কাজের মধ্যে বাঁচতে চান সেলি টেইলর

সেলির দোকান থেকে কেনা হাতঘড়ি। ঘড়িটির চেইন তাঁর নিজ হাতে নীলকান্তমণি পাথর দিয়ে বানানো ও রং করা
সেলির দোকান থেকে কেনা হাতঘড়ি। ঘড়িটির চেইন তাঁর নিজ হাতে নীলকান্তমণি পাথর দিয়ে বানানো ও রং করা

ফ্লোরিডার পিনালেস কাউন্টির ওয়াগন হুইল ফ্লি মার্কেটে গিয়েছিলাম শপিং করতে। হঠাৎ নজর পড়ে খুবই বয়স্ক একজন নারীর দোকানে বেশ কিছু ক্রেতার ভিড়। আগ্রহ থামাতে না পেরে গিয়ে দেখলাম এটা নীলকান্তমণি পাথর দিয়ে পুঁতি ও মালার হস্ত ও কারুশিল্পের দোকান। ক্রেতারা পছন্দের মালা, কানের রিং, নাকের রিং বা পায়ের নূপুর কিনছেন আর দোকানদার বয়স্ক নারী মালা গাঁথছেন। তাঁকে এতই বয়স্ক মনে হয়েছিল যে তাঁর সঙ্গে কথা বলার কৌতূহল জাগল এবং আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য।
অপেক্ষা শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর কথা বলে জানলাম তাঁর নাম সেলি টেইলর। ৯৬বছর বয়সী এই ‘তরুণী’ নীলকান্তমণি পাথর দিয়ে পুঁতি ও মালার কাজ করছে ৫৫বছর থেকে। সেলি বললেন, এই ফ্লি মার্কেট যখন প্রায় ৫০বছর আগে ৪টা অস্থায়ী কুটির দিয়ে তৈরি হয়, তখন থেকে তিনি এখানে নিজের হাতের তৈরি শিল্পগুলো বিক্রি করছেন।
এত ছোট পুঁতির একটা মালা গাঁথতে দেখে আশ্চর্য হলাম, তিনি চোখে দেখেন এখনো ঠিকঠাকমতো। ‘চোখে কেমন দেখেন’ প্রশ্নের উত্তরে সেলি বলেন, তাঁর একটু কষ্ট হয়, তবে তাঁকে দেখতে হবে। চোখই যে তার বেঁচে থাকার ও রোজগারের সম্বল। সেলির হাতে, চোখে ও মুখে যে বয়স ফুটে উঠেছে তা দেখে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে তিনি একটা চেয়ারে বসে কাজ করছেন আজও। সেলি বললেন, এই মালাকে এত সুন্দর করার ইচ্ছা যা তিনি এই ৫৫বছরেও পারেননি! ভাবতে অবাক লাগল এই বয়সে নিজের কাজ আরও ভালো করার এই অদম্য ইচ্ছা দেখে; যা আমাদের মাঝে খুবই বিরল।
সেলির কাছে তাঁর ছবি তোলার অনুমতি চাইলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি কেউ তাঁর দোকানের ছবি তোলে নেবে এটা তিনি চান না। সেলির মতে, তাঁর ছবি তুললে এই বয়সে তাঁর কাজ দেখে মানুষের অন্তরে যে ভালোবাসা জাগবে, তাতে মানুষ বেশি করে তাঁর বানানো হস্তশিল্প কিনবে। সেটা তাঁর কাজের পুরোপুরি কৃতিত্ব হবে না, অংশীদার হবে তাঁর বয়সের ছাপ যা তিনি কখনোই চান না।
সেলির দোকানে জিনিসপত্রের তুলনামূলক সস্তা দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে এসব জিনিসের বর্তমান মূল্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন তিনি। যাতে তাঁর কখনো মনে হয় না যে ক্রেতাগণ তাঁকে বা তাঁর বয়স দেখে তাঁর দোকানে যাচ্ছেন! তিনি চান মানুষ পণ্যের গুণগত মান ও বাজার মূল্য যাচাই-বাছাই করেই আসুক তাঁর দোকানে।
“এত বছর বয়সেও কীভাবে কাজ করছেন” প্রশ্নটার উত্তরে সেলি বলেন, নীলকান্তমণি পাথর দিয়ে পুঁতি ও মালার হস্ত ও কারুশিল্পের কাজ শুধু তাঁর শখই নয়, এটা তাঁর বেঁচে থাকার প্রয়োজন, আশা, স্বপ্ন ও জীবন। কারণ কাজ ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেলি মরতে চান না, তিনি তাঁর কাজ নিয়ে বাঁচতে চান মানুষের অন্তরে।
আসার সময় সেলির দোকান থেকে একটা হাতঘড়ি কিনি। ঘড়িটির চেইন তাঁর নিজ হাতে নীলকান্তমণি পাথর দিয়ে বানানো ও রং করা। অপূর্ব এর কারুকাজ। সেলি বলেন, যে এই ঘড়িটা ব্যবহার করবে তাকে খুব মানাবে ঘড়িটাতে এবং এই ঘড়ির চেইন ব্যবহারকারীর জীবনে সবচেয়ে সুন্দর ও স্মৃতিময় হয়ে থাকবে। যেমনি একদিন এই ঘড়িটার কাটা বন্ধ হয়ে যাবে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগে বা ব্যাটারির মেয়াদ শেষে, তেমনি মানুষও এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে হঠাৎ কোনো অসুখে-বিসুখে বা পরমায়ু শেষ হলে। ঘড়ির ব্যবহারকারীর এই চেইন ভালো লাগলে হয়তো চেইনটি স্থান পাবে অন্য কোনো এক নতুন ঘড়িতে। ঠিক তেমনি, মানুষের কাজ ভালো লাগলে মানুষ মরেও বেঁচে থাকবে তারই পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মে।
“বাই-বাই” বলে আসার সময় আমার মনে না থাকলেও সেলি আমাকে ও আমার প্রিয়জনদের নববর্ষের শুভেচ্ছা দিতে ভুল করেননি । তাই, আমি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সহযোগিতায় আমার দেশের প্রত্যেক মানুষকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি ও সেলির জীবনাদর্শ পৌঁছে দিতে নিজ নিজ কাজকে শখ ও দায়িত্বের মাধ্যমে আরও ভালো করার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ আমরা প্রত্যেকে দেশপ্রেমিক হব তখনই, যখন আমরা আমাদের প্রত্যেকের কাজ আরও ভালো করতে আপ্রাণ চেষ্টা করব।