“হোমলেস তরুণী”

ভবনটি বাইশ তলা। সুবিশাল ভবনের রাস্তার উত্তর প্রান্ত ৫৬ সড়কে, দক্ষিণ প্রান্ত ৫৫ সড়কে। দুই সড়কের মাঝখানের পুরোটা জুড়েই এর অস্তিত্ব। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একেবারে পুব কোণে দুই তলার ওই অংশসহ চেইজ ব্যাংক ৫৬ সড়ক ছয় অ্যাভিনিউ শাখা। ব্যাংক ছাড়া আছে সর্বজন পরিচিত চেইন ড্রাগ স্টোর ‘ডুয়্যান রিড’, বিখ্যাত ইউরোপিয়ান অরগানিক সুপার মার্কেট ‘আর্নেস্ট ক্লাইন’। গা লাগোয়া ‘ব্যাংক অব আমেরিকা’র এটিএম বুথ শাখা। ওর নেক্সট ডোর নেইবার-দোতলায় অবস্থানরত বিভিন্ন অফিস বাড়ি, এবং তৃতীয় তলা থেকে বাইশ তলায় অবস্থিত অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে যাতায়াতের জন্য দুটি এক্সপ্রেসসহ মোট চারটি এলিভেটর ও সিকিউরিটি ডেস্ক সঙ্গে নিয়ে সুপরিসর লবি। রাস্তার উল্টো দিকে পরের রাস্তা ঘেঁষে ভুবন খ্যাত হোটেল হিলটন। মিড টাউনের এই বনেদি মহল্লায় ওরকম একটি অভিজাত শ্রেণির মানুষের আবাসিক ভবনের সামনে বিশ্রীভাবে অস্থায়ী ডেরা বেঁধে শুয়ে-বসে থাকে তরুণীটি। সন্ধ্যা ঘন আঁধারে ডুব দিলে সে সেখানে, সে বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের সাইড ওয়াকের বিল্ডিংয়ের ওয়াল ঘেঁষা শীতের দিন-রাতে কঠিন কামড়ে ধরা হিম ঠান্ডা পাথর সিমেন্টের চাতালে, কার্ডবোর্ড বিছিয়ে, তার ওপর ময়লা, নোংরা লেপ-কম্বল বিছিয়ে ভারী জ্যাকেট কোট, লংকোট শরীরে জড়িয়ে স্লিপিং ব্যাগের গতরের ভেতরে নিজের গতর সেঁধিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মাথার দিকে শিথানে গোটা দুই মিল্ক ক্রেটে ছেঁডা-খোঁড়া ব্যাগ কি কার্টুনের মধ্যে রাখা নিজের জামা-কাপড়, কিছু বই, পত্র-পত্রিকা। খবরের কাগজ ইত্যাদি যত্নে রাখা। বলা বাহুল্য সবকিছুই বহু পুরোনো ও তেল চিটচিটে ময়লা নোংরা।

এই তার ঘরহীন ঘর। সংসার বিহীন সংসার। ভদ্র সমাজ ওদের একটা নাম দিয়েছে ‘হোমলেস’। অনেকে মুখে জমা থুথুর দলা ঘৃণা ভরে ওয়াক করে উগরে দেওয়ার মতো বলে বাম, স্ট্রিট বাম।

মেয়েটিকে কয়েক দিন ধরেই দেখছি। প্রথম দিন খটকা লেগেছিল এ রকম পরিচ্ছন্ন সুন্দর পরিবেশে বেখাপ্পা বেমানান ভাবে মেয়েটি আর্নেস্ট ক্লাইনের মতো ঝকঝকে সুপার স্টোরের সামনে ঠাঁই গাড়ল কী করে? পরক্ষণেই বিষয়টা মাথায় ঢুকেছিল। বিল্ডিংটায় রেনোভেশনের কাজ চলছে। সমস্ত সন্মুখ ভাগ জুড়েই স্ক্যাফোল্ড বাঁধা। সে জন্যে জায়গাটা এমনিতেই অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। সে কারণেই দোকান ও বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ গা করেননি ব্যাপারটায়। ভাবছেন হয়তো কয়েক দিনেরই তো বিষয়!

