বিষাদে নিষাদে নিরঞ্জন

বড় বড় দেশে বড় বড় ঘটনা থাকে, বড় বড় কষ্ট থাকে। প্রেম থাকে-বিরহ থাকে। জীবনে আসে কঠিন সংগ্রাম। নীরব কষ্ট নীরব অভিমান বুকের কোণে লুকিয়ে রেখে আবারও আসে সকাল, শুরু হয় জীবনের পথ চলা। শত ব্যস্ততার মধ্যে এগিয়ে চলে প্রবাসীদের ব্যস্ত জীবন।
প্রবাসীদের যাপিত জীবনের জাঁতাকলের নিষ্পেষণে কত কোমল হৃদয়ে কত কান্না লুকানো, লুকানো কত বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস হাহাকার! দেশের মানুষের অভাব–অনটনের কথা শুনতে শুনতে নিজের কষ্টের কথা কান্নার কথা আর কখনোই হয় না বলা। তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলে জীবন। এমনি তুষের অনলে দগ্ধ হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয় সজলের জীবনে।

মা-বাবার বড় ছেলে সজল পরিবারের গরিবিয়ানা ঘোচানোর জন্য জীবনে প্রচণ্ড রকমের একটা ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। সোনার হরিণ ধরার বাসনায় বিভোর হয়ে ছুটতে ছুটতে একদিন ভিসা হয়েছিল, কিন্তু টিকিটের পয়সা ছিল না ওর কাছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে বিমান ভাড়া কর্জ করার সময় সজল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে একবার স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় ঢুকতে পারলে আর কোনো দিন ফেরা নয়।

তিন ভাই–তিন বোন আর বাবা-মা নিয়ে সজলদের বড় পরিবার। সবাই তাকিয়ে আছে বড় ছেলের ওপর। সেটি উপলব্ধি করতে পেরেই প্রকল্পের মেয়াদ ভিত্তিক কাজ ফেলে রেখে ভাগ্যের অন্বেষণে সে পাড়ি জমিয়েছিল সোনার হরিণের আশায়।

লক্ষ্য স্থির রেখে ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়েছিল সে। শুরু হয়ছিল জীবনযুদ্ধ। আজ সেই রক্তঝরা কষ্ট আর সেই বেদনার বালুকাবেলার দিনগুলির কথা মনে করতে চায় না সে। কিন্তু সেই দুঃখ–স্মৃতি বড় নির্মম। তা থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। বেদনার কোনো নিস্তার না থাকায় মাঝে মাঝে বিষাদে ভরে ওঠে ওর মন। জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরে যেদিন সে প্রথম এসে নেমেছিল, তখন ডিসেম্বর মাস। খ্রিষ্টানদের বড়দিনের ছুটির সময়। আমেরিকায় নিজের এমন কেউ নেই যে তাকে নিতে আসবে। তবুও থামেনি সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটুকু সম্বল করে আর দুরন্ত যৌবনকে পুঁজি করে সে পাড়ি জমিয়েছিল ডলারের দেশ আমেরিকায়।

ইমিগ্রেশনের ফরমালিটিজ শেষে বাইরে বেরোতেই প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি, হঠাৎ আচমকা একটি ধাক্কা লেগেছিল শরীরে। ধাক্কাটি ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডার, ঝাঁকুনিটি ছিল কনকনে হাড় কাঁপানো শীতের। প্রচণ্ড এই শীতে কীভাবে বাইরে বেরোবে কীভাবে কাজ করবে, সেই চিন্তা পেয়ে বসেছিল তাকে। কিন্তু সব অসম্ভব ব্যাপারগুলি ধীরে ধীরে একদিন সম্ভব হতে থাকে। বাইরের নিউজ স্ট্যান্ডের ১২ ঘণ্টা কাজে শরীরের রক্ত ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম হতে দেখেও দমে যায়নি সজল।

চরম দুঃখের দিনে ভয়াবহ কষ্টের দিনে সে বরাবরই অভাবী পরিবারের কথা মনে করেছিল। স্মরণ করেছিল বাবার সংগ্রামী জীবনের কথা। বাবার আদর্শ বুকে ধারণা করে যুদ্ধে এসেছিল সজল। ধীরে ধীরে সব কষ্ট হজম করতে করতে সহজ হতে থাকে জীবনের পথচলা। অতীব কষ্টার্জিত ডলার দেশে পাঠিয়ে ঘরে ফেরার সময় যে অনাবিল আনন্দ, সেই খুশি সেই ভালো লাগা তাঁকে আরও এগিয়ে দিয়েছিল সমুখে। রাস্তার ধারে পার্ক করা সারি সারি মূল্যবান গাড়িগুলি পড়ে থাকে, কেউ ধরে না, তার চোখে সেটাও ছিল প্রথমে এক দারুণ বিস্ময়!
সেই রকম হাজারো বিস্ময় নিয়ে সজলের অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে জমা পড়েছিল অনেক নুড়ি। আর এই নুড়ি জমতে জমতে একদিন তারই পাহাড় হয়েছিল ওর ট্যাক্সি জীবনে। ম্যানহাটনের অতি দ্রুত শহরে সে একদিন শক্ত হাতে ট্যাক্সির স্টিয়ারিং ধরতে সক্ষম হবে সেটিও তাঁর ধারণায় ছিল না। অথচ একদিন তা–ই হয়েছিল।

সারা বেলা নিউইয়র্ক সিটিতে ট্যাক্সি চালিয়ে শুরু হয়েছিল কাঙ্ক্ষিত উপার্জন। সপ্তাহ শেষে সেই উপার্জিত ডলার দেশে পরিবারের কাছে পাঠানোই ছিল ওর জীবনের প্রধানতম সাধনা-তপস্যা। এই সাধনায়ও ছিল অনেক চড়াই–উৎরাই। ছিল একেকটা দিনের একেক রকমের অভিজ্ঞতা। একদিন হঠাৎ ঘটেছিল এমনি একটি ঘটনা। সজল তখন এস্টোরিয়াতে থাকে। বাঙালিদের প্রথম বেড়ে ওঠা আবাস স্থলের ভেতরে এই এস্টোরিয়া ছিল অন্যতম। খুব তাড়াতাড়ি শহরে কাজে যাওয়ার জন্যই এস্টোরিয়া ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা । সেই এস্টোরিয়া থেকে খুব ভোরে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। পাখি ডাকার আগে সজলরা এসে ডেকে তোলে ম্যানহাটনের মানুষকে।

এমনি এক ভোরে কাজে বেরিয়েছে সে। হঠাৎ রাস্তার মোড়ে একটি মেয়ে হাত উঁচিয়ে ট্যাক্সি খুঁজে চলেছে। ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়াল সে। মেয়েটি উঠে জানাল যে সে ম্যানহাটনে যাবে। মেয়েটির পরনে হাসপাতালের নার্সের পোশাক। হাসিমুখ। টগবগে এক তরুণী। চলতে চলতে সজল জানতে চাইল প্রতিদিন এই সময়ে সে কাজে আসে কি না। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে হেসেছিল মেয়েটি। ঝকঝকে মুক্তার মতো হাসি।

সজলের লোভ হলো প্রতিদিন এমন চাঁদমুখীর হাসি দেখার। বড় লোভ হলো প্রতিদিন ভোরে এমন একটি পাখির কিচিরমিচির গান শুনতে শুনতে শহরে আসার। প্রতিদিন খুব ভোরে দেখা হওয়ার দুর্দান্ত সেই আকাঙ্ক্ষাই তখন কানে কানে এসে বলে যায়, ‘দুরন্ত যৌবন এখন সজলের ট্যাক্সি’। যৌবনের সেই দুরন্তপনায় ভর করে সকল দ্বিধা-সংকোচ সরিয়ে ফেলে, ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটির যাওয়ার সময় সজল জানিয়েছিল যে, ‘কাল ভোরে আজকের এই সময়ে সে মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করবে’।

মেয়েটির চোখ সেদিন হেসে বলেছিল, ‘দেখা হবে কাল সকালে আজকের নির্ধারিত সময়ে।’ পরের দিন আরও একটু আগে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে সজল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়েছিল মেয়েটির উদ্দেশে। ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষায় রইল তার জন্য। একটু পরেই সে দেখতে পেল পাশের কফিশপ ‘ডানকিন ডোনাট’ থেকে বেরিয়ে আসছে মেয়েটি। দুই হাতে দুটি কফি কাপ নিয়ে হাসি মুখে এগিয়ে আসছে সজলের দিকে।
কাছে আসতেই ড্রাইভিং সিটে বসে জানালার কাচ নামিয়ে কফি কাপ নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে সে।

সজল ভেবেছিল মেয়েটি হয়তো পেছনের সিটে বসবে। কিন্তু না। সব ভাবনাকে পেছনে ফেলে মেয়েটি সেদিন খুলেছিল সজলের সামনের দরজা।
শুভ সকাল, জানিয়ে মেয়েটি বসল সজলের পাশে। কিছুক্ষণ নীরবতা। গাড়িতে কফির গন্ধ। কী বলবে ভাবছে সজল। একজন তরুণীকে নিয়ে একজন ট্যাক্সি চালক যুবক তখন সাঁই সাঁই করে এস্টোরিয়া থেকে ম্যানহাটনের পথে।

