শিশুর পরিচর্যায় আপনি কতটা সফল?

আমরা যাঁরা আমেরিকাতে বসবাস করছি, অল্পদিন হোক আর দীর্ঘদিন, আমরা সবাই চাই আমাদের সন্তানসন্ততি ভালো স্কুলে লেখাপড়া করবে। আমাদের সন্তানরা ভালো ফল করলে বা ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারলে স্বভাবতই পিতা-মাতা হিসেবে আমরা আনন্দিত হই, গর্বিত হই। আমাদের চেষ্টা সব সময়ই সন্তানের উচ্চশিক্ষা ও সাফল্য। কিন্তু শিশু-সন্তানের সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে আমরা কতটা জ্ঞাত বা সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর স্কুল-সংক্রান্ত নানাবিধ বিষয়ের ওপর আমরা কতটা গুরুত্ব আরোপ করি বা যত্ন নিই, সেটাই আমার আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
আমাদের পিতা-মাতারা যেমন করে আমাদের লালন-পালন করেছেন, স্কুলিং করেছেন, তা ছিল মুক্ত চিন্তা ও সাধারণ নিয়মের আওতাধীন। সন্তান পালনে তখনকার পিতা-মাতাদের ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম ছিল না, প্রশিক্ষণ বা কার্যকরী আইন ছিল না। তাদের থেকে এখনকার বাংলাদেশি মার্কিনি পিতা-মাতাদের সন্তান পালন ও স্কুলিং পন্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিংবা বলা যায় বাংলাদেশের পারিবারিক-সামাজিক সংস্কৃতি এবং স্কুল ব্যবস্থা ও নিয়মাবলি থেকে আমেরিকার সন্তান পালনের ধারা এবং স্কুল ব্যবস্থা ও নিয়মাবলি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে আমাদের সন্তানদের কেবল জন্ম দিয়ে ভাত-কাপড়-বাসস্থানের ব্যবস্থা করলেই বা স্কুলে পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ হয় না। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের সঠিক পরিচর্যার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়।
ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক হিসেবে যেমন পিতা-মাতার রয়েছে অগ্রাধিকার, পাশাপাশি অভিভাবক হিসেবে স্কুলে সন্তানের অর্জন, সাফল্য এবং ব্যর্থতায় সংশ্লিষ্ট সব ব্যাপারে পিতা-মাতার রয়েছে সমান দায়িত্ব ও করণীয়। বুঝে বা না বুঝে সে দায়িত্বের সামান্য হেরফের হলেই অনেক সময় পিতা মাতাকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যাকে বইয়ের ভাষায় ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ’ বলা হয়।
চাইল্ড অ্যাবিউজ কী? চাইল্ড অ্যাবিউজ বা শিশু নির্যাতন হলো সর্বাবস্থায় কোনো শিশুকে অপব্যবহার করা। শিশু নির্যাতন সাধারণত ৪ প্রকার। শারীরিক নির্যাতন (physical abuse), মানসিক নির্যাতন (emotional /psycological abuse), অবহেলাজনিত নির্যাতন (neglect abuse) ও যৌন নির্যাতন (sexual abuse)। যৌন নির্যাতন ছাড়া বাকি সব কটিই অনেক সময় পিতা-মাতা দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে এবং প্রায় সময়ই আমাদের অভিভাবকেরা সেটা না বুঝেই করে থাকেন। কখনো কখনো গোঁড়া সংস্কৃতি বা পটভূমি এখানে বড় একটা ভূমিকা রাখে। যেমন, আমাদের ছোটবেলাটা ছিল অনেকটা আতঙ্কের। স্বাধীনতা বলতে গেলে ছিলই না। সারাক্ষণ পড়াশোনা করা, সময়মতো স্কুলে যাওয়া, বড়দের কথা মান্য করা-হোক তা অন্যায় এবং পরীক্ষায় খারাপ করলে বা যেকোনো ব্যাপারে ভুল করলে ধমক ও চর-থাপ্পড়, মার খাওয়া ছিল প্রায় প্রতিটি পরিবারের রেওয়াজ-রীতি। বড়রা ভুল করে ছোটদের দোষারোপ করলেও তাতে প্রতিবাদ করা ছিল চরম বেয়াদবি। হয়তো এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু তখন এই ব্যাপারগুলো ছিল অপরিবর্তিত পারিবারিক নিয়ম, যা আমেরিকাতে চাইল্ড অ্যাবিউজ নামে পরিচিত।