আমার অফিস থেকে ব্যাংকিংসহ অন্যান্য নানা কাজে ওপথে যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ে। দ্বিতীয় দিন দেখলাম একজন ফরসা মতন সুপুরুষ বলা যায়, এমন যুবক মেয়েটির মুখোমুখি একটা মিল্ক ক্রেটে বসে নিবিড়ভাবে কথা বলছে। মেয়েটি তার কথা খুব মজা পাওয়ার মুডে শুনছে। যে কেউ দেখে বলে দিতে পারবে দুজনের সম্পর্কের নিবিড়তা। মেয়েটির ক্লিষ্ট মুখে হাসির আভাস আমার মনে আনন্দ ছড়াল। কাছাকাছি হতে দেখি দুজনের সামনে দুটি কফি কাপ। দুজনেরই হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়ছে। সন্নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎকট গন্ধ আমার নাকে ধাক্কা দিতেই মস্তিষ্ক চিনে নিল তাকে। বুঝলাম একটু আগে এখানে গঞ্জিকার সেবাও নেওয়া হয়ে গেছে। একটু আগের দপ্ করে জ্বলে ওঠা মুখটাতে যেন কালি মাখিয়ে দিল কেউ। আমি দ্রুত সরে যাই।

অফিসে ফিরে নিজের ডেস্কে বসে স্থিতধী হওয়ার পরও মাথা থেকে বিষয়টি সরাতে পারলাম না। ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। তাড়াতে চাই, দূর কত কত মানুষ হাঁটছে। তাকিয়েও দেখছে না। আমার সংবেদনশীল মন একজন সুন্দরী তরুণীকে ওভাবে ওই জীবনে দেখতে চাচ্ছে না বলে?

হয়তোবা তাই! কারণ, এর আগেও যে বার দু’তিন দিন এ রকমটি দেখেছে, মন আমার কিছুতেই মেনে নিতে চায়নি। এবার বিষয়টি আমাকে হন্ট করছে, কারণ অকুস্থল আমার খুব কাছাকাছি। অনুসন্ধিৎসু মন তার সম্পর্কে বিশদ জানতে চাচ্ছে। তাকে পাঁকমুক্ত করতে মন ইতিমধ্যে পথ হাতড়ে ফিরছে। পরদিন দুকাপ কফি পেপার ব্যাগে বন্ধ করে আরেক হাতে আনকোরা সিগারেটের প্যাকেট হাতে ধরে মেয়েটির কাছে যাই। সামনে স্থাণুর মতো দাঁড়াই। সে উবু হয়ে বসে নিমগ্ন হয়ে বই পড়ছে। ‘হাই’ বলতেই সে মুখ তুলে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে, হাসি ছড়িয়ে বলল ‘হা-ই’। জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছ?” এবার সে কেমন অস্থির বিচলিত ভঙ্গিতে দ্রুত বলল, “ভালো আছি, খুব ভালো আছি।” সে যে ভালো নেই, তা তার ভালো আছি বলার ধরন থেকেই বুঝেছি। এ অবস্থানে মানুষ ভালো থাকে কী করে? প্রাচ্যদেশীয় নরম জল হাওয়ায় গড়ে ওঠা নরম মনের মানুষের মতোই চিন্তা করি, এ বয়সে মেয়েদের বিয়ে হবে। নিজের সংসার হবে। ভালোবাসার একান্ত একজন মানুষ পাশে থাকবে, তবে না ভালো থাকা? পারিপার্শ্বিকে ফিরে আসি। তার দিকে তাকিয়ে বলি, “কী বই পড়ছ?” সে তড়িৎ জবাব দেয়, “অরুন্ধতী রায়ের লেখা পুরোনো বই ‘দি গড অব স্মল থিংস। অসাধারণ বই।’” পরক্ষণেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, তুমি তো ইন্ডিয়ান। তুমি অরুন্ধতী সম্পর্কে আমাকে একটু বলবে?” আমি ওর সামনে অলস একা বসে থাকা মিল্ক ক্রেটটায় বসি। ওকে বলি, “আমি ভারতীয় নই, আমার দেশ বাংলাদেশ। অরুন্ধতী ভারতীয় বংশোদ্ভূত। বেশ ভালো লেখক। তুমি তাঁর যে বইটি পড়ছ, এটি ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পেয়েছে।” এবার আমি অন্য প্রসঙ্গে আসি, “তোমার জন্য কফি নিয়ে এসেছিলাম।” আমি পেপার ব্যাগ থেকে সযত্নে দু’কাপ কফি বের করি। চিনির প্যাকেট, নাড়ানি কাঠি, ন্যাপকিন তার সামনে রাখি।

