আমাদের হারানো স্বর্গ

নিসর্গ একদিন ছিল আমাদের স্বর্গ। কিন্তু সে স্বর্গ থেকে আমাদের পতন ঘটেনি, বরং আমরাই তাকে ধ্বংস করেছি। আমাদের জীবনকে করে তুলেছি নরক। কিংবা আমরা স্বর্গ গড়ব বলে নিসর্গকে যেভাবে বিনষ্ট করেছি, আমরা এতকাল পর তা উপলব্ধি করছি। তবে করছি কি? কিংবা সে উপলব্ধির কী ফসল আমরা অর্জন করেছি?
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক, যেন মায়ের সঙ্গে সন্তানের। মাতৃজঠরে যেভাবে শিশু বেড়ে উঠে আর মাতৃদুগ্ধ পান করে যেভাবে শিশু জীবন ও পুষ্টি বৃদ্ধি করে, প্রকৃতির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সে কাজটি করে চলে। বিজ্ঞান প্রকৃতির সূত্র আবিষ্কারের বহুকাল আগে থেকেই প্রকৃতির গুরুত্ব মানুষ তার ব্যবহারিকতা দিয়ে বুঝে নিয়েছিল। প্রকৃতির ভেতরই ছিল তার সব আনন্দ-বেদনার কাব্য। তার স্বর্গ, নরক, স্বপ্ন, কল্পনা, আকাশকুসুম...সবই যে প্রকৃতির ভেতর, প্রকৃতিকে ঘিরে।
প্রাচীন পৃথিবীতে ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ এই তত্ত্ব সর্বত্র ছড়ানো দেখি। তাই দেখি পশু-পাখি মানুষের সঙ্গে কথা বলছে, বাঘ-ভালুক-সিংহ আর সব ভয়ংকর প্রাণীরা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, গাছপালা মমতায় জড়িয়ে রাখছে তাকে। প্রাচীন গল্প-গাথা-কাব্য-কল্পকথায় এসব ছড়িয়ে রয়েছে। কেবল প্রকৃতিকে ধ্বংস আর বীরত্ব দিয়ে ‘জয়’ করার কথা নেই, প্রাণীকে সংহার করে মানুষের ‘বীরত্ব’ প্রদর্শনের কথা নেই; আছে বন্ধন, ভালোবাসা, সহযোগিতা আর পরস্পর-নির্ভরতার কথাও। আর হত্যা ও ধ্বংসেরও একটি নৈতিকতা তৈরি করে নিয়েছিল মানুষ, অশুভকে সে ধ্বংস করতে চায়, জীবনের অনিবার্য প্রয়োজনে হত্যাকে স্বীকৃতি দেয়, যতটুকু তার প্রয়োজন ততটুকুই সে গ্রহণ করে। এর বাইরে উপায়ই বা কী, যেহেতু পুরো সৃষ্টিই, বিশেষত প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষা, একে অন্যকে হত্যার ওপরই টিকে থাকে। তবে একটি বিষয় দেখার মতো, সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণিটিও কেবল ক্ষুধা পেলেই অন্যের প্রাণসংহার করে। তার অস্তিত্ব রক্ষা আর বেঁচে থাকার এটিই একমাত্র উপায়। এবং তার ক্ষুধা খুবই সীমিত। অন্যদিকে মানুষের ক্ষেত্রে এই ক্ষুধার অর্থ হয়ে যায় সীমাহীন। বিশেষত আধুনিক মানুষ, রেনেসাঁ-পরবর্তী মানুষ, নিজের জয় ঘোষণা করতে গিয়ে প্রকৃতিকে বড় বেশি তুচ্ছ করে ফেলেছে। প্রকৃতিকে যেকোনো মূল্যে ‘জয়’ করতে গিয়ে সে যে তার বড় পরাজয় ডেকে আনছে, সে তা বুঝেছে বহুদিন পর বিশ শতকে এসে। কিন্তু ইতিমধ্যে তার ভোগের বলগাহীন ঘোড়া আর প্রযুক্তির ঘোড়া একাকার হয়ে পৃথিবীর সাড়ে সর্বনাশ করে ফেলেছে, এখনো করে চলেছে, ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছে সে।