আজকের দিনেও চাইল্ড অ্যাবিউজ বা শিশু নির্যাতন আমাদের পরিবারে ও সমাজে প্রকট। বাংলাদেশি পিতা-মাতারা সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। কারণ সন্তানের প্রতি যেকোনো ধরনের আচরণ ও সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা সমাজ বা রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সাধারণত বাধাগ্রস্ত হন না (যদি না সেটা হত্যার পর্যায়ে যায়)। কিন্তু বাংলাদেশি-মার্কিনি পিতা-মাতাদের বেলায় এই বিষয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণের ওপর বাঁধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
কোনো শিশু সন্তানের গায়ে হাত তোলা, চামড়া পুড়িয়ে দেওয়া, ঝাঁকুনি দেওয়া, শিশুকে পানিতে চুবানো, শিশুর দিকে কোনো বস্তু ছুড়ে ফেলা, শিশুকে ধাক্কা দেওয়া বা ছুড়ে ফেলা...ইত্যাদি উপসর্গকে শারীরিক নির্যাতন বা ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বলে গণ্য করা হয়। শিশু সন্তানকে সামনে রেখে পরিবারের অন্য কাউকে গালি দেওয়া, কটু কথা বলা, গায়ে হাত তোলা বা অন্যের সমালোচনা করা, সন্তানকে ভালোবাসা এবং স্নেহ প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হওয়া, সন্তানকে উপেক্ষা করে মানসিক সমর্থন ও নির্দেশনা না দেওয়া, বিব্রতকর সমালোচনার মাধ্যমে সন্তানের আত্মবিশ্বাসকে ছোট করা, হুমকি দেওয়া, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা....প্রভৃতি বিষয়কে চাইল্ড ইমোশনাল অ্যাবিউজ বা মানসিক নির্যাতন বলে গণ্য করা হয়। শিশু সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ অর্থাৎ পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান না করা, মোজা ছাড়া জুতা পরা, একই আন্ডার গার্মেন্টস বারবার পরিধান করা, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার না দেওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর বাড়িতে বাস করা, চুল না কাটা, ত্বকের যত্ন না করা, চিকিৎসা না দেওয়া, পড়ালেখার ব্যাপারে শিশু সন্তানের সাফল্য ও ব্যর্থতায় নিস্পৃহ থাকা প্রভৃতি বিষয়কে চাইল্ড নেগলেক্ট বা অবহেলাজনিত নির্যাতন বলে ধরা হয়।
আপনি হয়তো আপনার শিশু সন্তানকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসেন। সব মা-বাবাই নিজ সন্তানকে ভালোবাসেন। এতে ব্যতিক্রম কিছু নেই। কিন্তু পিতা-মাতা হিসেবে সন্তানের প্রতি সেই ভালোবাসার প্রয়োগটা কেমন হবে, সেটাই নিশ্চিত করবে আপনি কেমন পিতা-মাতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধরুন আপনার সন্তান এখনো ডায়াপার ছাড়েনি। বাড়িতে সে ডায়াপারের ওপর আন্ডারওয়্যার ছাড়াই প্যান্ট পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আপনি সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্য কীসে তা খুঁজে পেলেন এবং আন্ডারওয়্যার না পরিয়ে অভ্যস্ত করলেন। একসময় আপনার শিশু সন্তানটি স্কুলে যাওয়া শুরু করল। তখনো সে ডায়াপার পরছে, আন্ডারওয়্যার পরছে