সে একমনে কফিতে চিনি মেশায়। আয়েশ করে কাপে চুমুক দেয়। আমিও কফি পান করতে করতে সিগারেট ধরাই। তার হাতে সিগারেট ও লাইটার দেই। বলি, “তোমাকে আজ কয়েক’দিন এখানে দেখছি। এর আগে কোথায় ছিলে?”

দ্বিধাহীন জবাব, “এর আগে মাস চারেক ফিফথ্‌ অ্যাভিনিউয়ের বড় চার্চের সিঁড়ির এক কোণে থাকতাম। ওখানে বড্ড ভিড়। কষ্ট করে তাও ছিলাম। পুলিশ তাড়িয়ে দেওয়ায় কয়েক দিন এদিক-ওদিক ঘুরে এখানে ঠাঁই পেতেছি। জানি না, এখানে কয়েক দিন? এরপর কোথায়?” আমার মন ভিজে যায়। খুব দরদ ভরে বলি, “জীবন্মৃত এ জীবন কেন বেছে নিলে? ফিরে এসো জীবনের দিকে।” একরাশ কালো মেঘ দ্রুত উড়ে এসে তার মুখ-চোখ দখল করে নিল, এখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। আমি ত্বরিত উঠে পড়ি। সিগারেটের প্যাকেটটা ওখানেই পড়ে থাকে। আমি ‘বাই’ বলে চলে যাই।

পরদিন আবার যাই। তারপর দিন আবারও। প্রতিদিনই কিছু একটা খাবার নিয়ে যাই। কফি নিয়ে যাই। দুইবার দুই প্যাকেট সিগারেট দিয়ে যাই। তার বন্ধুটিকে বসা দেখলে দূর দিয়ে চলে যাই। না থাকলে কাছে যাই। বসি। তার সম্পর্কে জানতে চাই। সে মন খোলে। আমাকে হয়তো তার ভালো মানুষ মনে হয়। এক ধরনের আস্থা পায়। হয়তো বোঝে আমি ক্ষতিকর নই। আস্তে আস্তে আমি তার জীবনের গল্গ খানিকটা জেনে যাই। নাম সিলভিয়া। তার পিতামহ হাবিয়ার এ দেশে এসেছিল ইকুয়েডর থেকে। সে বেচারা গতর খাঁটিয়ে কঠিন সংগ্রাম লড়াই করে তার ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছিল। সিলভিয়ার বাবা সিটিতে জব করত। সেখানেই একজন হোয়াইট মেয়ের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া শেষে বিয়ে করে সংসার পাতে। সচ্ছল, সুন্দর পরিবার। সব ঠিক চলছিল, বাদ সাধল সে নিজে। স্কুল ফাইনাল শেষ করার আগেই সে বদ সঙ্গে পড়ে নেশাসক্ত হলো। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন শুরু করল। বাবা-মা শোধরানোর অনেক চেষ্টা কর ব্যর্থ হয়ে হাল ছাড়ল ।

সিলভিয়া তার বদ সঙ্গীদের একজনের সঙ্গে এক বছর একসঙ্গে কাটায়। সে এক বছর বড় কষ্টের। বড় নির্দয়। তারপর এদিক-ওদিক হয়ে আরেকজন সঙ্গী জুটিয়ে আরও বছরখানেক। তারপর এখনকার এই জীবন! আমি তার কাছে নিয়মিত আসা, ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলা নতুন বন্ধুটির কথা জানতে চাই। তার চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে দেখতে পাই। সে বলে তার এই বন্ধুটি খুব ভালো মানুষ। খুব কেয়ারিং। সে তাকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করবে। ঘর বাঁধবে। আমি তাৎক্ষণিক তার উৎসাহে জল ঢালি না।

