খতনা ও বাল্যবিবাহ

মানবজীবনে নারীদের মতো পুরুষদের খুব একটা ভীতিকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। মুসলিম পুরুষদের একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে মুসলমানি। যদিও নারীর নাক বা কান ফোড়নের মতো অতিরিক্ত কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকে। কিন্তু এ যুগে অনেক ছেলেও কান, নাক, আইব্রু কিংবা চোখের পর্দা ফোড়নে নারীর সঙ্গে সমতা এনেছে। সে যাই হোক, মুসলিমদের বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলিম পুরুষদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হচ্ছে খতনা বা মুসলমানি। অবশ্য বলে রাখা ভালো, মুসলিম ছেলেদের যারা নিজ গৃহে বা সনাতনী পদ্ধতিতে খতনা হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি তিক্ত। বর্তমান যুগে হাসপাতালে গিয়ে সন্তানদের খতনা করা হয় না—এমন সংখ্যা খুবই কম। আর্থিক অবস্থা বেশি খারাপ যাদের তারা হয় তো এখনো সনাতন পদ্ধতিতে ছেলের খতনা করায়।
এখানে আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন হাসপাতালে খতনার ব্যবস্থা ছিল না। খতনা না হওয়া পর্যন্ত একজন ছেলে পুরোপুরি মুসলিম হয়ে উঠে না—এ রকম ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই অনেকের শৈশব কেটেছে। অন্তত আমার ছেলেবেলায় সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে এটাই ছিল তিন সত্য।
ঢাকা শহরের পূর্বে গোড়ান এলাকার কথা বলছি। তখনো বনশ্রী নামের আবাসিক এলাকার গোড়াপত্তন হয়নি। উন্নয়নের আলো বলতে কিছু কিছু বাড়িতে সাদাকালো টেলিভিশন চলে। বর্ষাকালে বুক পর্যন্ত পানিতে নৌকা চলাচল করে। দূর–দূরান্ত থেকে মাটি, হাঁস-মুরগি, ফলমূল বা শাক–সবজির নৌকা এসে শহরের অন্যান্য স্থানে সেগুলো চালান বা বিক্রি হয়। রাস্তায় হাঁটতে গেলে আশপাশের ডোবা থেকে প্রায়ই বিষধর সাপ দেখা যায়। রামপুরা বিটিভির সুউচ্চ টাওয়ার অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। পুরোনো ধাঁচের বাজারে সারা দিন বিকট শব্দে ধান, গম ভাঙানো মেশিনের ব্যস্ততা কানে আসে। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে প্রায়ই মিলিটারির পোশাক পরা সৈন্যরা এসে ছেলেপুলেদের ধরে রোগ প্রতিরোধের টিকা বা ইনজেকশন দিয়ে যায়। তখন বিশুতবার (বৃহস্পতিবার) ছিল অর্ধদিবস স্কুল, কলেজ বা অফিস আদালত।
শুক্রবার বন্ধের দিন সকালে বিটিভির কার্যক্রম শুরু হতো সকাল নয়টার দিকে। আমরা আগেভাগেই পাশের বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে টিভির পর্দায় রংধনু মার্কা বার কোড দেখতাম। ভেতরে দামি সোফাসেটে বসা বড়লোক সন্তান আর বাইরে ইটের ওপর দাঁড়িয়ে টিভি দেখা গরিবদের মধ্যে পার্থক্য বোঝা শুরু করেছি মাত্র। নিজেকে গরিবদের কাতারে দেখতেও একটু গর্ববোধ হতো। তখন ভিসিআরে হিন্দি ছবিরও জয়জয়কার। অমিতাভ বচ্চনের কুলি ছবিতে কুলি হয়েও তার কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। আহা, জীবনটা যদি সত্যিই ছবির মতো হতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকতাম কখন বিটিভির দিন শুরু হবে। তারপর একসময় ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো’ কিংবা ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ ধরনের গান। পালাক্রমে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, গীতা, ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে বিটিভি ঘুম থেকে জেগে উঠত। এরপর ছিল সাদা-কালো পর্দায় টারজান, থান্ডার ক্যাটস, স্টার ট্র্যাক। আর কখনো নতুন কুঁড়ি, ছায়াছন্দ, কখনো নাটকের পুনঃপ্রচার ইত্যাদি। যখন রাতে সাপ্তাহিক টিভি সিরিজ ম্যাকগাইভার কিংবা মুভি অফ দ্য উইক দেখতাম, তার পরপরই এলাকায় মাসিক ভিত্তিতে কোনো এক পীরের মিলাদ হতো। কয়েকজন বন্ধু মিলে মিলাদের বিরিয়ানি খেতে চলে যেতাম। মোনাজাত একটু দীর্ঘ হলে মিলাদ খেতে আসার লাভক্ষতি হিসাব করতাম।
আসল কথায় আসি। আমাদের গোড়ান এলাকায় দুজন হাজম ছিলেন। হাজম হলেন যারা ছেলেদের খতনা বা মুসলমানি করান। দুজনেই সম্পর্কে আবার আপন ভাই। বড় ভাই বড় হাজম এবং ছোট ভাই ছোট হাজম নামে পরিচিত। বড় হাজমের বাসার ফটকের সামনে একটা সাইনবোর্ড ঝুলতো ‘হাজম বাড়ি, এখানে সপ্তাহে সাত দিন মুসলমানি করা হয়, তারপর সাত দিনের মুসলমানির রেট, সময়কাল ইত্যাদি। এলাকার মুসলমানি না হওয়া ছেলে বাচ্চাদের কাছে তারা ছিলেন যমের মতো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও পোলাপান তাদের দেখে দৌড়ে পালাতো। ছেলে বাচ্চারা কথা না শুনলে মুরুব্বিরা ‘হাজম এল, হাজম এল’ বলে ভয় দেখাত। ওই দুই হাজমের দুজনই সব সময় সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরতেন। সাধারণত ঢাকাইয়া কুট্টি যারা তারাই সাদা লুঙ্গি বেশি পরতেন। কেন যেন মনে হতো, ওই দুই হাজম ছিলেন লাল চোখা। মনে হতো, তারা সব সময় ‘মাদকাসক্ত’ থাকতেন। সারাক্ষণ পান চিবোতেন আর রাস্তার দুই পাশে পানের পিক ফেলতে ফেলতে চলতেন। হয়তো তাদের পেশার কারণেই শিশুমনে এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিল। মানুষের মন বলে কথা। একটা অদেখা ড্রাকুলাকে যত ভালোই বানানো হোক না কেন, তার অবয়ব সাধারণ মানুষের কাছে হবে রক্তচোষা, হিংস্র কিংবা ক্ষুধার্ত।
একবার পাশের বাড়ির দুষ্ট ছেলে মোস্তাফিজের খতনার দিন ধার্য করা হলো। তার বয়স সাত কি আট হবে। ওই বয়সে সে সারা দিন বিড়াল-কুকুরের লেজ টান দিয়ে খেলা করে। উঠোনে কাক দেখলে দৌড়ে যায় ধরতে। মাঝে–মধ্যে বাংলা গালি দিয়েও অন্য ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া করে। ইতিমধ্যে আমার খতনা হয়ে গেছে। সুতরাং হাজমের আর ভয় নেই। মোস্তাফিজ তখন ইংরেজি স্কুলের পাশাপাশি সকালে লুঙ্গি পরে কাছের মাদ্রাসায় যায়। বাড়িতেও হুজুর আসে পড়াতে। বেশ কিছু সুরা কলেমাও শিখে ফেলেছে। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে সময়ে–অসময়ে উচ্চ স্বরে সুর করে সুরা পাঠ করে শোনায়। শুনতে ভালো লাগে। যেন বাতাসে তার কণ্ঠ ভাসে। এক শুক্রবার তাকে খতনা করানো হবে বলে তার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ায় একটু উৎসবমুখর আয়োজন করা হলো। কাঁঠাল পাতার ঠোঙায় করে লাল লাল জিলাপি নিয়ে আসা হলো। আমি জিলাপি খাওয়ার মতলব নিয়ে তাকে দেখতে গেলাম। বেচারা নিজের চাইতে বড় সাইজের মাড় দেওয়া লুঙ্গি পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনেকটা খতনার পর কী হবে তার ওপর ছোটখাটো রিহার্সাল। কিছু আত্মীয়-স্বজনও এসেছেন উপহার নিয়ে। তাকে দেখে বেশ আত্মবিশ্বাসীই মনে হলো। তাকে বোঝানো হয়েছে যে, খতনার ব্যথা বলতে লাল পিঁপড়ার সামান্য একটা কামড়। অতটুকুই।
