বাংলা সংগীতের আধুনিকায়ন

বাংলা গানের ইতিহাস সহস্র বছরের। চর্যাপদ কিংবা তারও আগে শুরু হয়েছিল সুরে সুরে পদাবলি উপস্থাপনের রীতি। বাংলার প্রকৃতিতে, নদীতে ও আকাশে যে সুর ভাসে তাতে আন্দোলিত হয়ে বাঙালি তার মনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা, স্বপ্নের কথা বলে বেড়ায়। এসব গানের কথায় ও সুরে লেগে থাকে সোঁদা মাটির গন্ধ, তাই এ গান এত অকৃত্রিম হয়ে ওঠে। এ লোক সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হয় ধ্রুপদি সংগীত, মোগল সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায়। ধীরে ধীরে সে সংগীত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, নতুন ধারার এক সংগীতের সূচনা করে যা মূলত: শিক্ষিত সমাজেই সীমাবদ্ধ থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের হাত ধরে ধ্রুপদি সংগীত ব্যাপক প্রসার লাভ করে, মিশে যায় লোক সংগীতের সঙ্গে। তৈরি হয় নতুন ধারা, “আধুনিক গান”। ফলে বাংলা সংগীতের প্রধানত: তিনটি ধারা তৈরি হয়, “উচ্চাঙ্গ”, “আধুনিক” ও “লোক সংগীত”। অনেকে কিছু কালজয়ী গানকে “হারানো দিনের গান” বলে প্রচার করেন, কিন্তু তা ঠিক নয়। যে গান আজও শুনতে ভালো লাগে তা সব সময়ই আধুনিক। সমস্যা হলো, এ “আধুনিক” শব্দটি নিয়ে কিছু মেধাহীন সংগীতজন ব্যবসা ফাঁদেন। মেধা ও সাধনা ব্যতিরেকে জনপ্রিয় হওয়ার অভিপ্রায়ে বাংলা সংগীতের আধুনিকায়নে ব্রত হয়েছেন। এ প্রচেষ্টায় কেউ কেউ সাময়িকভাবে লাভবান হলেও সুদূরপ্রসারী কোনো ফল পাচ্ছেন না, আমাদের সংগীতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না।
আমরা জানি, সংগীতের প্রধান চারটি উপাদান, কথা/বাণী, সুর, যন্ত্রাণুষঙ্গ ও গায়কি। অধুনা সংগীতের সঙ্গে দৃশ্যতাও যোগ হয়েছে, গান শোনার পাশাপাশি চলচ্চিত্র দেখেও দর্শক আনন্দ পান। তবে একটি গানের মূল উপাদানগুলোর উৎকর্ষ না ঘটলে দৃশ্য আর নাচ দিয়ে কোনো গানকে উতরে নেওয়া যাবে না। সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মেধা, জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটলেই কেবল একটি গান সমৃদ্ধ হয়, হৃদয়গ্রাহী হয়, এবং সর্বোপরি কালোত্তীর্ণ হয়। একটি গান হয়তো হঠাৎ মন কাড়তে পারে, একজন শিল্পী চট করে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু মূল উপাদানে ঘাটতি থাকলে সে গান ও সে শিল্পী হারিয়ে যায় অচিরেই। অনেক সংগীতজন স্বল্প পরিশ্রমে দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার প্রয়াস পান, এর জন্য তাঁরা সংগীত চর্চা না করে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। এর মাঝে একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল হচ্ছে “সংগীতের আধুনিকায়ন”। যেন এত দিনের সংগীত সব পুরোনো ও বস্তাপচা হয়ে গেছে, বর্তমান যুগের সঙ্গে মানানসই নয়, ভবিষ্যতে তো টেকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায়, এ যেন “নতুন বোতলে পুরোনো মদ”। একই মালমসলা নতুন করে উপস্থাপনের চেষ্টা। তাতেও ক্ষতি ছিল না যদি বিষয়টি সততার সঙ্গে মেধা ও দক্ষতা দিয়ে করা হতো। আসলে মেধা ও সাধনার ঘাটতি ঢাকতেই নতুন আভরণের চেষ্টা।
