বাদশা নামদারের ইতালিয়ান সু

সময়কাল ১৯৮৮ সাল। সারা দেশ বন্যায় প্লাবিত। ওরস্যালাইন মার্কা গণতন্ত্রে দেশ চলছে। পত্রিকায় পয়সার বিনিময়ে দালাল সাংবাদিকদের বানানো অসৎ রাজনীতিবিদদের নিউজ। সঙ্গে সেনানিবাসের বিশেষ শাখার জেনারেলদের তৈরি ফরমায়েশি প্রতিবেদন। সবগুলো লাল ফাইল মার্কা ডেকচিতে নিয়ে ঘোঁটা আর ঘোঁটা। এতেই বেরিয়ে এল দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ সৃষ্ট নানা দল। তাঁদের নিয়ে নির্বাচন হল। আসল গণতন্ত্র প্রসব হল। বানাল হলো জি হুজুরের নানা বর্ণের দল। সব মিলিয়ে রমরমা অবস্থা। দলে এ আসে তো, ও চলে যায়। সবার এক তত্ত্ব। আমার ভাগ নিয়ে চলে গেলাম, তোমাদের ভাগ চট জলদি নিয়ে যাও।
এই আদর্শ আর ভাবনার ওপর দেশ ও গণতন্ত্র দুটোই বেশ ভালো চলছে। সব ক্ষমতার উৎস জনাব-ই, জেনারেল নির্বিকার। সাইকেল চালিয়ে অফিসে যান। রাজনীতিবিদ জবাই করার ফাইলে সই দেন। পাশাপাশি চলে সুন্দরী মেরির পদযুগলে ফুলেল শ্রদ্ধার্ঘ্য, রসিক বটে। ফাইল আগাতে হলে আত্মবিসর্জনের শর্তে রাজি হতে হয়। সে বিসর্জনের বীভৎস রূপ নিজ চোখে ১৯৯৮ সালে লন্ডনে দেখেছি।
এদের অনুগ্রহে একান্ত সহযোগিতায় দেশ আজও চলে। আশপাশের চামচারা হন্যে হয়ে জেনারেলকে খোঁজে। বলে আপনি ছাড়া দেশ অচল। চামচাদের তালিকায় কে নেই? আগুন ঝরানো লেখক, অন্যায়ের প্রতিবাদী, ডাকসাইটে আমলা—সবই আছেন। আমরা আমজনতাও সঙ্গে আছি। সময়মতো হাততালি দিতে তৈরি হয়ে থাকি। খুশি হয়ে বগল বাজাই। গলা ফাটিয়ে জিন্দাবাদ বলি। জোরে কিছু বলি না। কারণ আমরাও ভাগ নিয়েছি। নীল বোতলে সোনালি রঙের দ্রাক্ষারস। পাশে ষোড়শী বধূর অজানা বুনো সুবাস। এ বেলা দেশ আর দেশের জনগণ নিয়ে ভাবনা আর নয়। এসির ঠান্ডার মাত্রা বাড়ানো দরকার। সবই চলে খ্যাপা ষাঁড়ের শিঙে লাল রুমাল বেঁধে রাখার বুনো আনন্দে। উষ্ণ জলাশয়ে ডুব দেওয়ার শতভাগ তৃপ্তি। আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে।
প্রকৃতির খেয়াল হলো জেনারেলকে পাবলিকের কাতারে নিয়ে দাঁড় করাবে। পুরো দেশে বন্যা। আমাদের শহরে বন্যার পানি। পুরো শহর বন্যার পানির নিচে। শহরে একমাত্র চৌরাস্তায় কিছু জায়গা শুকনো। জেলা প্রশাসকের অফিসে সভা ডাকা হল। বাদশা নামদার আসবেন পানিবন্দী জনতাকে উদ্ধার করতে। তোড়জোড় শুরু হল। জলপাই রঙের গাড়ির বহর, শান্ত পানিবন্দী শহরে এল এক লালমুখো হাফ জেনারেলকে নিয়ে। শহরের হোমরা-চোমরাদের নিয়ে চার তারকার পোশাকে লালমুখো বস বসলেন কনফারেন্সে রুমে। কাউকে কথা বলতে দেন না। ধমকের সুরে কথা, সারাক্ষণ চলল বসের মেজাজি আলাপ।