না। এমতাবস্থায় বিষয়টাকে স্কুলশিক্ষক সন্তানের প্রতি আপনার অবহেলা বলে ভাবতে পারেন। আবার এও ভাবতে পারেন যে হয়তো শিশুসন্তানকে আন্ডারওয়্যার না পরানোটা আপনার সংস্কৃতি। কিন্তু যখন কোনো শিশু ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় পরে স্কুলে যায়, একই মোজা, আন্ডারওয়্যার ও পোশাক বারবার পরিধান করে, শুষ্কতার কারণে ত্বক রুক্ষ ও ফাটা থাকে, বারবার অ‌সুখে ভোগে স্কুল মিস করে, তখন এই ব্যাপারগুলোকে শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষ নেগলেক্ট চাইল্ড অ্যাবিউজ বা অবহেলাজনিত নির্যাতন বলে ধরে নেন। আর এমন কিছু বারবার নজরে পড়লে এক সময় তারা শিশুটির নিরাপত্তা নিয়ে বিচলিত হোন এবং শিশুর সার্বিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে তারা এসিএসের (ACS) শরণাপন্ন হন।
এসিএস কি? এসিএস সম্পর্কে অনেক বাংলাদেশি-মার্কিনি পিতা-মাতাই অজ্ঞ। কিংবা হয়তো এ বিষয়ে তাঁদের জানার দরকার কখনো পড়েনি। এসিএস একটি শিশু সেবাদানকারী প্রশাসন, যা নিউইয়র্ক সিটির শিশুদের কল্যাণে শিশুর প্রয়োজন বিচারে তার প্রাথমিক যত্ন ও শিক্ষা পরিষেবা দিয়ে থাকে। এবং শিশুর পরিবারের নিরাপত্তা ও সুবিধার সুরক্ষা ও প্রচার করে। অর্থাৎ, যদি কোনো প্রতিবেশী বা স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো শিশুকে ‘চাইল্ড অ্যাবিউজে’র শিকার ধারণা করে এসিএসে রিপোর্ট করেন, তখন এসিএস ওই শিশুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শিশুটির বাসস্থান পরিদর্শন করেন। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পরও কোনো শিশু তার পিতা-মাতা বা পরিবারের দ্বারা অ্যাবিউজ হয় বা পরিবারে শিশুর জীবন হুমকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে এসিএস শিশুটিকে তার পিতা-মাতার অধীন হতে নিজ হেফাজতে নিয়ে যাবে।
শিশু সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। কথা বলুন। কী হচ্ছে, কী ঘটছে, জানতে চেষ্টা করুন। সন্তানকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখুন। তার শারীরিক সুস্থতায় জাঙ্ক খাবার পরিহার করে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারে তাকে অভ্যস্ত করুন। স্কুলশিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করুন। জানতে চেষ্টা করুন স্কুলে আপনার শিশু সন্তানটি অ্যাকাডেমিক্যালি কতটা ভালো করছে বা মন্দ করছে। খারাপ ফলাফলে বা ভুল হলে সন্তানকে না মেরে, না ধমকিয়ে বা কটাক্ষ করে আত্মবিশ্বাসে আঘাত না করে, তাকে বোঝান। তার সঙ্গে কথা বলুন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করুন। সব থেকে বড় কথা, সন্তানকে জানতে ও জানাতে, আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজেকে দক্ষ পিতা-মাতা হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে অনেক সময় আর্থিক অসচ্ছলতা ও অশিক্ষার কারণে অনেক পিতা-মাতা পিছিয়ে থাকেন। কোনো ব্যাপার না। শিক্ষার কোনো বয়স নেই। এটা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। এখানে নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার অনেক সুযোগ। সেই সুযোগ কাজে লাগান। শিশু সন্তানকে নিরাপত্তা ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যত দিতে সহায়তা করুন।