র্যাংকিজম: অসুখী ও অসুস্থ মনের পরিচয়

মিতু নিউইয়র্কে বসবাস করছেন প্রায় আট বছর ধরে। পড়াশোনা বেশি দূর করা হয়নি আর অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতার দরুন তিনি একটি বাঙালি রেস্টুরেন্টে সামান্য বেতনে কাজ করেন। দেখতে তিনি আর দশজন বাঙালি নারীর মতো হলেও পোশাক-আশাক ও চলন-বলনে একেবারেই সাধারণ। তবে তাঁর একটি বিশেষ গুণ রয়েছে, তিনি খুব ভালো গান করেন। গান করাটা তিনি ছোটবেলাতেই শিখেছিলেন তাঁর ছোট খালার কাছে। গানের জন্য তার ছোট খালা ছিলেন সেই সময়ের সামাজিক সংগীতানুষ্ঠানগুলোর অন্যতম আকর্ষণ।
যাই হোক, সম্প্রতি মিতু তাঁর সহকর্মীদের মাধ্যমে একটি সংগীত একাডেমিতে যুক্ত হন। মাঝে মাঝে তিনি বিভিন্ন আয়োজনে একাডেমিতে যাতায়াত করেন। একাডেমিতে নানান ধরনের মানুষের আনাগোনা। কেউ পোশাকে ‌অতি স্মার্ট, কেউ শিক্ষাগত যোগ্যতায়, আবার কেউ সামাজিকতায়। স্বভাবে শান্ত হওয়ার দরুন মিতু সেখানে গিয়ে আলোচনা-আড্ডায় খুব একটা বসেন না। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। প্রায় সময়ই মিতুকে একটা বিষয় খুব অস্বস্তিতে ফেলে, সেটা হলো অন্যদের আচরণ। একবার একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি চাকরি করেন?’ জবাবে মিতু রেস্টুরেন্টের কথা উল্লেখ্য করায় ওই ব্যক্তি মিতুকে পাশ কাটিয়ে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন। আরেকবার একজন তো বলেই বসলেন, ‘এসব থার্ড ক্লাস জায়গায় কাজ করেন কেন? ওখানে কি ভদ্র মেয়েরা কাজ করে?’
মিতু প্রায়ই লক্ষ্য করেন, তাঁর ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, বাহ্যিক চেহারা ও পেশার কারণে কেউ কেউ তাঁকে এড়িয়ে চলেন। মিতু যেন আলোকসজ্জার এই রং মহলে সবার আসন থেকে ভিন্ন আসনে অবস্থিত কেউ। ব্যাপারটা মিতুকে খুব মানসিকভাবে পীড়া দেয়।
সামাজিকভাবে মিতু যে সমস্যাটির মুখোমুখি তাকে বলা হয় ‘র‌্যাংকিজম।’ র‌্যাংকিজম একটি বিশেষ ধরনের অপরাধ যেখানে মানুষ পরিবার, সমাজ ও কোন প্রতিষ্ঠানে নিজের অবস্থান বা কর্তৃত্ব অনুক্রমের মাধ্যমে অন্যের প্রতি অপমানজনক, বৈষম্যমূলক বা শোষণমূলক আচরণ করে থাকে। র‌্যাংকিজম শব্দটি প্রথম ১৯৯৭ সালে ব্যবহার করে অবার্লিন অ্যালোমনি ম্যাগাজিন। তারপর শব্দটির ব্যবহার নিয়ে ফালের ২০০৩ সালে একটি বই লেখেন, নাম ‘সামবডিস অ্যান্ড নোবডিস: অভারকামিং দ্য অ্যাবিউজ অফ র‌্যাংক’।
র‌্যাংকিজম কোন নতুন ইস্যু নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, র‌্যাংকিজম তখনো আমাদের মনে ও সমাজে বিদ্যমান ছিল। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, এক গোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীকে, এক জাতি অন্য জাতিকে তখনো র‌্যাংকিজমের শিকার করেছে। র‌্যাংকিজম মূলত ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে ব্যবহার করে অন্যকে দুর্বল ও নিচু দেখাতে লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
র‌্যাংকিজম কোথায় নেই? পরিবারে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক মিলনায়তনে—সব জায়গায় আমরা নিজের সীমাবদ্ধতার জন্য অন্যের দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছি। আমরা প্রায়ই অফিসে বস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই। চাকরি হারানোর ভয়ে তবু চুপ থাকি। বৈধ কাগজের অভাবে আমরা কম বেতনে কাজ করি। এক কাজে নিয়োগ করে আমাদের দিয়ে সব রকমের কাজ করানো হয়। মালিক কর্তৃপক্ষ আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেন। এখানেও র‌্যাংকিজমের প্রভাব। প্রায়ই যোগ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছে আমাদের হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। যেমন সামাজিক মিলনায়তনে মিতুর ভিকটিমাইজ হওয়ার অন্যতম কারণ তার ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, তার ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস এবং