পরে একদিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, “দেখো, তুমি তাকে ভালো করে চেন না। তার কিছুই তুমি জান না। সে ভালো হলে, তার জীবন সুষ্ঠু স্বাভাবিক হলে, তোমাকে ভালোবাসলে, সে তোমাকে এই কঠিন শীতে রাস্তায় ফেলে না রেখে তোমাকে তার বাসায় নিয়ে যেত, উল্টো তোমার সঙ্গে এখানে এসে রাত কাটাত না। আমার তো মনে হচ্ছে সে একজন ঠগ।” সে কিছুতেই মানতে নারাজ। যাচ্ছে তাই তর্ক জুড়ে দিল। খুব রেগে গিয়ে আমাকে তার ওখানে আসতে বারণ করে দিল।
আমি চলে এসেছিলাম। দিন কয়েক ওদিকে যাওয়া হয়নি।

পোস্ট অফিসে যাওয়ার প্রয়োজনে বেরোলাম। ওদিক দিয়েই পথ। নজর করি ওদিকে। না, বিছানাপত্র, মিল্ক ক্রেট, হোমলেস লেখা সাহায্যের আবেদন পত্র, কিছুই নজরে এল না। বুকটা ধক করে উঠল। পা চালিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি, চিহ্নমাত্র নেই। তড়িঘড়ি গেলাম রাস্তার ওপারে বাঙালি ফুড ভেন্ডর রফিক ভাইয়ের কাছে (রফিক ভাই মায়া করে সিলভিয়াকে প্রতিদিন সকালে একটা মাফিন আর কফি দিত)। রফিক ভাই ছল ছল চোখে জানাল, গতকাল সকালে পুলিশ সিলভিয়া ও তার বয়ফ্রেন্ডকে গাড়িতে তুলে কোনো এক রিহ্যাব সেন্টারে নিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই রফিক ভাই খুশি খুশি গলায় বলল, “ভালোই হয়েছে। এই কঠিন শীতে বরফে, বৃষ্টিতে কি রাস্তাঘাটে কেউ থাকতে পারে?” আমার দিকে তাকিয়েই আবার জিজ্ঞেস করে, “ভাই, বলেন তো, এ দেশে কুকুর বিড়াল এত আদর-যত্নে, মায়ায় ভালোবাসায়, সেবায়-চিকিৎসায় থাকে, সেদেশে মানুষের থাকার এত কষ্ট কেন?”
জবাব দিতে পারি না। বিদায় নিয়ে চলে যাই আপন গন্তব্যে।

মাস তিনেক পর, সিলভিয়ার স্মৃতি ঝাপসা। ওদিক দিয়ে যেতে রফিক ভাইয়ের ডাক শুনতে পাই। কাছে যেতে তিনি জানান, সিলভিয়া রিহ্যাব সেন্টার থেকে পালিয়ে এসেছে। ফিফথ্‌ অ্যাভিনিউয়ের চার্চের সিঁড়িতে থাকে। আমি খুব উৎসাহ বোধ করি না। চার দিনের মাথায় আমি যাই সিলভিয়াকে খুঁজতে। কোথাও কোনো চিহ্নমাত্র নেই। চার্চের সুবিশাল চত্বরে এবং সাইড ওয়াক জুড়ে অনেক কয়েক জন হোমলেস নারী-পুরুষ, তাদের কাছে চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাই।

দু/একজনের কাছে কেবল ভাসা ভাসা জানতে পারলাম, সিলভিয়া এখানে আসার দুদিন পরই তার বয়ফ্রেন্ড সেন্টার থেকে পালিয়ে এসে সিলভিয়ার সঙ্গে থাকতে শুরু করে। সপ্তাহ দুই পার হওয়ার পর একদিন দুপুর নাগাদ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্ট এসে তাকে তুলে নিয়ে চলে যায়। সে অবৈধ ছিল। পুলিশের খাতায় তার নামে নানা অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ ছিল। পুলিশ তাকে দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজছিল। সিলভিয়া সেদিন একটুও কাঁদেনি। তবে সেদিন থেকে তাকে আর এ তল্লাটে কেউ দেখেনি।
ফিরে আসি। কষ্ট ভেতরটাকে চেপে ধরে। রফিক ভাইয়ের প্রশ্নটি ঘুরে ঘুরে মাথায় আসতে থাকে এবং আমাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে।