দেবী: একটু অন্য দৃষ্টিতে

হুমায়ূন আহমেদ। আনন্দ-বিনোদনের যেকোনো মাধ্যমে তিনি অনন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র। নাটক-সিনেমা বিপণন করার জন্য এই একটি নামই যথেষ্ট বাঙালি দর্শকের কাছে। হুমায়ূন আহমেদের এক অনবদ্য সৃষ্টি মিসির আলি। চরিত্রটি জনপ্রিয়তায় হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে খুব কম না! জয়া আহসানের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য এবং অভিনয়, চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ের প্রতি মানুষের ভালো লাগা, সিনেমাটি সরকারি অনুদানে নির্মিত—এসব উপাদান যোগ হওয়ায় এটি দেখতে মানুষের হলে যাওয়ারই কথা। হয়েছেও তা-ই। বাড়তি পাওনা হিসেবে ছিল অনুপম রায়ের গান। অনম বিশ্বাসের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘দেবী’ সিনেমাটি তৈরি। বিপণন বিভাগ সব কটি বিষয়ই দর্শকের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। অভিনব আর বৈচিত্র্যময় প্রচারণায় মুগ্ধ দর্শক দলে দলে হলে গিয়ে হল পূর্ণ করেছেন। বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা না হয়েও বাণিজ্য করেছে সিনেমাটি। ব্যবসাসফল হলেই যে একটি সিনেমা ভালো সিনেমা হিসেবে পরিগণিত হবে, তা নয়। 

মিসির আলি প্রথমবার এই সিনেমার অন্যতম একটি আকর্ষণ। সিনেমাটি শুরু হয় তাঁকে দিয়ে। প্রথম দেখাতে চঞ্চল চৌধুরীর গেটআপ-মেকআপ মিলিয়ে মিসির আলি হিসেবে ভালো লাগে। কিন্তু তিনি যখন কথা বলা শুরু করেন, তখন দেখা যায় চঞ্চলের কণ্ঠে মিসির আলির মতো আত্মবিশ্বাস নেই। আরেকটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, মিসির আলির দৃষ্টি যেমন, চঞ্চলের তা নয়। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল এবং একটু শ্লথগতিতে হাঁটা ছাড়া মিসির আলির তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ে পাওয়া যায়নি। তবে স্বভাবগত ভালো অভিনয়ের কারণে চঞ্চল চৌধুরীরূপে মিসির আলিকে বেখাপ্পা লাগেনি।
জয়া আহসানকে পর্দায় প্রথম দেখানোর সময় হামিং ও দুটি দোলনার স্লোমোশন শটে যে অপার্থিব আবহ তৈরি করা হয়েছে, তা অসাধারণ! জয়া আহসানের সৌন্দর্য ও অভিনয়ে দর্শক এতটাই মুগ্ধ যে ‘তাঁকে দেখলেই ভালো লাগে’ এমন একটা ভাব ছিল হলের ভেতর ও বাইরের দর্শকদের। পরিচালকও তা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সিনেমাটোগ্রাফার কামরুল হাসান খসরু ক্লোজ ও মিড ক্লোজেই তাঁকে সবচেয়ে বেশি দেখিয়েছেন। জয়া আহসান পর্দার ২৬ বছর বয়সী রানুতে দারুণ মানিয়ে গেছেন। রানুর প্রত্যেক দৃশ্যে যেন কিছুটা আলাদা যত্নের ছোঁয়া। প্রতিদিন ইস্তিরি করা বর্ণিল সুন্দর শাড়ি পরিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হয়েছে জয়া আহসানকে। কোন যুক্তিতে? সিনেমার প্রযোজক বলে নাকি? কিশোরী রানুর চরিত্রে লাবণ্য চৌধুরীও ভালো করেছেন।
গাঢ় সবুজ কাঁঠালগাছের নিচে ধূসর নীল রঙের শাড়ি পরে জয়া আহসান বসে আছেন; তাঁর সামনে লক্ষ্মীপ্যাঁচা। পেছনে অশরীরী ছায়ার উপস্থিতি। অসাধারণ দৃশ্য। পটে আঁকা ছবির মতো মনে গেঁথে আছে। রঙের এই সমন্বয় দেখে বোঝা যায়, অনম চারুকলার ছাত্র! আলো-আঁধারির খেলায় এবং হরেক রকম শব্দে দারুণ ভৌতিক আবহ তৈরি করতে পেরেছেন অনম বিশ্বাস।
সিনেমা শুরুর অন্তত ৩২ মিনিট পর্যন্ত কোনো গতি ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের চিরায়ত নাটকের মতোই কিছু হাস্যরসের মাধ্যমে গল্প এগিয়ে যায়। চেয়ারে কমোড আকৃতি ও তাতে গোলাপ চাষে দর্শক ব্যাপক মজা পেয়েছেন। তবে ‘হারবাল মেডিসিনের দোকান’ নিয়ে যে স্থূল হাস্যরস তৈরি করা হয়েছে, তা অন্য ভাবে করতে পারলে রুচিশীল দর্শকেরা স্বস্তি পেতেন। সিনেমায় মিসির আলি ও রানুর সাক্ষাতে গতি আসে। এর আগ পর্যন্ত পরিচালক সিনেমার চরিত্রগুলো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
রানুর স্বামী আনিসরূপী অনিমেষ আইচ। ‘দেবী’ উপন্যাসে তিনি একজন সাদামাটা সাধারণ স্বামী; যিনি স্ত্রীকে ভালোবাসেন। দায়িত্বপরায়ণ এবং তিনি তাঁর ভেতরের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন না। কিন্তু ‘দেবী’ সিনেমায় নির্মাতা অনিমেষ আইচ যে অভিনয় করেছেন, তা নিতান্তই ভাবলেশহীন, নিষ্প্রভ ও নির্বিকার। তাঁর সংলাপ উচ্চারণ এবং বলায়ও জড়তা ছিল। অনিমেষের এই খারাপ অভিনয় অন্য ভালো অভিনেতাদের আক্রান্ত করেছে। অভিনয় মূলত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। অনিমেষকে যে দুজনের সঙ্গে পর্দায় বেশি সময় দেখা গেছে তাঁরা দুজনেই ভালো অভিনয়শিল্পী—জয়া আহসান ও চঞ্চল চৌধুরী। অনিমেষ তাঁদের দুজনের তালে অভিনয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর দুর্বল ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে জয়া আহসানের ঠিক অভিনয়কেও অনেক সময় অতি অভিনয় মনে হয়েছে।
পুরো সিনেমায় প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে একমাত্র নিলু চরিত্র রূপদানকারী শবনম ফারিয়াকে যথাযথ মনে হয়েছে। তাঁর মেকআপ-গেটআপ, অভিনয় ও কণ্ঠস্বর অসাধারণ। আমার বিশ্বাস এই সিনেমার অভিনয়ে তাঁর ভক্তকুল বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে পরিচালক তাঁর চরিত্রটিকে মজবুতভাবে গঠন করতে পারেননি। নিলু কেন হীনম্মন্যতায় ভোগে, তার বর্ণনা ‘দেবী’ উপন্যাসে দেওয়া ছিল। তাঁর ছোট বোন অনেক সুন্দরী ও তার অনেক বন্ধুবান্ধব। পক্ষান্তরে নিলু দেখতে অসুন্দর ও তাঁর কোনো বন্ধু নেই। নীলুর ছোট বোন বিলু চরিত্রে অহনাও ভালো করেছেন। বিলুর বন্ধুবান্ধবের একটি দল দেখালে দুটি চরিত্রই আরও ফুটে উঠত। আনিস সাবেত ওরফে ইরেশ যাকেরের চরিত্রটির কোনো আগা-মাথা নেই। শেষ দৃশ্যে বোঝানো হয়েছে তিনি একজন সাইকোফ্যান্ট। অথচ পুরো সিনেমার সংলাপে অথবা তাঁর আচরণে তার চিহ্নটুকু নেই। ইরেশ যাকেরের যে ‘আস্তানা’ সিনেমায় দেখানো হয়েছে তা তৃতীয় শ্রেণির বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় দেখানো হয়।
সিনেমার শেষের দিকে পরিচালকের এত তাড়া কিসের ছিল? পুরো সিনেমায় দেখানো হয়েছে মিসির আলি তথা যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে জয়া আহসান অর্থাৎ রানু, যাঁর ভেতরে রুক্মিনী দেবী প্রবেশ করেছে; রানু সব সময় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে এসেছেন তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তার প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। না দেখে সব কটি চিহ্ন বলে ফেলা; অজানা মানুষের পুরো ইতিহাসসহ লটারিতে কত টাকা জিতেছে, তা বলে দেওয়া ইত্যাদি, যার কোনোটিই বাস্তব পৃথিবীতে কেউ কোনো দিন এমনভাবে ঘটতে দেখেনি। অনম বিশ্বাসের সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত আর মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার থাকেনি। এটি হয়ে উঠেছে অতিপরিচিত ভৌতিক সিনেমা বা নাটক। সিনেমাজুড়ে অশরীরী ছায়ার দিনে-রাতে বিচরণ। কেবল রানু নয়, এই অশরীরী দুই কিশোরীকে জিতু মিয়াও দেখতে পায়। বাড়িওয়ালি প্রথম দিন এসেই শুনতে পান নূপুরের শব্দ। শুধু যদি রানু এদের দেখতে ও শুনতে পেত, তবে এটি হতো রানুর অসুখ।
শেষ পর্যন্ত পরিচালক দর্শককে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন আসলেই রানুর ভেতরে রুক্মিনী দেবী প্রবেশ করেছেন। এবং তাঁর ক্ষমতা এমন যে তিনি কার্যকারণ ছাড়াই সাবেতকে মেরে ফেলেছেন শত সুচালো পেরেকের আঘাতে। অন্যদিকে বাঁচিয়েছেন নিলুকে। তিনি বাঁচাতেও পারেন, মারতেও পারেন। দেবীর মহিমা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পরিচালক সিনেমাটির বারোটা বাজিয়েছেন। সব মিলিয়ে ‘দেবী’ সিনেমাটি হুমায়ূন আহমেদের যুক্তির দুনিয়া থেকে পা বাড়ায় অন্ধবিশ্বাসের দুনিয়ায়। শেষ পর্যন্ত মিসির আলি তা সমাধান না করতে পেরে আত্মসমর্পণ করেন; যা কুসংস্কারের কাছে যুক্তির পরাজয়। এমন একটি ভৌতিক কাহিনিপ্রবণ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকে কেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আর্থিক অনুদান দিল? সরকারের পরিকল্পনা কি সাধারণ জনগণকে যুক্তি ও বিজ্ঞানমুখী করে গড়ে তোলো, নাকি কুসংস্কারে নিমজ্জিত করা? রুক্মিনী দেবী প্রকৃতি, জীবনীশক্তি আর নারীশক্তির প্রতীক। পরিচালক যদি যুক্তি দিয়ে দেবীর এসব মানবিক গুণ প্রতিষ্ঠা করতেন, তাহলে দেশের মানুষের কল্যাণ হতো আর সিনেমাটি হতো সর্বজনীন।