শেষে নীরবতা ভেঙে মেয়েটিই জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
‘সজল’।
‘তুমি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছ ?’ আবারও প্রশ্ন মেয়েটির।
চোখে বিস্ময় নিয়ে সে জানতে চাইল, ‘তুমি জানলে কীভাবে?’
কফিতে চুমুক দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘তোমার দেশের অনেক মানুষ এখন ট্যাক্সি চালায় তাই অনুমান করলাম’, বলেই হাসছে মেয়েটি।
সজল জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
মুখের সেই জাদুমাখা হাসির রেশ রেখেই মেয়েটি বলল, ‘জুলিয়ার্ড রবার্টস।’
সে বলল, ‘বাহ! খুব সুন্দর, চমৎকার নাম!’
জুলিয়ার্ড বলল, ‘ধন্যবাদ তোমার প্রশংসার জন্য।’
তখন সজলের প্রশ্ন, ‘আমি কি তোমাকে শুধু জুলিয়ার্ড নামে ডাকতে পারি?’
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল জুলিয়ার্ড।
আবারও ওর প্রশ্ন, ‘তুমি কোনো দেশ থেকে এসেছ?’
জুলিয়ার্ড বলল, ‘আমার বাবা-মা মেক্সিকো থেকে এদেশে এসেছিল, তবে আমি এখানে জন্মেছি।’
সজল জানতে চাইল, ‘তুমি কি স্প্যানিশ ভাষা বলতে পার?’
কফিতে আবারও চুমুক দিয়ে জুলিয়ার্ড বলল, ‘হ্যাঁ পারি। আমি আমার বাবা-মার কাছে শিখেছি।’
সজল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি তোমার বাবা-মার সঙ্গেই থাক?’

একটু নীরবতা একটু আনমনা হলো জুলিয়ার্ড। জবাবে বলল, ‘না। আমার বাবা রোড অ্যাকসিডেন্ট মারা যাওয়ার পর আমার মা একদিন তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলে যায় তাদের বাসায়। আমি আমার বাবার বাড়িতে থাকি।’

জুলিয়ার্ডের বাবার এমন মৃত্যুতে মনটা খারাপ হলো সজলের। অনেকক্ষণ কারও মুখে কোনো কথা ছিল না। জুলিয়ার্ড খুব স্বাভাবিকতা নিয়ে কফি পানে ব্যস্ত। এরই মধ্যে ওরা হাসপাতালের সামনে। জুলিয়ার্ড ভাড়া দিতে গেলে সে বলল, ‘তোমাকে ভাড়া দিতে হবে না।’ জুলিয়ার্ড তখন জোর আপত্তি নিয়ে বলল, ‘না না তা হবে কেন? এটি তো তোমার কাজ।’ সজল হাসি মুখে বলল, ‘সেটি সত্য। তবে তুমি আমার এখন আর যাত্রী নও। তাই আমি ট্যাক্সি মিটার চালু করিনি। কাজেই কীভাবে আমি তোমার কাছে পয়সা নিই বল?’ জুলিয়ার্ড হাসতে হাসতে পলকহীন সজলের চোখের দিকে চেয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে তখন। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে জুলিয়ার্ড বলল, ‘তোমার দিনটি খুব ভালো কাটুক। কাল সকালে আবারও দেখা হবে।’

সজল হাসি মুখে হাত নেড়ে বিদায় নিল। শুরু হলো ওর ভাবনা। শুরু হলো ওর আজকে অন্যরকম ট্যাক্সিদিন। সারা বেলা মনের আনন্দে জুলিয়ার্ডের কথা মনে করতে করতে কাটে ওর সময়। সততা, নিষ্ঠা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে তাঁর আর্থিক অবস্থা। জুলিয়ার্ডকে তখন ওর ভাগ্যদেবী মনে হতে থাকে। আবেগি সজল একটুতেই স্বপ্ন দেখে। ভাবে জুলিয়ার্ডের সঙ্গে রঙিন কত স্বপ্নের কথা। আবার নিজের অবস্থানের কথা বিবেচনা করে সংযত করে নিজেকে। তবুও রাত জেগে জেগে জুলিয়ার্ডের কথা মনে হয় ওর। এভাবেই ভোরের বাতাসে ভেসে যাওয়া দুর্দান্ত এক ভালো লাগা নিয়ে শুরু হয়েছিল ওদের সপ্তাহে পাঁচ দিনের পাঁচমিশালী কথোপকথন।

