হে প্রভু, তাদের হেদায়েত করো

দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে সৌদি আরব থেকে ফেরা কয়েকজন নারী। ছবি: সংগৃহীত
দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে সৌদি আরব থেকে ফেরা কয়েকজন নারী। ছবি: সংগৃহীত

আমার ভ্রাতুষ্পুত্র নিউইয়র্কে এক হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সেদিন এক পারিবারিক আড্ডায় আমরা কথা বললাম নানা বিষয়ে। আড্ডায় সৌদি সাংবাদিক খাশোগির নির্মম খুনের প্রসঙ্গও এল। এল বর্বরতার কথাও। একপর্যায়ে ভ্রাতুষ্পুত্র বলল, শুনুন এক বাস্তব ঘটনা। আমার হাসপাতালে চাকরি করেন ফিলিপাইনের এক নার্স। এর আগে তিনি চাকরি করতেন সৌদি আরবে। সেখানকার একদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন তিনি। সে ঘটনা তিনি কখনো ভুলতে পারেন না এবং কেন ঘটল তাও জানেন না। একদিন তিনি ও এক শ্বেতাঙ্গ নার্স এক শপিং মলে কেনাকাটা করতে গেছেন। তাদের চুল ছিল খোলা। মুসলমান না হওয়ায় হিজাব পরার কথা ভাবেননি। হঠাৎ এক ধর্মীয় পুলিশ এসে তাকে নির্দয়ভাবে প্রহার শুরু করল। হত বিহ্বল নার্স। আরও অবাক হলেন, চুল খোলা শ্বেতাঙ্গিনীকে ধর্মীয় পুলিশ কিছুই বলল না। কেন? এই কেন–এর জবাব আজও তিনি পাননি।
দ্বিতীয় ঘটনা, নিউইয়র্কে বাংলা পত্রিকার আমার এক সহকর্মী ওমরা হজের জন্য সপরিবারে সৌদি আরব গেছেন। তিনি, তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান। তার দুটি সন্তানের জন্ম বাংলাদেশে, একজনের আমেরিকায়। সম্ভবত মদিনায় যাওয়ার পথে তাদের কাফেলা আটকে যায়। পাসপোর্ট বা কাগজপত্র সংক্রান্ত ঝামেলা। তাদের পাঁচটি পাসপোর্ট ছিল একসঙ্গে। সবার নিচে ছিল সর্বকনিষ্ঠের আমেরিকান পাসপোর্ট। অন্য চারটি বাংলাদেশের। ‘মিসকিন’ ভেবে হয়তো বাংলাদেশের পাসপোর্টের কদর হচ্ছিল না। হঠাৎ নিচের আমেরিকান পাসপোর্ট দেখে একজন ‘মিরকিন’ ‘মিরকিন’ (মার্কিন) বলে চেঁচিয়ে উঠল। এই সঙ্গে তাঁদের জন্য বয়ে নিয়ে এল আশীর্বাদ। কনিষ্ঠ সন্তানের মার্কিন পাসপোর্টের খাতিরে বিনা ঝামেলায় তারা গন্তব্যে যেতে পারলেন।
তৃতীয় ঘটনা, আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের। সিলেটে বাড়ি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য ঠিক করলেন সৌদি আরব যাবেন। ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ওখানে যাওয়ার তিন মাস পর ফিরে এলেন। ঘটনা কি? ফিরে এলেন কেন? বৈধ কাগজপত্র ছিল না? শারীরিক শ্রম দিতে পারেননি? অসুস্থ ছিলেন? না, এর কোনটিই নয়। তার জবানিতেই শুনুন—যাওয়ার পর এক সৌদির বাসায় কাজ জুটল, গৃহভৃত্যের। যা কখনো করিনি তাই করতে থাকলাম। কত কষ্ট! সব মুখ বুজে মেনে নিলাম দুটো পয়সার জন্য। বাড়ির সিঁড়ির এক কোণে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো, তাও মেনে নিলাম। কিন্তু একটি বিষয় মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার খাবার একটা প্লেটে করে বাইরে রেখে যেত। আমাদের গ্রামেগঞ্জে কুকুরকে যেভাবে খাবার দেওয়া হয়—অনেকটা সেরকম। মানুষ হিসেবে গণ্য করত না। এ আচরণ আমার আত্মমর্যাদায় প্রচণ্ড আঘাত করে। আমি ভেতরে-ভেতরে দগ্ধ হতে থাকি। পরে ঠিক করলাম, যেখানে আমাকে মানুষই ভাবে না, সেখানে থাকব না। তাই ফিরে এলাম।
আর ঘটনার কথা বলব না।
সৌদি বর্বরতার কাহিনি তো প্রায়ই পত্রপত্রিকায় বের হয়। ইস্তাম্বুলে খাসোগির দেহ টুকরো টুকরো করার বর্ণনায় শিউরে উঠি। কয়েক বছর আগে যে দিন আটজন বাংলাদেশিকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করে সে দিন থেকে সৌদি সমাজ ও সরকারের প্রতি আমার মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। যখনই ও কথা মনে হয়, ভয়ে ও আতঙ্কে আমি গুটিয়ে যাই। সহ্য করতে পারি না। অস্থির সময় কাটে। ভেবে পাই না, মানুষ কি করে এত নিষ্ঠুর হয়!