এর কারণটা কী? মানুষ ভেবেছিল, সে-ই চূড়ান্ত, সে-ই শ্রেষ্ঠ। যেভাবে ‘বড়’ ও ‘শক্তিশালী’ জাতিগুলো ‘ছোট’ ও ‘দুর্বল’ জাতিগুলোর ওপরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তাকে হত্যা ও ধ্বংসের ভেতর দিয়ে নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, প্রকৃতির ক্ষেত্রেও সে একই নীতি প্রয়োগ করেছিল। প্রকৃতি বহুকাল তা নীরবে সয়েছে। আজ সে নিরুপায় হয়ে তার জবাব দিচ্ছে, নিজের যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। অথচ, মনে হয়, এই প্রকৃতিতে মানুষই সবচেয়ে উটকো প্রাণী। কেননা, অন্য কোনো প্রাণীকে প্রকৃতির এত বিনাশ করতে হয় না। সে বরং প্রকৃতির বিদ্যমান স্বভাবকে বহাল রেখেই নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে। অথচ মানুষকে সব ধ্বংস ও দূষিত করে বাঁচতে হয়। মানুষ তার মা-মাটিকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস ও দূষিত করছে, বিশাল সমুদ্র আর আকাশকে দূষিত করছে। অর্থাৎ যেখানেই মানুষের পা পড়েছে, সেখানেই তার ‘নষ্ট’ হাত আর মগজ দিয়ে বিনষ্ট করেছে। এসবই সে করেছে তার অসীম ক্ষুধার জন্য, যে ক্ষুধা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর নেই। যন্ত্রের গতি যে দুর্গতিরও জননী, তার শক্তি যে ধ্বংসেরও অপশক্তি, মানুষ আজ তা জীবন দিয়ে পাঠ করছে। কিন্তু সে দোষ প্রযুক্তির নয়, বরং যে মানুষ-প্রজাতি প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছে, সে আসলেই অনেক বড়। কিন্তু এই প্রযুক্তিকে সে যখন ব্যবহার করে মানুষ হত্যায়, প্রকৃতিকে ধ্বংসে, তখন আর তার বড়ত্ব থাকে না, সে হয়ে হয়ে যায় সবচেয়ে নিচ। হিরোশিমা, নাগাসাকি থেকে শুরু করে ইরাক যুদ্ধ আর আফগানিস্তান পর্যন্ত যুদ্ধ-অস্ত্রবাজি-ধ্বংসযজ্ঞ প্রযুক্তির ‘কল্যাণে’ করছে মানুষ, প্রকৃতি আর পৃথিবী ধ্বংসে সে ব্যবহার করছে তার সেরা অর্জনকে। মানুষের অস্ত্র-প্রযুক্তি কী রকম ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে আইনস্টাইনের একটি করুণ-কৌতুক মনে পড়ছে। একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি ঘটে তবে এরপর কী হবে, তিনি বলেছিলেন এরপর মানুষ যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে পাথর ছাড়া আর কিছুই পাবে না। কারণ পৃথিবীতে তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, যা দিয়ে সে যুদ্ধ করতে পারবে।
২.