আগে যেমন বলেছি, একটি গানের সবগুলো উপাদান উৎকৃষ্ট হলে সে গান কালোত্তীর্ণ হয়, যা যে কোনো সময়েই আধুনিক থাকবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ এবং আরও অনেকের বহু গান এত যুগ পরেও আজ একেবারে আধুনিক। এসব গানের নতুন করে আধুনিকায়নের চেষ্টা বাতুলতামাত্র। প্রথমে আসি গানের বাণী প্রসঙ্গে। গানের বাণী একটি কাব্য, একটি সাহিত্যকর্ম। সে কারণেই অধিকাংশ কবিরা গান লেখেন; আবার যাঁরা শুধু গীতিকার হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন তারাও প্রকারান্তরে কবি। অনেক বিখ্যাত কবিতা পরবর্তী সময়ে সুরারোপিত হয়েছে। আবার অনেক গান কবিতা হিসেবে আবৃত্তি করা হয়। অতএব সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য নিয়েই একটি গান লিখিত হয় বা হওয়া উচিত। কবিতার মতো গানের বাণীও কালোত্তীর্ণ হয় কাব্যগুণে ও বিষয়বৈচিত্র্যে। আর এসব গানের বাণী সব সময়ই আধুনিক। নতুন গানে কাব্য ও বিষয়ে নতুনত্ব আনতে হবে; যা একই সঙ্গে শিল্পোত্তীর্ণ হতে হবে। তা না করে অনেকে কাব্যগুণ বিবর্জিত কথা লিখে দাবি করেন আধুনিক গানের। বহুদিন আগে টেলিভিশনে একটি গানের অনুষ্ঠানে একজন গীতিকার দাবি করলেন, বাংলা গান রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলে এসে থেমে গেছে, তাই তিনি আধুনিকায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তার গানে নতুনত্ব বলতে কেবল ইংরেজি শব্দের বাহুল্য। কোনো কাব্য নেই, রসবোধ নেই, অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। এ কেমন আধুনিকায়ন? ইদানীং আরও একটি প্রবণতা দেখছি, গানের বাণী “তুই” সম্বোধনে লেখা। বিষয় একই, “আমি তোমাকে ভালোবাসি”। শুধু পাল্টে লেখা, “আমি তোকে ভালোবাসি”। “তুই” সম্বোধনে গান হতেই পারে, অনেক কবিতায়ও “তুই” ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু দিন ধরে। কাব্যগুণ ও বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে কবিতায় বা গানে “আপনি”, “তুমি” বা “তুই” যে কোনো সম্বোধন হতে পারে, এতে কোনো নতুনত্ব নেই। নতুনত্ব আসতে পারে বিষয়ে। যেমন, বাংলা গান প্রধানত: কয়েকটি বিষয়ের আবর্তে ঘুরছে, ঈশ্বর বন্দনা, দেশ প্রেম, মানব-মানবীর প্রেম। এর বাইরে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অন্য কোনো বিষয় আমাদের সংগীতে অনুপস্থিত। কাব্যগুণেও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। সৃজনশীলতার পরিচয় না দেখিয়ে শুধু শব্দ পাল্টে আধুনিকায়নের কোনো প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না।
গানের বাণীর পর আসি সুর প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা গানের সুর ভেঙে অনেক নতুন সুর, রাগ ও তাল তৈরি করেছেন। কিন্তু এরপর সুর নিয়ে আর তেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। যেসব নতুন সুরকার সংগীতজগতে আসছেন তাদের অনেকেরই মৌলিক সুর ও রাগের ওপর তেমন জ্ঞান ও দক্ষতা নেই। ফলে তাদের সুরে না থাকছে মৌলিকত্ব, না থাকছে বৈচিত্র্য; অনেক সময় সুরের মৌলিক নিয়মও মানছে না। আর একটি অনৈতিক পন্থা অনেকে অবলম্বন করছেন, বিদেশি গানের সুর নকল করা। কেউ কেউ আবার রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিদেশি সুর আত্মীকরণ করে বাংলায় নতুন গান তৈরি করেছেন। তেমন যোগ্যতা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পারলে যে কোনো গানই কালোত্তীর্ণ হবে।
গায়কি একটি গানের প্রধান শক্তি। একজন শিল্পী তাঁর কণ্ঠের জাদু দিয়ে গানকে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেন। গানের বাণী ও সুর যতই উন্নত হোক না কেন, শিল্পীর জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা না থাকলে সে গান হারিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু এ দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজন দীর্ঘ সাধনা। অথচ কোনো সাধনা ছাড়াই অনেকে শিল্পী হয়ে যাচ্ছেন, এমনকি সাত স্বর “সা রে গা মা পা ধা