বিজয়ের উল্লাসে চাপা পড়া বীরাঙ্গনার আর্তনাদ

দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির তোড়ে ছাতা মাথায় হাঁটার উপায় নেই। আমি, বড় আপু, বন্ধু অভি রহমান, জিতু হকসহ আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে দুটো গাড়িতে করে রওনা হলাম সিলেটের মুন্সিবাজারের মীর্জানগর গ্রামে। নরসিংদী শহর থেকে প্রায় ছয় ঘণ্টা ড্রাইভ করে পৌঁছালাম সিলেট। সিলেট শহর থেকে মীর্জানগর গ্রামে যেতে যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। অগত্যা কাদায়-বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে একেবারে ভেতরের দিকে দুই মাইলের বেশি হেঁটে অবশেষে পৌঁছালাম মীর্জানগর গ্রামে। যাত্রা পথে সহযোগী হলেন কমলগঞ্জ উপজেলার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক রায়হান হাসান ও সমাজসেবী কেশব দাদা। নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যে বাড়িটি চোখে পড়ল, তার অবস্থা নিতান্তই খারাপ। মাটির ওপর বাঁশ ও জং পড়ে ক্ষয়ে যাওয়া টিনের বেড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ঘর। বাড়ির উঠোন ভর্তি পানি। উঠোনের কোণে মাচায় ঝুলে আছে কিছু সবজি গাছ। আমাদের সাড়া পেয়ে অতঃপর ব্লাউজহীন একটি ময়লা সাদা শাড়ি গায়ে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকার।
আমি যখন তাঁর ঘরে ঢুকি, টিনের চালার ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে মাটির মেঝে ততক্ষণে কাদা-জলে ভর্তি। অবাক হয়ে দেখলাম, একজন বীরাঙ্গনা তাঁর শাড়ির আঁচলে চৌকি পরিষ্কার করছেন আমাকে বসতে দেওয়ার জন্য। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। তারপর বাটিতে করে মুড়ি এনে দিলেন। তেলমাখা গন্ধঅলা মুড়ি আমি খুব আগ্রহ সহকারে খেলাম। অনেক কিছু জানার ছিল। তাঁর কাছে আবেদন জানালে ধীরে ধীরে তিনি বলতে শুরু করলেন।
প্রভা রানী মালাকারের স্বামী মৃত কামিনী রাম মালাকার। ১৯৭১ সালের বৈশাখ মাসে বিয়ে হয় তাঁদের। আর শ্রাবণ মাসে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। স্বামী তখন চলে যান ভারতে। প্রভা রানী চলে যান বাবার বাড়ি বিক্রমকলসে। দিন পনেরো পর স্থানীয় রাজাকাররা জোর করে তাঁকে মায়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় পাশের বাদল মাস্টারের বাড়ি। সেখানে আর্মিরা তাঁকে নির্যাতন করে। পরদিন ছেড়ে দিলে এই অসহায় নারী চলে যান জাঙলহাটি, বোনের বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও তাঁর ওপর নজর পড়ে পাষণ্ডদের। ২০/২৫ দিন পর রাজাকাররা আবারও তাঁকে ধরে নিয়ে যায় শমশেরনগর ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে। সারা রাত চলে পাশবিক নির্যাতন। নির্যাতনের একপর্যায়ে অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা ফেলে চলে যায়। পরদিন তিনি পালিয়ে আসেন বোনের বাড়িতে। দেশ স্বাধীন হয়। স্বামী ফিরে আসেন ভারত থেকে। আতঙ্ক বুকে চেপে স্বামীকে সব খুলে বলেন তিনি। স্বামী কামিনী রাম মালাকার চোখের পানি মুছিয়ে স্ত্রীকে সাদরে ঘরে তুলে নেন। এর এক বছর পর জন্ম হয় তাঁর ছেলের; তারপর এক মেয়ের। একদিন কামিনী রাম মালাকার পাড়ি জমান পরপারে।
আজ এই বীরাঙ্গনাকে বলা হয় পাঞ্জাবির বউ। আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামের মানুষ তাঁর ছেলেকে বলে জারজ, বলে পাগল, বলে পাঞ্জাবির ছেলে। স্বামীর রেখে যাওয়া কোনো সম্পদ ভোগ করতে পারছেন না তিনি। অভাবের সংসার। ছেলের ঘরে তাঁর আটজন নাতনি। তাদের পড়াশোনার বই খাতা কিনতে পারেন না তিনি। বিদ্যুৎ নাই। ঘরের চালায় ফুঁটা দিয়ে বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে। ১০ জনের পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকারের। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি বারবার ময়লা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছিলেন। উসকোখুসকো চুলে লুঙ্গি পরিহিত তাঁর সন্তান কাজল মালাকার কোলের ছোট শিশুটিকে নিয়ে আমার সামনে এলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। আলাপে এক ফাঁকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ছেলেকে সবাই জারজ কেন বলে? পাগল কেন বলে? জবাবে তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে কাজল মালাকারের বাবা আমার স্বামী। এগুলো আমার স্বামীর ভাই, ভাইয়ের ছেলে, গ্রামের মেম্বার ও চেয়ারম্যানের কারসাজি দিদি। ওরা আমার ছেলেকে মারধর করে পাগল সাজাইছে। জারজ সন্তান বলে আমার স্বামীর সম্পত্তি থেকে তাকে বেদখল করে সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে। সম্পত্তির লোভ দিদি।’ বললাম, তারা কেন আপনার ছেলেকে অহেতুক মারবে? তিনি বললেন, ‘সম্পত্তির জন্য আমার ছেলে প্রায়ই হইচই করে। তাকে পাঞ্জাবির ছেলে বললে রেগে যায়। যখন সে খুব দুঃখ পায়, সে সবাইকে গালাগালি করে। অনেক গালাগালি করে। তখন সবাই বলে ছেলে আমার পাগল হয়ে গেছে। ধরে মারধরও করে তাকে। তিনবার তাকে জেলে পাঠিয়েছে ওরা। কোর্ট (আদালত) থেকে বিচারে বলেছে আমার ছেলে পাগল না। কোর্ট বলেছে, ছেলেকে তার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের দলিল ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু কে দেবে?’ তিনি আরও জানালেন, সম্পত্তির শোক, আর গ্রামের মানুষের বাজে কথায় ছেলে তার সিদ্ধি খাওয়া ধরেছে। রেগে গেলেই সিদ্ধি খায়, আর সবাইকে গালি দেয়। তাকেও ছাড়ে না গালাগালি করতে।
সম্প্রতি তাঁকে সরকারিভাবে বীরাঙ্গনার তালিকাভুক্ত করা হলেও সরকারি তহবিল থেকে কোনো আর্থিক অনুদান তিনি পাননি বলে জানান। দু-একটি সামাজিক সংগঠন তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেও তিনি মাত্র ১০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান পেয়েছেন এবং ওই টাকা দিয়েই বড় নাতনির বিয়ে দিয়েছেন।
একজন বীরাঙ্গনা, দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি সর্বস্ব হারিয়েছেন, তিনি জীবিকার প্রয়োজনে আজ ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন। ঘরে তাঁর ছেলে-ছেলের বউ, আর আটজন নাতনি। ছেলে মাঝে মাঝে ভাড়ায় রিকশা চালায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন, আমি প্রভা রানী মালাকার, সন্তানের পরিচয় চাই। স্বামীর সম্পদের ভাগ চাই। আমি বীরাঙ্গনা, আমার সন্তান জারজ নয়, আমার সন্তান পাঞ্জাবির নয়। আমি আমার সন্তানের পরিচয় চাই। আমি একজন গর্বিত স্বামীর বীরাঙ্গনা স্ত্রী। আমি পাঞ্জাবির বউ নই। আমি বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকার। আমি প্রাপ্য মর্যাদা চাই।’
একজন বীরাঙ্গনার মানবেতর জীবন যাপন নিজ চোখে দেখে এলাম সেদিন। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে নিজ অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত একজন বীরাঙ্গনা তিনি। বীরাঙ্গনা এই নারীকে মূল্যায়ন করা আমার ক্ষমতার বাইরে। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী মহান ত্যাগী এই মানুষটির ছেলের জন্য একটি নতুন রিকশা কেনার পরিমাণ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে পরের সপ্তাহে আমি ফিরে আসি আমেরিকায়। তাঁর বাড়িতে সৌর বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য কমলগঞ্জ উপজেলার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষকে সুপারিশ করে আসি। আমার সুপারিশে কতটা কাজ হয়েছে, তা আর জানা হয়নি।
যেকোনো জাতিকে দমন ও নির্মূল করতে সবচেয়ে বড় দুটি উপায় হচ্ছে গণহত্যা ও ধর্ষণ। ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে চিরতরে নির্মূল করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই দুটি উপায়ই ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের মা-বোনদের ওপর কতটা বীভৎস নির্যাতন করেছে, তার ভয়াবহতার বর্ণনা কেবল বীরাঙ্গনা ও প্রত্যক্ষদর্শীই দিতে পারেন। বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকারের গল্পটি কোনো উপন্যাসের পাতা থেকে নেওয়া হয়নি। এই গল্পটি তাঁর নিজের জবানিতে বলা, যা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে, দেশ কি সত্যিই স্বাধীন হয়েছে? আমরা কি মানবিক, নৈতিক ও মুক্ত চিন্তার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সত্যিই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, নারীদের বীরত্বগাথা তাতে কতটা উঠে এসেছে? বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকারের মতো মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা দেশমাতৃকার জন্য নির্যাতিত হয়েছেন, আত্মত্যাগ করেছেন, তাঁদের সেই অবদানটুকু আমরা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দিতে পারিনি। নওগাঁর রানীনগরের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১১ জন বীরাঙ্গনার তিনজন চলে গেছেন পরপারে। বাকি আটজন বেঁচে থাকলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ তাঁরা বঞ্চিত সব সুবিধা থেকে। অর্থের অভাবে তাঁরা ওষুধ কিনতে পারেন না। তাঁদের সন্তানেরা দিনমজুরের কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। দেশের আনাচে-কানাচে এমন বহু বঞ্চিত বীরাঙ্গনারা ছড়িয়ে রয়েছেন। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত। অভাবে-অনুযোগে বহু বীরাঙ্গনা এখনো প্রভা রানী মালাকারের মতো কেঁদে বুক ভাসান। তাঁদের আর্তনাদ চাপা পড়ে যায় বিজয়ের উল্লাসে। এ লজ্জা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। এ লজ্জা আমাদের সবার।
লেখক: এডুকেটর, ফ্লাশিং, নিউইয়র্ক