'রাজার মতো' নাশতার খেসারত

‘নাশতা করো রাজার মতো, দুপুরের খাবার হবে প্রজার মতো আর রাতে খাবে ভিক্ষুকের মতো।’ এক ভদ্র মহিলা সুন্দর জীবন–যাপনের ২৫টি টিপস ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। কপি করতে পারিনি, সব ক’টি মনেও রাখতে পারিনি। তবে আরও দু’টি পরামর্শ মনে আছে। এর একটি প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে হাঁটো, দিনে কমপক্ষে দুজনের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।
সকালের নাশতা রাজার মতো দূরে থাক, অনেক সময় ভিক্ষুকের মতোও করা সম্ভব হয় না। প্রধান কারণ, সময়। ঘুম থেকে উঠেই কাজ। বিশেষ করে স্ত্রীর। আমাকে নিয়ে যেতে হয় দশ মাইল ড্রাইভ করে। এক কাপ চা বা কফি, সঙ্গে ব্রেড রুটি বা বিস্কুট—এটুকুই যথেষ্ট। সময় হাতে থাকলে কোন কোন দিন একটি ডিম।
মনে মনে রাজার মতো নাশতার খায়েশ থাকলেও মুখ ফুটে কখনো বলা হয়নি। জানি না, কখন কীভাবে স্ত্রী জানতে পারেন আমার খায়েশের কথা। তিনি আমার ইচ্ছা পূরণে যা করেন এ জীবনে তা ভুলতে পারব না।
সে কথায় পরে আসছি।
মনে পড়ে শৈশবের কথা। গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। আমাদের বেশ কিছু ধানি জমি ছিল। সবই বর্গা দেওয়া হতো। যে চাষ করত ফসল তার অর্ধেক, বাকি অর্ধেক জমির মালিকের। ষাটের দশকে মা একবার ঠিক করলেন, বাড়ির কাছের কিছু জমি আমরা নিজেরা করাব, এতে একটু বেশি ফসল পাওয়া যাবে। হালের গরু, লাঙল, জোয়াল ইত্যাদি কেনা হলো। পাশের গ্রামের প্রায় মধ্যবয়সী শক্ত সামর্থ্য পুরুষ মোবারককে নিয়োগ দেওয়া হলো কৃষি কাজের জন্য। মোবারক ভোরে জমিতে চলে যেতেন, কয়েক ঘণ্টা হালের পর ঘরে ফিরতেন সকালের খাবার খেতে। মা ইতিমধ্যে তার খাবার তৈরি করিয়ে রাখতেন। গরম ভাতে ভরা মধ্যম সাইজের বউল তার সামনে পরিবেশন করা হতো। বউলের সব ভাত শেষের পর আবার অর্ধেক বউল ভাত মোবারককে দেওয়া হতো। তাও শেষ হয়ে যেত। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, চার/পাঁচজনের খাবার একজন কী করে খেতে পারেন? মা এসে জানতে চাইতেন, মোবারক, আরেকটু দেব? আমতা-আমতা করে মোবারকের উত্তর, চাচি, দিলেতো ভালোই হতো। মা আবারও দিতেন।
পরে, অনেক পরে, নিজেই বুঝলাম, যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাদের চাহিদা কী হতে পারে। হাল চাষে আমি পারদর্শী হতে পারিনি, লাঙলের ফলা গরুর জন্য বিপজ্জনক হবে, এই ভেবে হাল ধরিনি। তবে ধান কেটেছি, ভার বয়ে ঘরে নিয়ে এসেছি। ধান কাটার মৌসুম ছিল উৎসব আর আনন্দের। প্রতিদিন দুপুরে ঘরে আয়োজন থাকত ১০/১৫ জনের খাবারের। সহজ অথচ মজাদার সব খাবার। পঞ্চাশ বছর পরও ভুলিনি সে স্বাদ। ছোট মাছ, চিংড়ি বা শুঁটকির সঙ্গে মুলা, মুকি বা এ জাতীয় সবজির তরকারি, আমড়ার টক, সঙ্গে ডাল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাঠে ধান কাটার পর থাকত খাবার বিরতি। ঘরের লম্বা বারান্দায় কখনো গোল হয়ে, কখনো দুই সারিতে খেতে বসতেন সবাই। কী মজা আর কী যে আনন্দ সে খাবারে তা বলে বোঝানো যাবে না। খুবই উপভোগ করতাম। উদরপূর্তি তো হতোই।