সারাক্ষণ শুধু হুকুম। বলা হলো, যা বলব সব শুনতে হবে। শুনলেন সবাই—জেলা প্রশাসক, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ দু-তিন স্কুলের শিক্ষক আর শিক্ষিকারা। কারওর কোনো পরামর্শ শুনলেন না, ছড়ি হাতের লালমুখো একরোখা লোকটি। আদেশের সুরে দুই ঘণ্টাব্যাপী শুধু নির্দেশ আর নির্দেশ। হায়রে অভাগা দেশ। চৌকিদারেরা আজ দেশের মালিক। দেশ মাতা তুমি নীরবে সব সহ্য করলে, সঙ্গে দেশের ১০/১১ কোটি জনগণ মেনে নিল শতভাগ অবিচার। শহরে কোনো শুকনো জায়গা না থাকায় রাজকীয় উড়াল বাহন এসে নামল সিলেট-সুনামগঞ্জের হাইওয়ের এক চিলতে রাস্তায়। মাপ-জোক, হিসাব-নিকাশ সবই চলছে সময় ধরে। সঙ্গে আছেন জনা দশেক হাত কচলানো লোকজন। বাদশাহকে দেখেই শুরু হলো জি হুজুর, জি হুজুর বলার প্রতিযোগিতা। দূর হতে জনতা সব দেখে হাসে আর মজা পায়।
তৎকালীন পৌরপিতা, যিনি এখন না ফেরার দেশে, প্রচলিত মধুর এক সম্বোধনে বাদশাকে কাত করে ফেললেন। বাদশার ঢিলে চামড়ার মুখে এক নাম। নেক কাজ করো, ভালো কাজ করো, আখেরাতে ফায়দা হবে। আমরা সঙ্গীরা সমস্বরে বলি, ‘জি স্যার’, ‘জি স্যার’। কেন বলি নিজেও জানি না। সবাই ‘জি স্যার’ বলছে দেখে আমরাও বলি। মাথায় বুদ্ধি, মেধা সবই আছে। শুধু নেই বাদশাহ নামদারকে ঘায়েলের কোনো বিশেষ মন্ত্র।
দিনক্ষণ এসে সদর দরজায় উপস্থিত। চারদিকে হুলুস্থুল অবস্থা। রাজা উড়ে এসে অনেক কসরত করে নামলেন। জেনারেল ও পৌরপিতা এক সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চলছেন। সার্বিক অবস্থার ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা শুনতে শুনতে রাস্তার পূর্ব পাশ বরাবর গিয়ে থামলেন। বন্যার পানিতে ডুবু ডুবু রাস্তার এক পাশে অপেক্ষমাণ বিশেষ নৌযানে করে শহরের পূর্ব প্রান্তে কলেজ রোডে গাড়িতে চড়বেন। কালো পিচঢালা রাস্তা বরাবর হেঁটে এসে থেমে গেলেন নৌযান বরাবর। সঙ্গে সঙ্গে পাশে দাঁড়ানো সামরিক পোশাক পরিহিত এক সৈনিক হাতে করে নিয়ে এলেন এক জোড়া কালো রাবারের লম্বা বুটজুতা। বাদশাহ নামদার সামনের দিকে ঝুঁকে পায়ের চকচকে কালো ফিতাওয়ালা জুতাজোড়া খুলে বুটজুতায় এক এক করে দুই পা গলিয়ে দিলেন। পাশে দাঁড়ানো পরিচিত একজন বড় ভাই কানে কানে কী যেন বললেন সেই সৈনিক ভাইকে। দেখলাম সৈনিক ভাইটি চকচক করা জুতাজোড়া নৌযানের সম্মুখের পাটাতনে রেখে দিলেন সামরিক কায়দায়। নৌযান ছেড়ে দিল। পৌরপিতার পরনে সবুজ রেইন কোট। বাদশাহর পাশাপাশি বসা। আমরা ঠিক পরের স্পিডবোটে। ছোকরা এক সামরিক অফিসার কতক্ষণ পর কটমট করে আমাদের দিকে তাকায়। হয়তোবা ভাবছে, ওর লালমুখো বস তিন নম্বর স্পিডবোটে অথচ আমরা দুই নম্বরে কেমনে চড়লাম। তাদের ফর্মুলায় সবকিছুতে জলপাই রং আগে, পাবলিক পরে। অথচ এখানে উল্টো হল কেমনে।
স্বল্প সময়ে স্যারকে বহনকারী নৌযান কলেজ রোডে এসে থামল। তারপর সাঁ করে বিশেষ রঙের পাজেরো জিপে পুরোনো সার্কিট হাউসে। স্পিডবোট থেকে নেমে নৌযানে উঁকি দিয়ে দেখি সামনের ডেক পরিষ্কার। শুধু দু চারটে কাদায় মাখা পদচিহ্ন। চকচকে পাদুকা জোড়া সেখানে নেই। ভাবলাম মনে হয় স্যারের গাড়িতে আছে। এরপর কেঁদে কেঁদে স্যারের বরাবরের মত সব দিয়ে দেওয়ার মিথ্যা ভাষণ। দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে উড়ালযানে ফেরত চলে গেলেন রাজধানী ঢাকায়।