১৯৮৯ সালে আমি প্রথম আমেরিকা আসি। সে সময় নিউইয়র্কের গভর্নর ছিলেন মারিও কুমো। বর্তমান গভর্নরের বাবা। তখন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে মৃত্যুদণ্ড প্রথা ছিল না। কুমো ছিলেন এর বিরোধী। পরে প্যাটাকি গভর্নর নির্বাচিত হয়ে মৃত্যুদণ্ড চালু করেন। আমেরিকার ৫০ অঙ্গরাজ্যের কোনটিতে মৃত্যুদণ্ড আছে, কোনটিতে নেই। ইউরোপে মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলোপ করা হয়েছে।
মারিও কুমোর একটি সাক্ষাৎকার টিভিতে শোনার সুযোগ আমার হয়েছিল, ওই সাক্ষাৎকারে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমি এ নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। কোনো অবস্থাতেই আমি মৃত্যুদণ্ড প্রথার অনুমোদন দিতে পারি না।
সংবাদমাধ্যমে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের খবর মাঝেমধ্যে বের হয়। প্রকাশ্যে তা কখনো কার্যকর হয় না। সামান্য অনিয়ম বা নিষ্ঠুরতার আঁচ পাওয়া গেলে হইচই পড়ে যায়। এদিকে আরবে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে শিরশ্ছেদ করা হয়। শত শত লোক দাঁড়িয়ে আবার তা দেখেন। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর আচরণ! আমিতো দেখার আগেই হার্টফেল করে মারা যেতাম। কৈশোরে বাড়িতে মুরগি জবাই করে দিতাম, বড় হওয়ার পর আর তা পারিনি। চিত্ত দুর্বল বলে কি? জানি না।
সংবাদমাধ্যমে দেখি, বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে দলে দলে দেশে ফিরে আসছেন। তাদের হৃদয়বিদারক কাহিনি পড়ে অশ্রু সংবরণ করা যায় না। বর্বর আচরণের কারণে অনেক দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ কেন যে অনুমতি দিল, তা জানতে ইচ্ছে করে। এতো জেনেশুনে বিষপান! আত্মমর্যাদা পুরোপুরি বিসর্জন। কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য কারও কারও মতে, সৌদি আরবে বাংলাদেশের ২৫ লাখ মানুষের রেমিট্যান্স দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সৌদি সরকারের কোনো অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের সক্ষমতা এখনো বাংলাদেশ অর্জন করেনি। তাই বলে কি আমার মা–বোনদের অবমাননা করবেন?
গত মে মাসে আমি ঢাকায় ছিলাম। সৌদি আরব থেকে ফেরত নারীদের করুণ কাহিনি পত্রপত্রিকায় সে সময় পড়েছি। একটি পত্রিকা আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম, তার একটি প্রতিবেদনের কিছু লাইন আমি উদ্ধৃত করছি—
‘...শারীরিক এই নির্যাতনের বাইরে সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ, অধিকাংশ নারীই মারাত্মক যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দেশটিতে। একই পরিবারের একাধিক পুরুষ সদস্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ। এমনকি বাবা-ছেলে মিলেও ধর্ষণ করে গৃহকর্মীকে। নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ যে, এতে করে জরায়ুতে ক্ষত তৈরি হয়েছে।...গত চার মাসে প্রায় আড়াই হাজার নারীকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্যে শতকরা ৮০ জনই ভয়াবহ রকমের যৌন নির্যাতনের শিকার। ফিরে আসা নারীরা দেশটিতে আর কোনো নারীকর্মী না পাঠানোরও অনুরোধ করছেন...।’
আমি মাঝেমধ্যে ইউটিউব, ফেসবুক বা টেলিভিশনে আলেম সাহেবদের বক্তৃতা শুনি। গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকি এই নারী নির্যাতন বিষয়ে কেউ কিছু বলুক। কারণ তাঁদের কথার মূল্য আছে, গুরুত্ব আছে। তাঁদের কারও কারও বক্তৃতায় জানার, শেখার অনেক কিছু থাকে। আবার কারও কারও কিছু কিছু কথা আমার বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। শিল্পী আয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে এই বিতর্কের কি কোনো প্রয়োজন ছিল? একদিন এক বক্তাকে শুনলাম খুব রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করছেন, কীভাবে তিনি বাসের নারী আসনে বসে ভ্রমণ করলেন এক নারী যাত্রীকে দাঁড় করিয়ে রেখে। আরেকদিন আরেকজন বক্তৃতায় প্রবাসী স্বামীর টাকা দিয়ে দেবরের জন্য ভাবির মোটরসাইকেল কেনার কাহিনি বর্ণনা করলেন। আরেকদিন শুনলাম, এক বক্তা জোর গলায় দাবি করছেন, রাস্তাঘাটে নারী লাঞ্ছনার জন্য তাঁর পুরুষ ভাইয়েরা মোটেই দায়ী নয়। দায় নারীর বেপর্দা ও স্বল্প পোশাক–আশাক।
এই বক্তারা যদি একবার আওয়াজ তুলতেন, প্রতিবাদ করতেন নারী নির্যাতনের, আলোড়ন উঠত সব জায়গায়। কাজ হোক আর না হোক, অন্তত নৈতিক দায়িত্বটুকুতো পালিত হতো।
মনে পড়ে, আমাদের শৈশবে শুনেছিলাম, তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য সিলেটের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মশাহিদ আলী মক্কার ইমামের খুতবায় ভুল ধরিয়ে দিয়ে মুসলিম বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন। আমাদের এ যুগে কি কোনো মাওলানা মশাহিদ আলী নেই? আমি তা বিশ্বাস করি না।
আসুন, এই নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করি, অন্তত এই দোয়া করি, হে প্রভু এদের হেদায়েত কর, সুমতি দাও। আমাদের দাও তোমার করুণা।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।