প্রতিদিন ভোরে দুই হাতে দুটি কফি কাপ নিয়ে জুলিয়ার্ড দাঁড়িয়ে থাকে ওর জন্য। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল সজল-জুলিয়ার্ডের নির্মল বন্ধুত্ব। কোনো এক ভোরে জুলিয়ার্ডকে মনে হতো শিউলি ফুল। কোনো এক ভোরে মনে হতো স্নিগ্ধ হাসনাহেনা। কোনো এক ভোরে মনে হতো বেলি ফুলের সুবাস। অথবা কোনো এক ভোরে মনে হতে মন–মাতানো বকুলের সৌরভ।

এভাবেই এক ট্যাক্সি ড্রাইভার তাঁর পাশের সিটে বসে থাকা এক বিদেশিনীকে আবিষ্কার করেছিল কবিমন দিয়ে। কাছে এসেছিল রাজা মন নিয়ে। ভোরের পাখির কিচিরমিচির গানে গানে সজল সুর বেঁধেছিল ভীষণ সংযমী হয়ে খুব নীরবে সংগোপনে।

এভাবেই কোনো কোনো ভোরে কুয়াশায় ঘেরা অন্ধকারে, কোনো কোনো শরতের ভোরে, কোনো কোনো শীতের সকালে, কোনো কোনো গরমের প্রাভাতিক হিমেল হাওয়ায় অথবা ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা পাশাপাশি বসে কাজে চলেছিল। পাশাপাশি বসে দেখেছিল দুজন–দুজনের চোখের আলোয়। কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে ওরা কোনো কোনো ভোরে আধো আলো–আধো আঁধারে উথাল-পাতাল সমুদ্রের ঢেউ বুকের কোণে লুকিয়ে রেখেছিল সযতনে। তবুও অন্যমনস্কভাবে কোনো কোনো সময়ে জুলিয়ার্ডের হাতের পরশ পেয়েছে সে। কখনো কফি কাপ নিতে গিয়ে কেঁপেছে সজল। যৌবন তখন ওদের। তাই হয়েছিল ওরা রোমাঞ্চিত ক্ষণে ক্ষণে। এক কাপ কফি যেন এক পেয়ালা আকাশের নীল! এমনি প্রীতিময়ী জুলিয়ার্ডের ভালো লাগা উপহার পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল সজল। বলিষ্ঠ হয়েছিল ওদের বন্ধুত্ব। এভাবেই প্রতিদিন ভোরের বিশুদ্ধ হিমেল হাওয়ায় ড্রাইভার সজল আর নার্স জুলিয়ার্ড এসে মিলেছিল ইস্ট রিভারের জলে। সজলের আবেগী মন তখন লাগামছাড়া ঘোড়া যেন। কখনো কখনো দুনিয়াকে নিয়ে কবিতা লিখেছে সে। মেক্সিকোর বনলতা সেনকে নিয়ে সজলের কবিতা তখন নিউইয়র্কের আকাশে-বাতাসে। এমনি ভাবে বেড়ে উঠেছিল ওদের বন্ধুত্ব। সব সম্পর্কের হয়তো কোনো নাম দেওয়া যায় না। যেমন ওরাও পারেনি জুলিয়ার্ড-সজল সম্পর্কের কোনো নাম দিতে। এমনি করে চলতে চলতে কোনো এক ভোরের বাতাসে জুলিয়ার্ড হয়েছিল কিছুটা আনমনা, কিছুটা গম্ভীর, কিছুটা অন্যরকম। জুলিয়ার্ডের লাল চোখের গভীরে কিসের যেন হাতছানি। হঠাৎ জুলিয়ার্ড সজলকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাল রাতে তোমাকে ফোন করেছিলাম তুমি ফোন রিসিভ করোনি কেন ?’
হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা সজল। কী বলবে পায় না উত্তর। সজল একটু ভেবে বলল, ‘আমি তো কোনো রিং টোন শুনিনি।’ জুলিয়ার্ডের চোখে তখন আলোর ঝিলিক। জুলিয়ার্ড বলল, ‘তোমার ফোনে মিসড কল পাও কি না এক্ষুনি পরীক্ষা কর?’

