৫০ চিঠিতে কানাডার চিত্র

ডেভিড জনস্টন
ডেভিড জনস্টন

কানাডার গভর্নর জেনারেল ডেভিড জনস্টনের (জন্ম: ১৯৪১) মেয়াদকাল শেষ হয় ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর। দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মেয়াদ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের ১ অক্টোবর। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী গভর্নর জেনারেল ডেভিডের একটি বড় পরিচয় তিনি একজন লেখক। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই ‘The Idea of Canada: Letters to a Nation’। সত্তরোর্ধ্ব জীবনে বিভিন্ন জনকে লেখা বিপুলসংখ্যক পত্র থেকে বেছে মাত্র ৫০টিকে সংকলিত করা হয়েছে এই বইটিতে। বর্তমানের কানাডা অতীতে কী ছিল এবং ভবিষ্যতে কী হবে, তার চিত্র পেতে এই বইয়ের তুলনা নেই বলে অনেকে মনে করেন।

ডেভিড জনস্টন বলেছেন, ‘আমার মনে হয় আমি খানিকটা সেকেলে। যখন আমার বড় মেয়ে বাড়ি থেকে চলে গেল, প্রতিদিন সকালে আমি তাকে চিঠি লিখতাম।’ পাঁচ মেয়ের প্রত্যেকেই একে একে বাড়ি ছেড়ে গেছে এবং বাবা ডেভিড তাঁদের সবাইকে দৈনিক চিঠি লিখেছেন। চিঠিগুলোতে তাঁর মেয়েরা মনোযোগ দিত কি না ডেভিড কখনোই সেটি নিয়ে ভাবতেন না। তিনি যে যোগাযোগ করেছেন এটাই ছিল ডেভিডের আনন্দের বিষয়। চিঠি লেখার এই অভ্যাস ডেভিডের শুরু হয় ছোটবেলা থেকেই।

সংকলিত চিঠিগুলো যেন এক একটি প্রবন্ধ। সাজানো হয়েছে এমনভাবে যে তাঁর পুরো জীবনটাই উঠে এসেছে। তাঁর হয়ে ওঠাকে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব পালন, পারিবারিক জীবনে বাবা বা দাদু হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলোও উন্মোচিত হয়েছে ডেভিডের কলমে। বহুজনকে লেখা সে চিঠিগুলো। বহু পেশার বিভিন্ন বয়সী মানুষ তাঁরা। পত্র প্রাপকদের অনেকেই এই বই প্রকাশকালে পরপারে চলে গেছেন।

ডেভিডের কলমচর্চা শুরু ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে। ১৯৬৭ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হয়। আইন-বিষয়ক বই ছিল সেটি। নিজের লেখা বা সহলেখক হিসেবে তাঁর বইয়ের সংখ্যা একেবারে কম নয়—মোটামুটি ২৪টি। এবং সত্যি কথা হলো সেগুলোর প্রায় সবগুলোই আইন-বিষয়ক—কখনো কখনো কোম্পানি আইন, কখনো সিকিউরিটি ও অর্থ-আইন। ‘দি আইডিয়া অব কানাডা’ প্রকাশকালে ডেভিড জনস্টন স্বীকার করেছেন, “মানুষ প্রায়শই আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কোন বিষয়টি তোমাকে চাকরিকালে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে।”’ আমি বলব, আমি সব সময় জানতাম, এটি একটি ভালো দেশ। কিন্তু কখনো উপলব্ধি করিনি সেটি কতটা ভালো। বা এই দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী কী। এবং এই ভাবনাই আমাকে আইনের বই লেখা থেকে সরিয়ে এই দেশটি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে।’ জানা যায়, তাঁর ইচ্ছে ছিল গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরেই তিনি সেটিকে প্রকাশ করবেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর অব্যাহতি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অনুরোধে তাঁর কার্যকাল বৃদ্ধি পায়। শেষে ২০১৬ সালের এপ্রিলে অটোয়াতে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি।

সংকলিত ৫০টি চিঠিকে লেখক ভাগ করেছেন তিনটি ভাগে: ‘What Shapes me’, ‘What Consume me’ এবং ‘What Inspires me’ নামে। চিঠিগুলো গ্রন্থিত করা হয়েছে বিশেষ একটি কাজে। প্রতিটি চিঠির শুরুতে একটি শিরোনাম। এবং একটি উপশিরোনাম যেটি ওই শিরোনামটিকে ব্যাখ্যা করে। চিঠির প্রাপকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো কোনো চিঠিতেই তারিখ উল্লেখ নেই। তবে প্রতিটি চিঠির শেষেই রয়েছে প্রেরক বা প্রেরকের সঙ্গে লেখকের সংলাপের সূত্রের উল্লেখ।

