কিশোরীবেলার দুঃখগুলো

রিমঝিম আহমেদ নামের একজন একটা লেখায় লিখেছেন ‘আমার লাল মেয়েবেলা’। পড়ে মনে হলো বাংলাদেশের অধিকাংশ কিশোরী এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সময়টা পার করে।
ঋতু বা পিরিয়ড একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। নয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে এটি হয়ে থাকে। তবে কারও আট-নয় বছর বয়সেও হতে পারে। তাদের কোনো মানসিক প্রস্তুতি হওয়ার আগেই শুরু হওয়া বিষয়টি হয় বড় বিড়ম্বনার। পিরিয়ড না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। প্রথম পিরিয়ড হলে একটা মেয়ে আতঙ্কিত হয়। মেয়েরা এমনিতেই একটু ভিতু হয়। এক ফোঁটা রক্ত দেখলেই ভয় পায়। সেখানে আচমকা এত রক্ত নার্ভাস করে দেয়। আর যদি সেটা হয় কম বয়সে, তাহলে তো কথাই নেই। আমাদের সমাজে এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকেরা কথা বলেন না। মা, বড় বোনরাও অনেক সময় চুপ থাকেন। তাহলে শিশু মেয়েটি বিষয়টি জানবে কীভাবে? স্কুলের ক্লাস এইটের গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বইয়ে একটা অনুচ্ছেদ ছিল মাসিক ঋতুস্রাব। যে শিক্ষক পড়াতেন তিনি মনে হতো লজ্জিত। এসে বলতেন বইয়ের এত নম্বর পরিচ্ছেদ পড় সবাই। নিজেও গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু পড়তেন। এই বিষয়টি এইটের বইয়ে না, এটি হওয়া উচিত সিক্সের বইয়ে। আর এর মধ্যে আরও বিষয় যোগ করা উচিত। স্বাস্থ্যসম্মত ন্যাপকিন বা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। পরিষ্কার নরম কাপড় কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তাও বলতে হবে। এটি কোনো পাপ নয়। এ সময় অনেকে ভাবে পাপীদের এমন রক্তপাত হয়। তাই খাওয়া ছেড়ে মন খারাপ করে বসে থাকে। কারও কারও অরুচি হয়, কারও হয় ডিপ্রেশন। এগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলা প্রয়োজন। প্রতি মাসে নিয়মিত মাসিক হওয়াটা স্বাভাবিক। এটা কোনো রোগ নয়।
নিজের কিশোরীবেলার কথা মনে পড়ে। প্রথমে জানতামই না স্যানিটারি প্যাড যে কিনতে পাওয়া যায়। যখন জানলাম, তখন কেউ সংগ্রহ করে দেয়নি। নিজে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। কাপড়ের ব্যবহার বেশ জটিল ছিল। সঠিকভাবে কেউ শিখিয়েও দেয়নি। হাসিনা নামে আমার এক ক্লাসমেট ছিল, সে আমাকে একদিন পরনের ওড়না দিয়ে হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছিল। হাসিনার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। তার চেয়ে বড় কথা মা বা বড় বোনেরা যদি বিষয়টি নিয়ে না বলেন, একজন কিশোরী মেয়ে প্রথম কাপড়ে রক্তের দাগ দেখে রীতিমতো সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে না কী ঘটতে যাচ্ছে বা কী ঘটেছে।
আমাদের স্কুলড্রেস ছিল সাদা। ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন যে শিক্ষক, উনি বেশ কড়া। এক মেয়েকে পড়া ধরেছেন। পড়া বলার জন্য সে কিছুতেই দাঁড়ায় না। শিক্ষক তাকে ধমক দিয়ে দাঁড়াতে বললেন। সে ভয় পেয়ে যেই দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে তার জামার পেছন আর পায়জামা লাল হয়ে গেল। ওর পেছনে যারা বসে তারা চিৎকার করে উঠল সমস্বরে। আর তখন সেই শিক্ষক বুঝতে পারলেন না দাঁড়ানোর কারণ। পরে এসকর্ট ধাই (বাসা থেকে আনা নেওয়ার জন্য যে ধাই ছিল) মেয়েটিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে। সেই স্মৃতি আজও আমাকে মর্মপীড়া দেয়। অথচ এখানে আমেরিকায় প্রতিটি স্কুলে লেডিস টয়লেটে স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিন আছে। ৫০ সেন্ট দিলে প্যাড বের হয়ে আসে। মেয়েদের এগুলো বলে দেওয়া হয়।