এই খাবারের মতোই আনন্দ পেতাম জমির আইলের খাবারে। হাল বিরতিতে ঘর থেকে মাটির সানকিতে গামছায় বেঁধে আনা খাবার এত মজার যে হতে পারে, না খেলে কাউকে বোঝানো যাবে না। এই আনন্দ পরিশ্রমী মানুষের, যার অংশীদার আমি হয়েছিলাম। এ ছাড়া এটি বাঙালির কৃষি ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও।
নিউইয়র্কের অ্যাস্টোরিয়ার ৩৯ অ্যাভিনিউয়ে যখন বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল, তখন কিছুদিন ‘রাজার মতো’ নাশতা করেছিলাম। অফিসের কাছেই সাবওয়ে স্টেশন। স্টেশনের সিঁড়ির মুখেই একটি রেস্তোরাঁ। প্রথম দিন ঢুকে শুধু কফি ও ব্যাগল টোস্টের অর্ডার দিলাম। তখন দেখলাম রেস্তোরাঁভর্তি লোকজন রকমারি খাবার উপভোগ করছেন। আগ্রহ বাড়ল। নাশতার মেনু চেয়ে নিলাম। ব্রেড টোস্ট, চিজ, মাখন, ডিম, পটেটো স্ক্রাম্বল, কমলার জুসসহ আরও কত কি! মাংস পরিহার করলাম। বেশ কিছুদিন রেস্তোরাঁটি আমার প্রিয় গন্তব্যে পরিণত হলো। দেরিতে হলেও বুঝলাম আমেরিকানদের কাছে সকালের সমৃদ্ধ নাশতার গুরুত্ব অপরিসীম।
আগের কথায় ফিরে আসি। আমার স্ত্রী ‘রাজার মতো’ সকালের নাশতার স্বাদ আমাকে দিয়েছিলেন। বয়সের সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। আগের অর্ধেক খেলেও মনে হয় ঢের খেয়েছি। আল্লার কাছে লাখো শুকরিয়া, ডায়াবেটিস নেই। আমার যে অগোছালো ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, এতে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। ডায়াবেটিস নেই জানার পরও মিষ্টির প্রতি আমার লোভ কম। এটা ভালো লক্ষণ। ডায়াবেটিসে ভুগছেন এমন অনেকের মিষ্টির প্রতি ভালোবাসা আমি দেখেছি। কোন অনুষ্ঠানে গেলে স্বামীকে চোখে চোখে রাখেন স্ত্রী। স্বামীর ডায়াবেটিস, মিষ্টি খেয়ে ফেলেন কিনা। স্ত্রীর অগোচরে স্বামী বেচারা মিষ্টি গলাধঃকরণ করছেন দ্রুতলয়ে—এই দৃশ্য দেখেছি বহুবার। একবার এক বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে গেছি। আশির বেশি বয়স এমন এক বৃদ্ধ সেখানে অতিথি। খাবারের আগ মুহূর্তে তাঁর পুত্রবধূ এসে ইনসুলিন দিয়ে গেলেন। খাবারের শেষ দিকে পরিবেশন করা হলো বড়সড় রসালো মিষ্টি। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন, তারপর একটি বাটি হাতে নিয়ে তাতে বড় একটা মিষ্টি তুলে খেতে শুরু করলেন। শুরুর আগে একটি কথাই শুধু বললেন, ইনসুলিন নিয়েছি তো।
যাক এসব কথা।
সেদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। স্ত্রীর কাজে বিলম্ব হবে ভেবে ঘরে চা-ও খাওয়া হলো না। গাড়ি নিয়ে ছুটলাম দ্রুত। অবশ্য ট্রাফিক ভালো থাকায় সময়মতো পৌছে গেলাম। স্ত্রী বললেন, গাড়িতে একটু অপেক্ষা করো, তোমার জন্য কফি নিয়ে আসি। একটু পর তিনি ফিরে আসলেন, এক হাতে কফি, অন্য হাতে একটি বক্স। সকালের নাশতা। পাশের সুপার মার্কেট থেকে কেনা। স্প্যানিশ অধ্যুষিত এই এলাকা। ক্রেতারাও বেশির ভাগ স্প্যানিশ। খাবারও অনেকটা স্প্যানিশ ঘরানার। স্ত্রী বললেন, খেয়ে নিয়ো গরম-গরম, আমি চললাম। বাক্স খুলে দেখি এলাহি কারবার। অনুমান চারজনের খাবার। ব্রেড, মিষ্টি আলু, চিজ, আধা সিদ্ধ ও ভাজি করা চারটি ডিম, সঙ্গে আরও দু–একটি স্প্যানিশ আইটেম। সুস্বাদু। কী ভেবে গাড়িতে বসেই পরম আয়েশে বাক্সের সবটুকু খেয়ে ফেললাম। সারা দিন কাটল, আর কিছু খেতে হলো না। কোন খিদেও পেল না।
ওইদিন সন্ধ্যার পর বোনের বাসায় দাওয়াত। প্রচুর খাবারের আয়োজন। সবাই খেল, আমি খেতে পারলাম না। আসলে খেতে ইচ্ছেই হল না। বোন এসে বারবার জিজ্ঞেস করছে, আমি রাগটাগ করেছি কিনা। অসুস্থতার কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দিলাম। এবার এলেন স্ত্রী। ঘটনা কী, তুমি খাচ্ছ না কেন? বললাম, উত্তর তো তোমার জানা, চারজনের খাবার একাই খেলাম। খাবারের আর জায়গা কোথায়?
কেন, ওই খাবারতো ছিল একজনের।
একজনের?
হ্যাঁ।
বুঝেছি, যারা খায় তারা হয়তো প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করে, এজন্য হজম হয়ে যায়। আমার খাওয়া ঠিক হয়নি।
পরদিনও কিছু খেতে পারলাম না। সেদিন ছিলাম আমার বড় বোনের বাসায়৷ বড় বোন ডাক্তার। তিনি জেনে গেলেন, না খেতে পারার আসল কারণ। হার্ট, কিডনিসহ কত সমস্যা নিয়ে আমি আছি। বড় বোন কিছুক্ষণ বকাঝকা করলেন। আমার মোটেই উচিত হয়নি এ রূপ খাবারের। বকাঝকার পর এখন আমাকে কী করতে হবে—সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিলেন।
দ্বিতীয় দিন কাটল না খেয়ে। কোনো খিদে নেই। তবে আছে অস্বস্তি। অনুভবে অস্বাভাবিকতা। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম, কেন রাক্ষুসে কাণ্ড করতে গেলাম। শৈশবের ধানি মাঠের সেই আমি যদি হতাম, তাহলে এই ভোগান্তি হতো না। আমিতো এখন কোন পরিশ্রমী মানুষ নই। বদহজম তো হবেই।
যা হোক, তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ঝাউ ভাতের মধ্য দিয়ে এ কাহিনির অবসান হলো। এরপর থেকে আর কখনো রাজার মতো নাশতার চিন্তাও মাথায় আসেনি।
অবশ্য আমার স্ত্রীর ননদেরা একটু কৌতুক করে বলে, ও ভাবি, বলবে কী, ওই খাবারটা কোথায় পাওয়া যায়, যা খেলে তিন দিন খেতে হয় না!
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।