ধরা যাক, বইয়ের প্রথম চিঠির কথা। শিরোনাম ‘Who Am I, Anyway?’ লেখক উপশিরোনাম দিয়েছেন ‘A simple answer to one boy’s profound question’। পত্র প্রাপক ‘To an unknown Inuit boy’। প্রথম চিঠির এই তিনটি বিষয় খেয়াল করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, ডেভিড জনস্টনের লেখা চিঠিগুলো আসলে চিঠি নয়। অথবা চিঠির আদলে অন্য কিছু। বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট হয়, যখন আমরা জানি ওই প্রাপক আসলে দশ বছর বয়সী একটি আদিবাসী ছেলে। গভর্নর জেনারেল হিসেবে অটোয়ার বাইরে নুনাভুতে ডেভিড ছেলেটির প্রশ্নের সম্মুখীন হন। টেরি ফক্স দৌড়ে তিন দশকের বেশি কাল ধরে অংশ নেওয়া ডেভিড সেদিনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুজনের কথোপকথন ছিল এমন:
‘আপনি কে?’
‘আমি গভর্নর জেনারেল।’
‘আপনার নাম কী?’
‘আমার নাম ডেভিড।’
‘যাই হোক, আপনার বয়স কত ডেভিড?’
‘আমার বয়স সত্তর বছর।’
‘সত্তর! আমি জানতাম না কেউ এত বুড়ো হয়।’
পাঁচ কিলোমিটারের দৌড় শেষে লেখক ছেলেটির কাছে আবার যান এবং হেসে বলেন, ‘তবে এখনো মরে যাইনি।’

এই যে ছেলেটি, যার নাম ডেভিড জানেন না, তাকে চিঠি লিখতে সম্বোধন করা হয়েছে, ‘প্রিয় তরুণ বন্ধুটি’। দেখা হওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে ডেভিড লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, আমার উত্তরটা কতটা অসম্পূর্ণ ছিল।’ সম্পূর্ণতা দিতে ডেভিড তখন সাড়ে তিন পৃষ্ঠার একটি ব্যাখ্যা দেন যে তিনি আসলে কে? কেননা ‘গভর্নর জেনারেল’ একটি পদ মাত্র। আর তুলে ধরেন তাঁর বৃত্তান্ত—জন্ম, শৈশব, কৈশোর ইত্যাদি।

আবার ধরা যাক, দ্বিতীয় চিঠির কথা। ‘What Champlain Teaches’ শিরোনাম পড়তেই পাঠকের মনে পড়বে ফরাসি দেশ থেকে আগত স্যামুয়েল ডি চ্যাম্পলেইনের কথা; যিনি সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে কুইবেক শহর প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তী সময়ে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেখক এই চিঠির উপশিরোনাম দিয়েছেন ‘Three Lessons from Canada’s first public servant’। আর চিঠিটি লেখা হয়েছে প্রিভি কাউন্সিলের ক্লার্ক ও ক্যাবিনেটের সচিব জোনস চ্যারেটকে। বলে রাখা যেতে পারে, এটি হলো কানাডা সরকারের অরাজনৈতিক সর্বোচ্চ পদ। জোনসকে লেখা এই চিঠিতে ডেভিড প্রথম গভর্নরের অবদানকে স্মরণ করেছেন বারবার এবং দেশ পরিচালনায় ক্লার্কের দায়িত্ববোধের প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

বইয়ের প্রতিটি চিঠি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে। প্রতিটি চিঠিই পাঠকের মনে নতুন আলোর সঞ্চার করতে সক্ষম। বইয়ের শেষ চিঠিটি লেখা হয়েছে জন বুচানকে। জন হলেন কানাডার পঞ্চদশ গভর্নর জেনারেল। এই চিঠির শিরোনাম ‘The Idea of Canada’। উপশিরোনামে আছে ‘Nation for all Nations’। আর এর ঠিক আগের চিঠিটি হলো কানাডাবাসীর উদ্দেশে লেখা। উপশিরোনাম ‘কানাডার ১৫০তম উদ্‌যাপন’ আর শিরোনাম হলো: ‘কী হবে আপনার উপহার’। আর এভাবে স্পষ্ট হয় যে বই ডেভিড শুরু করেছেন নিজেকে দিয়ে, শেষ করেছেন বিশ্বকে দিয়ে। প্রথম পত্রের প্রাপক একটি কিশোর। আর শেষ চিঠিটি এমন একজনকে লেখা, যিনি কানাডাকে সব দেশের সেরা দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।