যাই হোক, জুমার নামাজের পরই দু-একজন সঙ্গী নিয়ে বড় হাজম এলেন। ইতিমধ্যে বাসায় আরও কিছু লোক জড়ো হয়েছে। গলিতে কিছু ভিক্ষুকেরও জটলা। আমি নিজের অভিজ্ঞতার পর থেকে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখতে খুব ভয় পাই। একটা জলজ্যান্ত ছোট ছেলের হাত-পা ধরে রেখে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ শরীরের একটা অংশ কেটে ফেলবে। কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার! আফ্রিকা কিংবা আমাজন বনাঞ্চলে কিছু কিছু উপজাতিদের শরীরে ট্যাটু করা হয়। কিন্তু তার আগে তাদের ড্রাগস দেওয়া হয় যাতে ব্যথা প্রশমিত হয়। কিন্তু খতনা তো কোনো কিছু ছাড়াই। মোস্তাফিজের জন্য ছুরি হিসেবে নেওয়া হলো আখ বা গেন্ডারির ছোকলা বা স্কিন। ওটা নাকি ভয়ংকর রকমের ধারালো আর সেটাতে নাকি ইনফেকশন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ব্যবহার করবার আগে হালকা আগুনে তাপ দেওয়া হয়। আমি বাসায় এসে বারান্দায় হাটাহাটি করছি। কিছু না শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখছিলাম। কিন্তু কিছু না শোনার জন্য যদি মনকে বোঝানো হয়, তাহলে মন আরও অস্থির হয়ে যায় সবকিছু শোনার জন্য। তখন অহেতুক শব্দকেও দুই কর্ণ কঠিনভাবে গ্রহণ করে। কিছুক্ষণ পর শুনলাম মোস্তাফিজ উচ্চ স্বরে সুরা, কলেমা পড়ছে। খুব সম্ভবত তখন মুসলমানির আনুষ্ঠানিকতার শুরু। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। তার পরপরই হঠাৎ মোস্তাফিজের কণ্ঠ। উচ্চ স্বরে কান্না আর সঙ্গে বাংলা গালির বিস্ফোরণ। হাজমকে উদ্দেশ্যে করে ওর যত গালির ভান্ডার ছিল, তার সবই ব্যবহার করল। আল্লাহর কাছেও তার ফরিয়াদ, সে কি এই চেয়েছিল। নির্ঘাত নয়। বেশ কিছুক্ষণ আবারও কলেমা-সুরা পড়ল। কাঁদল। কখনো উচ্চ স্বরে কখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে তার স্বর নেমে এল। খুব সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল।
দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা। গলির প্রবেশ পথে গর্ত করে কলাগাছ লাগানো হয়েছে। সূর্য ডোবার আগেই সেই কলাগাছে ঘিরে রং-বেরঙের কাপড় আর বিজলি বাতি লাগানো হলো। রাতে শুনি মাইকে মুজিব পরদেশির গান, ‘কান্দিস নারে বিন্দিয়া, কী আর হবে কান্দিয়া’। খবর পেলাম মোস্তাফিজদের পাশের বাড়ির চুমকির বিয়ে। সে মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। ঘটনা কি? এত তাড়াতাড়ি আর অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভালো ছেলে পাওয়া গেছে। ছেলে কুয়েত থাকে। সেখানে এক ধনী লোকের বিশ্বস্ত গাড়ির চালক। আয়–রোজগার ভালো। ছেলের মা চুমকিকে দেখে খুব পছন্দ করেছে। বিয়েতে ছেলে দেশে আসতে পারবে না। কোনো সমস্যা নাই। ফোনে বিয়ে হবে। এ উপলক্ষে মোস্তাফিজদের