বেশ কিছু দিন পর। বন্যার পানি নেমে গেছে। শহরে সবকিছুই বরাবরের মত স্বাভাবিকভাবে চলছে। অঙ্গীকারের ফল লাল ফাইলের জট খুলে অনুদান আসতে শুরু হলে শহরে কাজ শুরু হলো। রাস্তাঘাট সংস্কারসহ শহররক্ষা বাঁধের উন্নয়ন ও বিবিধ কাজ। শহর উন্নয়নে সেবার অনেক কাজ হলো বটে।
এদিকে কয়দিন পর পৌরপিতার এক প্রবাসী বন্ধুর আগমন উপলক্ষে তাঁর বাসায় খাবারের আয়োজন হল। হাওরের পাশঘেঁষা বাসায় হু হু করে পরিষ্কার ঠান্ডা নির্মল বাতাস ঢুকছে। বড় আরামদায়ক ব্যবস্থা! মেহমান এলে শুরু হল মেহমানদারি। কিছুক্ষণ পর তলপেটে চাপ অনুভব হলে বাথরুমে যাচ্ছি। বেডরুম লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে হালকা হয়ে বাইরের ঘরে ফেরার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল, গৃহকর্তার নিজ খাটের নিচে সেই কালো চকচকে দামি বিদেশি জুতাজোড়া।
এখানে এল কীভাবে? কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে সন্দেহমুক্ত হলাম। না ঠিক আছে। বাদশাহ নামদারেরই জুতাজোড়া। মাথা নাড়তে নাড়তে বাইরের ঘরে গেলাম। গল্পে আর আড্ডার আমেজে সবাই মশগুল। ভাবলাম জট আগেই খুলে ফেলি। ঘরের কর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, জুতাজোড়া আপনার ঘরে কেমনে এল? রহস্যের হাসি দিয়ে বললেন, মায়া করে জুতা জোড়া উপহার দিয়ে গেছেন মহামান্য বাদশাহ নামদার।
আবার বেডরুমে গিয়ে জুতাজোড়া হাতে নিয়ে দেখি, বিশ্ববিখ্যাত জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান Hush Puppies-এর সদা হাস্যময় কুকুরছানার ছবি। নিচে লেখা ‘মেইড ইন ইতালি’। সুখতলিতে স্টিকার মারা; সেখানে লেখা ‘হাতে সেলাই করা’। জুতাজোড়া ফেরত রেখে আসতে আসতে ভাবলাম, কী এক বিশেষ ভাগ্যলিপি নিয়ে এই বাদশাহ নামদার ধরাধমে এলেন। যাই তাঁর সান্নিধ্যে আসে সবই হয় Spl stitching। চকচকে টাইট জুতা আরামে কয়েক দিন পরে সুবিধামতো সময়ে অন্যের কাছে সযত্নে রেখে দেন। তবে ভুলে যান না, অকৃতজ্ঞ নন। তাই পরেও মনে রাখেন। স্মরণ করেন। সুযোগ পেলে ডেকে এনে সঙ্গে নিয়ে দামি সময় সুন্দরভাবে কাটান। আড্ডা দেন, বন্ধুদের দাওয়াত দেন।
দামি সোফায় এলিয়ে বসা বিশেষ মেহমানকে দেখিয়ে বলেন, লক্ষ্মীটি একটি কথা বলি, ওর কোনো কথা শুনো না। ও একটি দুষ্ট ছেলে, তবে ভালো। কোনো ঝামেলায় নেই। শুধু মুখে মুখে নানা কথা বলে, মজা করে বলে। বাদশাহ নামদার লাজুক হেসে অতিথি সেবায় লেগে যান। যে বিষয়ে মহামান্য বড়ই অভিজ্ঞ। নিজে যেমন তা জানেন, তেমনি জানেন দেশের কোটি কোটি জনগণ।
জয়তু বাদশাহ নামদার। তাই আমরা আজও বলি, ‘খেলারাম, খেলে যাও।’