যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারকে কী নির্মম মানসিক অত্যাচার আর অপরিসীম দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তার দু-একটি স্মৃতি মনে হলে আজও শিহরিত হই। ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আব্বা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চলে গেলেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাট সীমান্তে। আম্মাসহ আমরা তিন ভাই দুই বোন সবাই গ্রামের বাড়িতে। পাগলা থেকে মাইল পাঁচেক দক্ষিণে আমাদের গ্রাম উমেদনগর। গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লাউগাং নামের নদীর পাড়ের গ্রামের নাম লাউগাংয়ের পাড়। হাওর-নদী সব বর্ষার পানিতে টুইটম্বুর। চারদিকের বিশাল হাওরের মাঝের গ্রামগুলো দ্বীপের মতো ভাসছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীপথে ছোট ছোট লঞ্চে রাজাকার ও মিলিশিয়ার দল দিরাই থেকে ডাবর ফেরিঘাটে নয়তো সুনামগঞ্জ শহরে যেত। লঞ্চের সামনে ছোট কেবিনের ছাদে দুজন বসে থাকত রাইফেল তাক করে। গ্রামের পশ্চিম মাথার কাছাকাছি রাজাকার ভর্তি লঞ্চ এলে, গ্রামের ছোট-বড় সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেত। একবার আমি লঞ্চ দেখে দৌড়ে মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়ি। পুরো বর্ষায় পাক বাহিনীর একজন নয়তো দুজন সৈন্য এবং সঙ্গে রাজাকারের দল নিয়ে নৌকায় চলাচল করত। এক সন্ধ্যায় দুটি নৌকা বোঝাই কিছু সৈন্য ও সঙ্গে ১০/১২ জন রাজাকারের দল আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। নিমেষে খবর পৌঁছে গেল ভেতর বাড়িতে। ওদের আসার খবর পেয়ে পরিবারের সবাই আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে গ্রামের আরেক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিল। ছয়-সাতজন বিবাহযোগ্য চাচাতো বোনসহ ছোট দুই বোনের নিরাপত্তায় চাচারা হয়ে পড়লেন চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।
বাইরের ঘর, যাকে বলা হতো বাংলা ঘর, সেখানে উঠে তারা সবার জন্য খাবারের আয়োজন করতে চাপ দিতে লাগল। আস্তে আস্তে খবরটি পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পাকিস্তানি বাহিনী আসার খবর শুনে পুরান বাড়িতে এলেন আছদ্দর আলী নামের এক চাচাতো ভাই (বর্তমানে প্রয়াত), যিনি কর্মসূত্রে কয়েক বছর পাকিস্তানের করাচিতে ছিলেন। ওদের সঙ্গে উর্দুতে আলাপ করে জানলেন, তারা দিরাই থেকে সুনামগঞ্জ শহরে যাওয়ার পথে রাত হয়ে যাওয়ায় আমাদের বাড়িতে উঠেছে। সব খবর শুনে আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে আশ্রিত বাড়ি থেকে খোলা নৌকা করে উত্তর দিকের হাওর পাড়ি দিয়ে যাত্রা শুরু। পাশের গ্রাম বীরগাঁওয়ে ফুপুদের বাড়ি। তাড়াহুড়া করে নৌকায় উঠতে গিয়ে নৌকা তৈরিতে ব্যবহৃত ধারালো তারকাঁটা, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘পাতাম’, সেটাতে লেগে পা কেটে গেল ছোট বোন ডলির। অন্ধকারে সে পায়ের কাটাস্থানে আঙুল দিয়ে চেপে চুপচাপ বসে রইল। ছোট ভাই অপু আম্মার কোলে। পুরো নৌকায় ৭/৮ জন চাচাতো বোনসহ আমরা ভাই-বোনেরা নিঃশব্দে বসে আছি। নৌকা দ্রুত চলার জন্য সামনে-পেছনে চারটি দাঁড় লাগানো। পেছনে হাল ধরে বসে আছেন শক্তিশালী এক অভিজ্ঞ মাঝি। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। চারদিকে রাজ্যের নিঃশব্দতা। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। শুধু দু-জোড়া দাঁড়ের ছপ ছপ আওয়াজ তুলে নৌকা চলছে উত্তরমুখী বীরগাঁও গ্রামের দিকে। ঘণ্টাখানেক পর নৌকা এসে ভিড়ল ফুপুদের ঘাটে। ফুফুসহ সবাই দৌড়ে এলেন আমাদের দেখতে। প্রথমে বোন ডলিকে পাঠানো হলো বাড়ির ভেতরে। আম্মা একটু নরম প্রকৃতির হলেও ওই রাতে খুবই শক্ত ছিলেন। ডলিকে ঘরে নিয়ে হাতের কাছে পাওয়া ওষুধ লাগিয়ে পা ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হলো। এদিকে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চাপা আতঙ্ক। বিশেষ করে যাদের ঘরে ‘সোমত্ত’ মেয়ে আছে, তারা কাটাচ্ছেন অভিশপ্ত এক দীর্ঘ রাত। তবে গ্রামবাসীর ভাগ্য বলতে হবে, ওই রাতে হানাদারের দল বাংলা ঘর থেকে বের হয়নি। বাড়ির কৃষি-কামিনদের কাছ থেকে পরে জানা গেল, নিয়মিত সৈন্যরা জবরদস্তি করে আনা খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলে রাজাকার আর মিলিশিয়ারা জেগে ওদের পাহারা দিত। চাচাতো ভাই ভেতর ঘরে এসে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইলেন একটি বিষয়ে। তিনি চাইলেন, অতর্কিত হামলা করে নিয়মিত সৈন্য, অর্থাৎ সব পাকিস্তানিদের হত্যা করতে। আর এ জন্য তিনি সবার সহযোগিতা চাইলেন। পরে অনেক আলাপ-আলোচনা করে গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষদের জান-মালের কথা বিবেচনায় এনে পরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ নিয়ে বাকি জীবন তিনি ঢের আফসোস করেছেন। স্বাধীনচেতা ও মুক্তিকামী সেই বড়ভাই আফসোস করতে করতেই একদিন চলে গেলেন পরপারে। আমাদের দেখলেই বলতেন, ওদের জীবিত ছেড়ে দেওয়া কোনোভাবেই সঠিক ছিল না। শত্রুরূপী শিকারকে ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওদের অমানবিক কাজের উপযুক্ত জবাব দেওয়া শুধু উচিতই ছিল না, ছিল ফরজ কাজ।
ভাইয়ের এই রাগান্বিত উক্তির পেছনে ছিল এক মর্মন্তুদ ঘটনা। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই ভাটি অঞ্চলে পাক বাহিনীর নদীপথে সীমিত চলাচল শুরু। সঙ্গে থাকত রাজাকার, যারা পথ চিনিয়ে নিয়ে যেত। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহাশিং নদী বেয়ে খানিক দূর এগিয়ে গেলেই বীরগাঁও বাজার। এলাকার সবচেয়ে বড় বাজার। উত্তর-দক্ষিণে লম্বাটে বাজারের দক্ষিণাংশে আমাদের পারিবারিক রাইস মিল। সে সময় পরিবারের অনেকের প্রধান ব্যবসা ছিল বিশাল পরিমাণে ধান কিনে মিলে চাল তৈরি করে সিলেট শহরে নিয়ে বিক্রি করা। আমাদের পরিবারের এক যুবক, সম্পর্কে ভাতিজা সবেমাত্র ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে। তখনই বেঁধে গেলে যুদ্ধ। নদীপথে মালামাল নিয়ে সিলেট যাওয়া হয়ে গেল অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। নানা