সজল দেখল ঘটনা সত্য। গভীর রাতে জুলিয়ার্ড এর মিসড কল! কিন্তু কেন?? অনেকক্ষণের নীরবতা ভেঙে জুলিয়ার্ড বলল, ‘কাল রাতে আমার ঘুম আসছিল না। বহু চেষ্টা করে যখন ঘুমোতে পারিনি, তখন তোমার কথা মনে হলো। তোমার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে হলো। তাই তোমাকে ফোন করেছিলাম। আমার বড় বেশি নির্ঘুম কেটেছে কাল রাত।’
রিং টোন শুনতে না পাওয়ায় সেদিন খুব আফসোস হয়েছিল সজলের। তবে সে আফসোস আর বেশি দিন করতে হয়নি ওকে। এরপর হাজারো রকমের কথা বলতে গিয়ে ওদের নির্ঘুম কেটেছিল অনেক রাত। কথা বলতে বলতে ওরা রোমাঞ্চিত হয়েছিল বারবার। কখনো কখনো ওরা গভীর রাতে পানশালায় মুখোমুখি বসে কাটিয়েছিল বহু নির্ঘুম রজনী। এক সময় টালমাটাল পায়ে ভর করতে করতে ঘরে ফিরেছিল ওরা। তারপর আর কেউই মনে করতে পারেনি সেই রাতের জোনাকি বাসরের কথা!!

একদিন অনেক কথার মাঝে সজলের কোনো ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস নেই জেনেছিল জুলিয়ার্ড। সেদিন দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ ছিল সে। একটা প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়-তুফানে জুলিয়ার্ড যে লন্ডভন্ড হয়েছিল, সেদিন খুব সহজেই সেটি বুঝেছিল সজল।

সেই লন্ডভন্ড দুনিয়াকে নিয়ে সজল আর বেশি দূরে এগোতে পারেনি। এরপর জুলিয়ার্ডের নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার জন্যই সজলের রঙিন আকাশ এসে ঢেকে দিয়েছিল গাঢ় কুয়াশায়।
একদিন এমনি গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা ভোরে সজল বেরিয়েছিল জুলিয়ার্ডকে পিকআপ করতে। জুলিয়ার্ডের বাসার কাছে আসতে না আসতেই সে দেখতে পায় দুটি মানুষ জড়াজড়ি করে দাঁড়ানো। আরও কাছে আসতে সজল দেখে জুলিয়ার্ড। সঙ্গে একটি যুবক লেপটে আছে জুলিয়ার্ডের বুকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে গেল ওর মাথায়। কী করবে ভেবে পায় না সে। সজল থামল ওদের কাছাকাছি। ওরা তাড়াতাড়ি সজলের ট্যাক্সির ভেতরে ঢুকল। ভীষণ জোরে দরজা বন্ধ করল ছেলেটি। ধাক্কাটা সোজা সজলের মাথায় গিয়ে আঘাত হানল আরও দশগুণ জোরে।
সজল নির্বিকার। শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরেছে; তবুও কাঁপছে সজল। জুলিয়ার্ডই প্রথমে বলে উঠল, ‘হাই সজল! গুড মর্নিং। দিস ইজ ভিকি। হি ইজ কামিং ফ্রম ইন্ডিয়া, মাই লাভিং বয়ফ্রেন্ড’, বলেই ওরা হেসে উঠল। পেছনের সিটে তখন জুলিয়ার্ড-ভিকির হাসির শব্দ, আর সামনে সজলের ইঞ্জিনের গর্জন ভেসে যাচ্ছিল ইস্ট রিভারের জলে। সেদিনের সেই ইঞ্জিনের বিকট গর্জন আর আজকের এই বানভাসি কঠিন বিষাদে ভেসে যাওয়ার ভেতরে কোথায় যেন মিল খুঁজে পায় সজল। সেদিনের জুলিয়ার্ড আর আজকের শার্লিনকে কেবলই বিদেশিনী মেম ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ওর। পানশালায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা সেদিনের জুলিয়ার্ডের শরীর, আর আজকের শার্লিনের এই নরম হাতের উষ্ণ পরশের প্রচণ্ড ধাক্কায় বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়া কষ্ট নিয়ে সজল আবারও ফিরেছিল নিজেরই দিকে।

দীর্ঘদিন পর সজলের আজকের এই নিজের দিকে ফেরার সময় হঠাৎ করে দার্শনিক সক্রেটিসের ‘নো দাইসেল্ফ’ তত্ত্বটি মনে পড়েছিল। মনে পড়েছিল দেশের কথা। মনে পড়েছিল শৈশব-কৈশোরের কথা। মনে পড়েছিল বাড়ির পাশের প্রিয় নদীটির কথা। মনে পড়েছিল লাল-সবুজের কথা। মনে পড়েছিল প্রিয় জননী তোমার কথা। একদিন তুমি বলেছিলে, ‘নিজের ভেতরে খুলে দেখ দু’নয়ন, ডাকো তুমি বিষাদে নিষাদে নিরঞ্জন!’