সাবেক গভর্নর জেনারেল ডেভিড জনস্টনের বইটি নিয়ে কথা শেষ করার আগে জানিয়ে রাখতে চাই, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে তিনি কানাডার ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশ করেন আরেকটি বই ‘Ingenious’। বইটির পুরো নাম এমন ‘How Canadian Innovators Made the World Ingenious, Smarter, Smaller, Kinder, Safer, Healthier, Wealthier and Happier’। বইটির সহলেখক হলেন উদ্যোক্তা টম জেনকিনস। মোটামুটি ৩০০টি গল্প আছে বইতে, যেগুলোর প্রতিটি একটি করে আবিষ্কারের কথা এবং যেগুলোর প্রতিটির পেছনে কোনো-না-কোনো কানাডীয়র ভূমিকা ছিল। এই বইটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে দেশপ্রেমের বার্তা। উৎসর্গ পত্রে লেখা হয়েছে ‘In honor of the relentless creativity of all of the people who have inhabited this mighty and graceful land called Canada’।
মূল আলোচনার আগে লেখকদ্বয় একটি অধ্যায় যোগ করেছেন যার শিরোনাম হলো ‘What makes Canadians innovative’। যদিও এর আগে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন কেন তাঁরা এই বইটি লিখতে গেলেন সে বিষয়ে। সূচিপত্রের প্রধান শিরোনামগুলো এমন: ‘Innovation: Here’s How’, ‘Smarter’, ‘Smaller’, ‘Kinder’, ‘Safer’, ‘Healthier’, ‘Wealthier’, ‘Happier’। প্রতিটি প্রধান শিরোনামের নিচে রয়েছে ছোট ছোট বিপুলসংখ্যক উপশিরোনাম। ‘কানাডার মানুষ কেন উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন’ অধ্যায়ের শুরুর বাক্যগুলো এমন:
‘প্রতিটি মানুষই সৃজনশীল। প্রতিটি সমাজই (Community) উদ্ভাবনে সক্ষম। মানবজাতির ইতিহাসই হলো উদ্ভাবনের ইতিহাস। ... এর পরেও কিছু জাতিগোষ্ঠী পৃথিবীতে রয়েছে যারা সমস্যা সমাধানে এমন উপায় বের করতে পারেন, যার কারণে তাদের সৃজনশীল চিন্তা সহজতর হয়। কানাডা তাদের একটি। কেন?’

ডেভিড জনস্টনের ভাষাটি অনেক সুখপাঠ্য। চিঠির সংকলনেও এটি লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন উদ্ভাবন নিয়ে কথা বললেও শব্দচয়ন ও উপস্থাপন এতই মনোরম যে পাঠকের মনে হয় তিনি একটি সহজ বিষয়কে পড়ছেন সুলিখিত ভাষায়। ‘দি আইডিয়া অব কানাডা’ও লেখকের গভীর ভাবনার সহজ প্রকাশ। কানাডার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে রচিত হলেও পুরো বইটিতে সাহিত্যের রস টইটম্বুর। আর সে কারণেই শুরু করলে বইটি আর পাঠকের পক্ষে রেখে দেওয়া সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে চাই ২০১৬ সালে কানাডার গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক ‘গ্লোব অ্যান্ড মেইল’ কানাডার সার্ধশত বার্ষিকী উপলক্ষে ছয়জন বিশিষ্টজনের চিঠি প্রকাশ করেছিল। তাঁরা হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁদের বোধ নিয়ে কানাডাকে পত্র লেখেন। প্রথমটি ছিল গভর্নর জেনারেল ডেভিডের। জাতি হিসেবে কানাডার বৈশিষ্ট্যগুলো ডেভিড তাঁর চিঠিতে চিহ্নিত করেছেন এভাবে-
We are inclusive,
We are honorable,
We are selfless,
We are smart,
We are caring.

প্রতিটিকে ব্যাখ্যা করেছেন ডেভিড। প্রথমটির ব্যাখ্যা এমন: আমরা হলাম সারা পৃথিবীর তিন কোটি ষাট লক্ষ মানুষের সমষ্টি। আদিবাসী থেকে নতুন আগন্তুক পর্যন্ত যারাই এই ভূমিতে বাস করেন, তাঁদের সবার অবদানকে আমরা স্বীকার করি। চিঠির শেষে ডেভিড লিখেছেন কানাডীয় হিসেবে আমাদের সার্বক্ষণিক প্রত্যাশা; আমরা যেন Inclusive, honorable, selfless, smart এবং Caring হতে পারি।
ডেভিডের এই চিঠিটির মূল কথাই কিন্তু তাঁর পত্র সংকলনের শেষ চিঠির কথা।

ডেভিডের বই ‘দি আইডিয়া অব কানাডা: লেটারস টু আ নেশন’ জুড়ে এই মনোভঙ্গি স্পষ্ট। আর তাই কানাডাকে সত্যিকারভাবে বুঝতে, কানাডার মূল্যবোধ ও চেতনাকে ধারণ করতে এই বই হতে পারে একটি আবশ্যিক পাঠ।