জায়গায় নতুন নতুন জ্বালাতন আর হয়রানি শুরু হলো। বিশেষ করে রাজাকারদের যন্ত্রণা বেড়ে গেল কয়েক গুণ। সঙ্গে চাঁদাবাজি তো আছেই। তাই পরিবারের সব ব্যবসায়ী মিলে সিদ্ধান্ত নিল আপাতত দূরের ব্যবসা বন্ধ রেখে সীমিত আকারে স্থানীয় বাজারে ব্যবসা চালানো হবে। যৌথ মালিকানাধীন রাইস মিলে ধান ভাঙিয়ে বাজারেই বিক্রি করা হতো। যার একাংশ দেখাশোনা করত সমছু মিয়া নামের ওই ভাতিজা।
ভাটি এলাকার অনেক রীতি বা নিয়মের একটি ছিল নদী দিয়ে মানুষ নিয়ে চলা নৌকা কিংবা পণ্যবাহী নৌকার পেছনের মাঝি, যিনি হাল ধরে বসে থাকতেন তাকে জিজ্ঞেস করা মাঝি দেশ কোথায়? কই থাইক্যা আসলেন? যাইবেন কই? ইত্যাদি।
যুদ্ধের শুরু দিকের এমনি এক দিনের শেষভাগে নদী দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার বোঝাই তিন নৌকা দেখে ভাতিজা সমছু মিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হেই মাঝি বাড়ি কোথায়? যান কোন দিকে?’ সৈন্যরা ছিল নৌকার ভেতরে। তাদের না দেখেই অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করে ফেলে সামছু। ভাতিজা তখন রাইস মিলে ধান ভাঙানির কাজে ছিল। নদীর পাড় থেকে আওয়াজ শুনে পাক বাহিনীর এক সুবেদার মেজর রাজাকারকে জিজ্ঞেস করে, ‘শালা বাঙ্গাল কিয়ো শোর লাগায়া?’ উত্তরে রাজাকার বলে, ‘জানতে চায় আমরা কারা? আর কোথায় যাই?’ তা শুনে সুবেদার মেজর পৈশাচিক হাসি হেসে বলে ওকে ধরে, সঙ্গে নিয়ে চল, ওকে দেখাব আমরা কই যাই!
সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ভিড়িয়ে সমছু মিয়াকে তুলে নিয়ে আসে পাগলা আর্মি ক্যাম্প সড়ক ও জনপদের ডাক বাংলাতে। এনেই বেদম প্রহার করা শুরু করে। মারের চোটে ভাতিজার আর্তনাদ আর গগনবিদারী চিৎকারে আশপাশের মানুষের মূর্ছা যাওয়ার দশা হলেও সেই নরাধমরা থামেনি। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়েই আবার শুরু করে মার। অনেকক্ষণ এই অমানুষিক অত্যাচারের পর পাক হায়েনারা ডাক দেয় স্থানীয় এক রাজাকার কমান্ডারকে। হুকুম দেয় তাকে হাত পা বেঁধে দূরে হাওরে নিয়ে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে। ভাগ্যক্রমে সেই রাজাকার কমান্ডার আমাদের ভাতিজা সমছু মিয়াকে চিনে ফেলে। সে জ্যান্ত না পুতে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে মৃতপ্রায় ভাতিজাকে কাঁধে করে বয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই ভাতিজার মুখে বীভৎস আর অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি শুনে চাচাতো ভাই আছদ্দর আলীর ভেতরে অপমানের প্রতিশোধ স্পৃহা সদা জাগ্রত থাকত। আর সে জন্যই তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যসহ সঙ্গের রাজাকারদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তিনি চেয়েছিলেন নিরপরাধ ভাতিজার ওপর পশুদের অত্যাচারের শোধ নিতে। এ কারণেই হয়তো বাকি জীবন তিনি বলতেন, ‘অত্যাচারী পাকিস্তানি হায়েনাদের এভাবে না ছেড়ে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া ছিল ফরজ কাজ।’