বাসার হলুদ ফোনকে বউয়ের মতো করে সাজানো হয়েছে। ফোনের চারপাশে তাজা ফুলের মালা ও নিচে শীতল পাটি দিয়ে তার ওপর ফোন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিক-ওদিক আলপনাও আঁকা হলো। ফোন ব্যবহার করা হবে বলে মোস্তাফিজের মা অনেকটা ছেলে পক্ষের মতো আচরণ শুরু করল। অনেকটা দেমাগী আর প্রভাবশালী মহিলাদের মতো। কারণে–অকারণে সুযোগ ও লোক বুঝে বকাঝকা করছে। মোস্তাফিজের মুসলমানির ক্ষত তখনো শুকায়নি। প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেলে তার ভীষণ কষ্ট। তখনো সে পায়ে বেড়ি পরা দাগি আসামিদের মতো করে সামনের এক হাতে লুঙ্গি ধরে খুব ধীরে ধীরে হাঁটে। চুমকির বিয়ে হবে পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার।
জুমার নামাজের আগেই ছেলে পক্ষের অনেক লোক চলে এল। যেহেতু জামাই ছাড়া বিয়ে। তাই গেট ধরাধরির কোনো বালাই নেই। কনে বা মেয়ে পক্ষ থেকে বাসার সামনে সামান্য উঠোনেই ছোট্ট শামিয়ানা টাঙিয়ে তাতে বাবুর্চিদের রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। নামাজের জন্য কয়েক ঘণ্টা গান বন্ধ। জিমি নামের এলাকার বেওয়ারিশ কুকুরটারও সেদিন ছিল সুদিন। একটু পরপর রান্নারত বাবুর্চিদের কাছে যেয়ে উঁকিঝুঁকি মারে। এর মধ্যে কয়েকবার গরম পানির ঝাপটা খেয়ে সে ফিরে এসেছে। বেশি সুবিধা করতে পারেনি। নামাজ শেষে এলাকার হুজুরসহ ছেলেপক্ষের জনা পঞ্চাশেক লোক এল। মেয়েপক্ষ চুমকিকে নিয়ে টেলিফোন রুমে বসে অপেক্ষা করছে। ছেলে কুয়েত থেকে যেকোনো সময় ফোন করবে। এমন সময় বাইরে কিছুটা হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া গেল। কেউ একজন দ্রুত দৌড়ে এসে খবর দিল, দুই পুলিশ নিয়ে বিয়ে বাড়িতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আসছেন। বড় রাস্তার মোড়ে ওই গাড়ি থেকে খবরদাতার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, চুমকিদের বাড়ি কোথায়। তারা সেই চুমকিকে খুঁজছে যার আজকে বিয়ে হওয়ার কথা।
সম্ভবত বিয়েতে দাওয়াত না পাওয়া কোনো এক প্রতিবেশী অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দেওয়ার খবর ফলাও করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই খবর পুলিশের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। ম্যাজিস্ট্রেট আসবার আগেই চুমকির এক মামা দ্রুত এক সমাধান বের করে দিল। সে মোস্তাফিজের বাবার সঙ্গে কানে কানে কিছু একটা শলাপরামর্শ করলেন। মুহূর্তেই লুঙ্গিপরা মোস্তাফিজকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাকে হলুদ রঙের ডোরাকাটা নতুন শার্ট আর লুঙ্গি পরানো হলো। চুমকিকে সরিয়ে তার জায়গায় মোস্তাফিজকে বসানো হলো। চুমকি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই তার সাজসজ্জা বদলিয়ে দ্রুত অন্য বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। চুমকির মামা আর মোস্তাফিজের বাবা দুজনে কলাগাছের গেটের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ম্যাজিস্ট্রেট আর দুই পুলিশকে মোস্তাফিজের মুসলমানির দাওয়াত খাওয়াবেন বলে।

মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র