আমিও জানতাম না। আমার মেয়ে এসে আমাকে জানাল। মেয়ের পিরিয়ডের ডেট এলে বলি স্কুলব্যাগে দুটো প্যাড নিয়ে যাও। মেয়ে বলে, না মা আমার কাছে কোয়ার্টার আছে। লাগলে নিয়ে নেব মেশিন থেকে। দেশে থাকতে মাসের এই সময়টায় আমাদের বুক দুরু দুরু করত, আর এখানে কোনো টেনশন নাই।
কিছুদিন আগে আমার স্থপতি বন্ধু কবিতা চাকমার সঙ্গে কথা হলো। ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে থাকে। পাহাড়ি মেয়েদের ঋতুকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিন সমস্যা নিয়ে কাজ করছে ওরা। পাহাড়ি মেয়েরা যে থামি পরে তার কাপড়ের বুননটা শাড়ির মতো পাতলা না। পুরোনো কাপড় কোথায় পাবে। পাঁচ থেকে সাত দিন ওই মোটা কাপড় ব্যবহার করা দুঃসাধ্য। আর বর্ষাকালে কাপড় শুকানোও সমস্যা। তাই অস্ট্রেলিয়ায় বসে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে ওরা। হাইজিন ব্যাপারটা আসে পরে। প্রথমে প্রোটেকশন নেওয়া জরুরি।
আমাদের কিশোরীবেলায় পিরিয়ডের সময়টা বড় মনঃকষ্ট নিয়ে কাটাতাম। আমাদের ছেলেবেলায় সকাল-বিকেল ভাঁড়ে করে পানি তুলে দিয়ে যেত বাথরুমের বালতিতে নিমাইদা। সেই তোলা পানি ব্যবহার করা হতো মেয়েদের গোসল আর টয়লেটের জন্য। তবে কাপড়চোপড় পুকুরের পানিতে ধুয়ে আনতো বুয়ারা। পিরিয়ডের এই অসহায় মেয়েবেলা আমাকে এখনো মর্মপীড়া দেয়। রক্তমাখা কাপড়গুলো পুকুরে নিয়ে ধোয়া যাবে না; গোপনে ধুতে হবে। গোপন জায়গায় মেলে শুকাতে হবে। ধুতে গিয়ে বমি এসে যেত কখনো কখনো। চেঞ্জ করার দুশ্চিন্তায় বাথরুমে না যেয়ে বসে থাকতাম। আমার বন্ধুদের অভিজ্ঞতা আরও মর্মান্তিক। তোশকের নিচে মেলে দিত তারা ধুয়ে আনা সেই কাপড়। তোশকের তুলা শুষে নিত আর্দ্রতা। তখন পুনরায় ব্যবহার করা হতো। কিন্তু স্যাঁতসেঁতে ভাব থেকে যেত সেই কাপড়ে।
কৈশোর পার করে কলেজে ঢাকায় ভর্তি হয়ে প্রথম পরিচিত হলাম ‘কেয়ার ফ্রির’ সঙ্গে। প্রায় সাত বছর আমার সুরক্ষা দিয়েছিল এটি। তারপর এল ‘সেনোরা’। অত্যন্ত ভালো মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন। আজও মন কাঁদে যে বয়সে আমার ‘কেয়ার ফ্রি’ বা ‘সেনোরার’ দরকার ছিল, সেই বয়সে আমি বড় কষ্টে ছিলাম ভেবে। তাই সব কিশোরী মেয়ের মাকে বলছি আপনাদের মেয়েদের পিরিয়ডের সময় তাদের দিকে নজর দিন। আজকের কিশোরী ভবিষ্যতের মা। ভবিষ্যতের মায়েদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে মা-বাবা ভাই-বোন সবারই সচেতনতা থাকা দরকার। তবে মা অবশ্যই একটু বেশি সচেতন থাকবেন। স্কুলগুলোতে মেয়েদের যথাযথ ধারণা দিতে পারেন শিক্ষিকারা। ঋতুকালীন সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, পর্যাপ্ত খাবার খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। কারও কারও প্রচণ্ড পেট ব্যথা হয়। কারও খাবারে অরুচি হয়, কারও আবার পাসহ শরীরের স্পর্শকাতর অংশে ব্যথা হয়। প্রচলিত কুসংস্কার ও ভুল ধারণাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আজকের কিশোরীদের অর্থাৎ ভবিষ্যতের মায়েদের যত্ন নিতে হবে সবাই মিলে।