নি”, স্কেল, তাল ইত্যাদি কোনো প্রাথমিক জ্ঞান না নিয়েই। ফলে এরা আধুনিকায়নের নামে অন্য পথে হাঁটছেন। যেমন, প্রচুর বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ধুমধাড়াক্কা গান গাওয়া, যেখানে কণ্ঠকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইদানীং দেখছি কিছু শিল্পী অকারণে ফিসফিসে কণ্ঠে (হাস্কি ভয়েস) গাইছেন নিজ কণ্ঠের দুর্বলতা ঢাকতে। কেউ কেউ আবার গায়কি বাদ দিয়ে গানের দৃশ্যের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, আকর্ষণীয় স্থানে মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা দিয়ে গানকে উতরে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এরা হয় নিজের অর্থের জোরে কিংবা মিডিয়াতে পরিচয়ের সূত্র ধরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার সাম্প্রতিককালের নানা প্রকার গানের প্রতিযোগিতা রাতারাতি একজনকে তারকাশিল্পী বানিয়ে দিচ্ছে। দুঃখের বিষয়, এদের একজনও বেশি দিন সংগীতজগতে টিকে থাকতে পারছেন না। অনেক শিল্পী আসছেন, দর্শক মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু কয়েক দিন পর সেসব গান বা শিল্পীদের আর কোনো অস্তিত্ব থাকছে না।
বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সংগীতায়োজন আসলে সংগীতের সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভালো গান হলে মানুষ বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই শুনতে পারে, মনে গেঁথে যেতে পারে। যন্ত্রাণুষঙ্গ শুধু অলংকারের কাজ করে। কিন্তু এখানেও আধুনিকায়নের নামে কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। সঠিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারেও প্রয়োজন জ্ঞান ও দক্ষতা। উচ্চকিত যান্ত্রিক শব্দে অনেক সময় গানের মাধুর্য হারিয়ে যেতে পারে। বেমানান যন্ত্রের ব্যবহার শ্রুতিকটু হতে পারে। অনেকের নতুন গান তৈরির ক্ষমতা না থাকায় পুরোনো জনপ্রিয় গানে অযাচিত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে বাহবা কুড়োনোর চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে দেখে অবাক হই, “নতুন সংগীতায়োজনে রবীন্দ্রসংগীত” এ ধরনের কিছু চটকদার নামে রবীন্দ্রনাথের গানের বারোটা বাজাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ একজন অতি আধুনিক মানুষ এবং তাঁর সংগীত আজও আধুনিক। রবীন্দ্রসংগীতে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। এখানে রবীন্দ্রনাথের ওপর টেক্কা দিয়ে বাহাদুরি দেখানোর সুযোগ নেই। আমাদের বাংলা সংগীতে যুগে যুগে প্রচুর বিদেশি যন্ত্র এসে যোগ হয়েছে। সামনে আরও যোগ হতে পারে, কিন্তু সে যোগ হওয়াটা দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। শুধু বাজার দখলের নিমিত্তে করলে সে কাজ শিল্পোত্তীর্ণ হবে না, টেকসইও হবে না।
অতএব সংগীতের মূল চারটি উপাদানে পর্যাপ্ত মেধা, জ্ঞান, সাধনা ও সৃজনশীলতা নিয়েই কারও সংগীতজগতে পদার্পণ করা উচিত। সহজ পথে স্বল্প সময়ে সংগীতে কোনো আসন তৈরি করা যায় না। আর আধুনিকায়নের নামে দর্শক শ্রোতাদের ধোঁকা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সাধনা করুন, সাধনার কোনো বিকল্প নেই। আপনার গানে শিল্প থাকলে তা আপনাআপনি সবার মন জয় করবে। সব ক্ষেত্রেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চমক দেওয়া আর সৃজনশীলতা এক কথা নয়। বাংলা সংগীতের উৎকর্ষ সাধনে প্রয়োজন সংগীতজ্ঞের, মেধাহীন ব্যবসায়ীর নয়।

লেখক: অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, যুক্তরাষ্ট্র