিয়ে বানানো দাঁড়িকে সুতা দিয়ে মুখে বেঁধে রাখত। গলার স্বর বদলে পাড়ার হুজুরের ঢঙে কথা বলত। মেয়েটির বেণিটি কি সেই কচুরিপানার মূল দিয়ে বানিয়েছে বুড়ো লোকটি! হতেও পারে। শুকনা মূলকে কেটেছিঁড়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বানিয়ে দিয়েছে দুটো বেণি। আবার মাথার পেছনে আটকেও দিয়েছে। বুড়ো লোকটি বেশ রসিক মনে হলো লিনার। আজ সারা দিন আকাশে প্রচুর মেঘ। ও-প্রান্ত হতে এ-প্রান্ত পর্যন্ত। মেঘগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে সারা দিন উড়ল। সন্ধ্যায় পশ্চিম কোণে জমে রইল অনেকক্ষণ। মাঝরাত হতে শুরু হলো বৃষ্টি জোরেশোরে। থেমে থেমে চলল ভোর অবধি।

লেপমুড়ি দিয়ে লিনা দিনের শুরুর খানিক সময় শুয়ে রইল। সুন্দর ঝকঝকে সকালকে আরও বেশি দেখতে দিয়ে দাঁড়াল খোলা জানালায়। অভ্যাস মতো, চোখ গেল মেয়ে আদলের কাকতাড়ুয়ায়। দেখে মনে হলো সবকিছু আগের মতো নেই। কোথায় যেন বদল ঠেকছে। কয়েক মুহূর্ত পর ডান পাশে নিচে তাকাতেই চোখে পড়ল। মেয়েটির ডান পা কেমন যেন ঝুলে আছে। হাঁটুর কাছে ভাঁজ খেয়েছে বলে বেমানান লাগছে। না সে চায় না কাকতাডুয়া মেয়েটিকে ওভাবে দেখতে।

ক্ষণিকেই বিষাদে চেয়ে গেল মনটি। প্রতিদিনের দেখা ওই মেয়েটির পা কি লীনার পায়ের মতো হয়ে গেল? এখন কী হবে? লীনা জানে, ওর যদি কিছু এমন হয়ে যায় তাহলে মেয়েটি অনেক কষ্ট পাবে। আর সেই কষ্টের পরিমাণ কতটুকুন তা শুধু লিনাই জানে। অনেক কষ্ট, ভীষণ কষ্ট। সবার করুণার চাহনিতে ক্লান্ত হয়ে যাবে ওই নাম না জানা মেয়েটি।
দিনে শতবার একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে বারবার। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা অবধি। লিনা মাঠ ছাড়িয়ে দক্ষিণমুখী সদর রাস্তার দিকে তাকায়। না কাউকেই দেখছে না। নিশ্চয় বুড়ো লোকটি জানে না, তার এই আদরের কাকতাডুয়া মেয়েটির এমন অবস্থার কথা। পরক্ষণেই আবিষ্কার হলো, বুড়ো লোকটি হয়তো জেনে গেছে। তাই বুঝি জমির আইল ধরে একরকম ছুটেই আসছে সে। ডান হাতের লাঠি দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে আসছে। বাম হাতে ঝোলানো একটি গাটরি। লিনা বারবার দেখতে চাইছে, মেয়েটির কষ্ট সিক্ত মুখখানা। মনে হলো অভিমানে, না হয় লজ্জায় লিনার দিকে তাকাতে চাইছে না। অন্যদিকে চেয়ে আছে। হয়তো-বা কাকতাডুয়া মেয়েটি খুঁজছে বুড়ো লোকটিকে।

যার জন্য অপেক্ষা সেই কিনা লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল মেয়ে আদলের কাকতাডুয়ার পাশে। দূর হতে দেখে লিনার মনে হলো, লোকটি বিষণ্ন মনেই কাকতাডুয়াকে যত্ন করে তুলে পাশের আলের ওপর নিয়ে বারবার দেখতে লাগল। বারবার চোখ ফিরিয়ে কী যেন দেখছে চাষি বুড়ো লোকটি। খানিক দেখে মনে হলো, বুড়ো পেয়ে গেল কাকতাডুয়ার কষ্টের উৎস। কতই না মায়ার বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল এক প্রাণহীন মেয়ের আদলের কাকতাডুয়াকে। এক নজর দেখে বুঝে গেল, মেয়েটির হাসি মিলিয়ে যাওয়ার কারণ। মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সঙ্গে আনা গাঁটরি খুলে কী যেন বের করে দ্রুত ব্যস্ত হয়ে গেল বুড়োটি।

হঠাৎ লিনা শোনে, মা-বাবা সবাই নাশতার টেবিল বসে তাকে বারবার ডাকছে। ক্রাচে ভর করেই যোগ দিল সবার সঙ্গে। মায়ের হাতের স্পেশাল চিকেন কোর্মার সুভাষে চারদিক মৌ মৌ। বাবুর্চি ভাইয়ের হাতে বানানো মচমচে পরোটা। বাহ, আজ কেন এই বিশেষ আয়োজন। তবে লিনা নিশ্চিত, মা অবশ্যই জানে। মা এমনিতে সবার জন্য এই বিশেষ নাশতার আয়োজন করছে। মা তাই করে। সব ছোট ছোট হাসিমুখগুলোকে আরও বেশি করে আনন্দের মনোরম প্রলেপ দিয়ে সাজাতে ভালোবাসে। বলে প্রতিদিন শুধু সাদামাঠা দিন হবে কেন? সাধ্যের মধ্যেও ইচ্ছে করলে দুটো পছন্দের গান গেয়ে ঘরটিতে খানিক সবুজের ছোঁয়ায় একটি দিনকে বিশেষ দিন করা যায়।

মা প্রায়ই তা করে। তার প্রিয় বাবা হই-হুল্লোড় করে সেই বিশেষ দিনে। গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে সারা সময় নিজেদের মধ্যে আনন্দের খুশবু ছড়িয়ে দেয়। কী অসাধারণ লিনার বাবা-মা দুজনই। বড্ড বিশেষ মনের দুটি মানব সন্তান। সবার ভালোবাসা, সঙ্গে লিনার ভালোবাসায় সিক্ত ওই বিশেষ দু জন।

নাশতা সেরে কফির মগটি নিয়ে লিনা ক্রাচে ভর করে আবার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। আর তখনই চোখে পড়ে সবুজ খেতের ওপর বয়ে যাওয়া বাতাসে দুলছে মেয়েটি। হ্যাঁ, সেই কাকতাডুয়া মেয়েটি। বুড়ো চাষি মেয়েটির মুখের আদল বদলে দিয়েছে। মেয়েটি হাসছে। লিনার দিকে তাকিয়েই হাসছে। হ্যাঁ তাইতো! শুধু হাসছে, আরও বেশি বেশি হাসছে। হাসতে হাসতে যেন বলছে, জান লিনা, আমার বুড়ো চাষি আমার পা ঠিক করে দিয়েছে। সে সব সারিয়ে এই মাত্র খুশিমনে বাড়ি গেল। তাই তো আমি খুশিতে বাতাসে দোল খেতে খেতে গান গাইছি।

আমার এই দোল খাওয়াতে আনন্দ।
আমার এই দোল খাওয়াতে আনন্দ।
লিনা ভাবছে, সে কি এখন থেকে কাকতাডুয়া হয়ে যাবে?