এই যে প্রকৃতি নিয়ে মানুষের উপলব্ধি, সেটি বিজ্ঞানের কল্যাণে বিশ শতকে আবারও উপলব্ধি করেছে। পৃথিবীর সব মনীষা এ ব্যাপারে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সোচ্চার, কাজ করেছেন। তাদের দীর্ঘ সাধনার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে বহু প্রতিষ্ঠান-সংগঠন, যারা প্রকৃতির জন্য কাজ করছেন। প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার প্রশ্নে ক্ষুদ্রতম প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকার, বেঁচে থাকার গুরুত্ব মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই অনুধাবন করছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে মানুষ হাজার-হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদের চির বিলুপ্তির কারণ হয়েছে, যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হয়তো হাজার বছর লাগবে।
সুখের কথা হলো, আমাদের বাঙালি রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির এই ভাষা খুব নিবিড়ভাবে অনুভব করেছিলেন। তাই তিনি প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতন। সেখানে মানুষ যেন প্রকৃতির পাঠশালায় দীক্ষা গ্রহণ করে, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। জীবনযাপন, শিক্ষা, কৃষি, বনায়ন সবখানে তিনি প্রকৃতির ভাষা বুঝে, প্রকৃতির অংশ হয়ে কাজ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। বিভিন্ন লেখা, কথা, ভাষণে তিনি বারবার প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের হঠকারিতার বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কোনো কাজেই আসেননি। কারণ, শোনার মতো কান হয়তো আমরা খুইয়ে বসেছি। পশ্চিমের আমদানি করা জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই আমাদের মুখে রোচে না। অথচ কতকাল আগে আমাদের এক নারী-মনীষা খনা কী চমৎকারভাবেই তার বচনে উল্লেখ করেছেন, জীবন ও প্রকৃতির সুন্দর সমন্বয়ের কথা।
মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, আমরা বোধ হয় প্রকৃতি-সচেতন না হয়ে প্রকৃতি-ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছি। না হলে পরিবেশ নিয়ে যত সংগঠন কাজ করছে, তত ফল তো হচ্ছে না। বরং এমন কথাও চাউর আছে, এ খাতে বিদেশি-ভিক্ষা খুব সহজে মেলে বলে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। এতে প্রকৃতির কল্যাণের চেয়ে কতিপয় ব্যক্তির লাভ বেশ হচ্ছে। ইদানীং প্রকৃতি-সচেতনতা বলতে আমরা আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণকেই বুঝে উঠছি। কিন্তু কী গাছ লাগানো হচ্ছে, কোথায় লাগানো হচ্ছে, কতটা পরিচর্যা হচ্ছে, তার কোনো খবরই নেই। আর বনরক্ষকদের বন খেয়ে ফেলার গল্প তো বেশ পুরোনো। সে জন্যই প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা খুব জোর দিয়ে বলেছেন, যদি বন বাঁচাতে হয় তাহলে আগে সরকারি বন বিভাগকে বিলুপ্ত করতে হবে। অন্যদিকে কিছু কিছু পরিবেশবাদী এনজিও পরিবেশের বড় ক্ষতি করে চলেছেন—এমন কথাও শোনা যায়।
এভাবে দিনকে দিন আমাদের চিরসবুজ নিসর্গ, আমাদের চিরচেনা প্রকৃতি ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। জীবনানন্দের নিসর্গ, বিভূতিভূষণের প্রকৃতি কত দ্রুতই না হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যই কি জীবনানন্দ দাশ তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’? যে চিরায়ত বাংলার ছবি তিনি এঁকেছিলেন তার অসামান্য সনেটগুলোতে, তিনি কি দেখেছিলেন এ যেন সংকুচিত নগরায়ণের কাছে, যুদ্ধের কাছে, জনসংখ্যার কাছে, সর্বোপরি মানুষের লালসার কাছে? এ কেবলই হয়ে উঠবে অতীত-স্মারক?
দারিদ্র্য-অভাব, জনসংখ্যা, অসচেতনতা—এসবই হয়তো আমাদের নিসর্গ হারানোর নিয়তি। কিন্তু আমাদের লোভ, হঠকারিতার বিষয়টি কী? আজ যখন সারা পৃথিবীই প্রকৃতির ভারসাম্য আর হারানো নিসর্গ ফিরে পাওয়ার জন্য উন্মুখ, তখন আমরা কাগজচর্চা-বক্তৃতা-সেমিনার-বিদেশভ্রমণ ছাড়া বাস্তবে কী করছি? বরং যেটুকু জ্ঞান আমরা অর্জন করেছি, তার উল্টোচর্চা করে আমাদের জ্ঞানপাপ বাড়িয়ে চলেছি।
প্রতিদিন বন-বৃক্ষ-নদী-পাহাড় হত্যা, ভূমি ও জলাভূমি ভরাট করে বসতি গড়া, নির্বিচারে পশু-পাখির আবাস ধ্বংস করা, দূষণে দূষণে মাটি-আকাশ-জল নষ্ট করা সগৌরবে চলছে। কারা করছেন এসব? এর সঙ্গে জড়িত দেশের নীতিনির্ধারক-রাজনীতিক-আমলা-বণিক সবাই। অথচ মুখে মুখে সবারই নিসর্গপ্রীতির কথা!
নিসর্গের সেই স্বর্গ তো আমরা হারিয়েছি কতকাল আগেই। কিন্তু নরকের কোনো চুলোয় আমরা জ্বলব, তা কি আমরা জানি?