অন্যদের তুলনায় হাইলি স্টাইলিশ না হওয়া। প্রায় নারী-পুরুষ এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রবাসে যখন একজন নর বা নারী অন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের তুলনায় পিছিয়ে আছেন, পোশাকে-কথায় গ্রাম্য ছাপ রয়ে যাচ্ছে, যখন তারা হাই সোসাইটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলোচনায় বসতে পারছেন না বা অ্যালকোহল-সিগারেট হাতে নিচ্ছেন না, যখন তারা বাইরের জগৎ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখছেন না তখন সেই নর-নারীকে আনাড়ি ভাবা হচ্ছে, তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ‘খেত’, ‘গেঁয়ো’, ‘আনকালচার্ড’ ভাবা হচ্ছে।
একটি সামাজিক মিলনায়তনে বা কোন অনুষ্ঠানে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করে নিজের সাফল্য বর্ণনায় ব্যস্ত হচ্ছেন। একজন নারী অন্য নারীকে তার স্বামীর গুণ-কীর্তনের সময় লক্ষ্য রাখছেন না, ওই নারীর স্বামী তাকে রোজ নির্যাতন করেন। একজন পুরুষ অপর পুরুষের কাছে গিফ্টেড অ্যান্ড ট্যালেন্টেড ক্লাসে সুযোগ পাওয়া তার সন্তানের কৃতিত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বুঝতেই পারছেন না যে, ওই পুরুষটির সন্তান অটিস্টিক এবং তিনি ওই পুরুষটির মনঃকষ্টের কারণ হচ্ছেন। ইচ্ছামূলক হোক আর অজ্ঞানবশত, আমরা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ জাহির করতে গিয়ে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করছি, অন্যকে হেয় করছি। সবাই যে এমন করছেন, তা নয়। তবে তুলনামূলকভাবে র‌্যাংকিজমের এই সংখ্যা একেবারেই যে কম, তাও নয়।
নিজের ক্ষমতায়নে অন্যকে ছোট করে দেখার পেছনে বহু কারণ আছে। অহংকার, ধৈর্যহীনতা, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক শ্রেণির মানুষ নিজেকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ জাহির করতে গিয়ে অন্যকে হেয় করে থাকেন। মনস্তাত্ত্বিক যে কারণটি এখানে লক্ষণীয় বলে অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন—তাঁরা নিজের পরিবারে কখনো হয়তো প্রশংসা পান না কিংবা নিজ পরিবারে তাদের গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না বলে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং যখনই তাঁরা অন্যকে সমানভাবে বিচার করতে পারেন, তাঁরা ভালো বোধ করেন। এখানে নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতার কারণটিকেও অস্বীকার করা যায় না। যদি কেউ নিজের সম্পর্কে অনিরাপত্তাবোধ করেন অর্থাৎ নিজের যোগ্যতা বা ক্ষমতা বিচারে সন্দিহান হয়ে থাকেন, তখন তাঁরা অন্যের ওপর আধিপত্য জোরদার করার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অন্যদের হেয় করে তারা মনে করেন, তাঁদের অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর ক্ষমতা আছে এবং তাঁরা তাদের নিরাপত্তাহীনতার নিজস্ব অনুভূতিকে ঢাকার চেষ্টা করেন।
শুধু যে দুর্বলদের ওপরই আমাদের এই আধিপত্য, তা নয়। অনেক সময় নিজের সমকক্ষ ব্যক্তিকেও আমরা হেয় করতে ছাড়ি না। এটা আমাদের মনের বিদ্বেষ বা প্রতিযোগিতামূলক হিংসা বলা যায়। অনেক সময় আমরা নিজেকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্বার্থপর হয়ে উঠি। আমরা অন্যের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হই। এটাও নিজের প্রতি অনিরাপত্তাবোধের কারণেই ঘটে।
র‌্যাংকিজম সৃজনশীলতাকে ব্যাহত করে, শেখার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে, সম্পর্কের আন্তরিকতাকে নষ্ট করে এবং আমাদের মনকে কলুষিত করে। র‌্যাংকিজম আমাদের অসুখী ও অসুস্থ মনের পরিচয় দেয়। র‌্যাংকিজম ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও গোষ্ঠীকে দুর্বল করে তোলে যা ত্যাগ করা একান্ত জরুরি। আমরা যদি উদার হতে পারি, যদি অন্যের অক্ষমতা, অযোগ্যতা বা সাফল্যকে সাদরে গ্রহণ করতে পারি, তবে র‌্যাংকিজমের মতো অপরাধের অনেকটাই দূর হবে বলে আশা করি।