কবি দিলওয়ারের মাটির টান

‘এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস
রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে
আমাকে সজীব করে। ঊর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ
পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখিকে দুলিয়ে।

নিচে জল কল্ কল্ বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা
গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা,
সৃষ্টির পলিতে সে-ই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।

সহসা ফিরিয়ে চোখ চেয়ে দেখি দূর পূবাকাশে
তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ
পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে
দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ ।

ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কিন ব্রিজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।’
কবি দিলওয়ারের কবিতা ‘কিনব্রিজে সূর্যোদয়’। কিনব্রিজ সিলেট শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী সুরমার ওপর নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সেতু। এপারে ভার্থখলা, ওপারে সার্কিট হাউস, সারদা হল। পাশে আলী আমজদের ঘড়ি ও চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি। ১৯৩৬ সালে নির্মিত সেতুর নামকরণ করা হয় তৎকালীন আসামের গভর্নর মাইকেল কিনের নামানুসারে। এ ব্রিজ শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। কবি দিলওয়ারের বাড়ি সেতুর দক্ষিণ পাশের ভার্থখলা গ্রামে। এ গ্রামের পরেই সিলেট রেল স্টেশন।
আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে সিলেট শহর ও শহরতলির মোগলাবাজারে। শহর থেকে ট্রেনে আসা–যাওয়া করতাম মোগলাবাজারে। কিনব্রিজ পার হয়ে ভার্থখলার মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট রাস্তা ধরে শর্টকাট রেল স্টেশনে পৌঁছে যেতাম। ফিরতামও একই পথ ধরে। ওই ছোট্ট রাস্তার পাশেই ছিল ‘খান মঞ্জিল’ কবি দিলওয়ারের বাড়ি। মোগলাবাজারে আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল দিলু ভাইয়ের (কবি দিলওয়ার) বোনের বাড়ি। তাঁর কনিষ্ঠ ভাগনে বাবুল ছিলেন আমার বাল্যবন্ধু। খান মঞ্জিলে আমাদের যাত্রাবিরতি ছিল নিয়মিত। দিলু ভাই ও ভাবি আনিসা দিলওয়ারের আতিথেয়তা ছিল অতুলনীয়।
লেখালেখি বা সাংবাদিকতা জীবন শুরুর আগে থেকেই দিলু ভাই ছিলেন আমার চিন্তা জগতের গুরু ও আদর্শ। দিলু ভাই সবার কাছে পরিচিত ‘গণ মানুষের কবি’ হিসেবে। এর বাইরে তাঁর যে মানবিক গুণাবলি ছিল, তার তুলনা শুধু তিনি নিজে।
দিলু ভাইয়ের কাছে তাঁর জন্ম স্থান ছিল খুবই প্রিয়। শাহজালাল আউলিয়ার ভূমি, সুরমা ও কিনব্রিজ ঘেঁষা জনপদ ভার্থখলার প্রতি ভালোবাসার এতই টান ছিল যে, অন্য কোথাও স্বল্প সময় থাকতেও তাঁর কষ্ট হতো। সব ছেড়ে ছুড়ে ফিরে যেতেন ওই ভার্থখলায়। তাঁর আপন ঘরে। ঢাকা হোক অথবা নিউইয়র্ক, কোথাও কোনো আকর্ষণই তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। ঢাকায় দৈনিক সংবাদ, দৈনিক গণকন্ঠ বা সোভিয়েত পরিক্রমা—কোনো চাকরিই তাঁকে দীর্ঘদিন আটকে রাখতে পারেনি। সবই ছিল স্বল্পকালীন। সোভিয়েত পরিক্রমায় বেতন ছিল খুবই আকর্ষণীয়। আমরা ভেবেছিলাম, এবার হয়তো ঢাকায় স্থায়ী হয়ে যাবেন। কিন্তু কিছুদিন পরই দেখি দিলু ভাই সিলেটে-ভার্থখলায় ফিরে এসেছেন। অন্য কোথাও থাকলে তাঁর দম যেন আটকে যেত, সিলেটে ফিরে নিতেন মুক্তি বা স্বস্তির নিশ্বাস।
২০০৭ সালে দিলু ভাই চার মাসের জন্য আমেরিকায় এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে ওই সময়ের কথা বলতেই আজকের লেখা। তবে তার আগে স্মৃতিচারণ করব নব্বই দশকের শুরুতে আমাদের নেওয়া একটি উদ্যোগের কথা। নিউইয়র্কে কবি দিলওয়ারের ভক্তরা তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে সমবেত হন। বৈঠকে আমাকে সভাপতি ও ফকির ইলিয়াসকে সদস্যসচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে প্রয়াত নাট্যজন মুক্তাদির চৌধুরী (সঙ্গীত প্রযোজক ফুয়াদের বাবা), সউদ চৌধুরী, কবি মামুনুর রশীদসহ অন্যরা (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না) ছিলেন। কমিটির সংগৃহীত অর্থ ২০০১ সালে বাংলাদেশ সফরকালে আমি কবির হাতে হস্তান্তর করি। এ খবর সে সময় প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়।
নিউইয়র্কে বসবাস করেন কবি দিলওয়ারের বড় ছেলে মিলু (শাহীন ইবনে দিলওয়ার) ও কন্যা সুমনা। কবির ছেলে রানা (কিশওয়ার) শক্তিমান কবি, তরুণ বয়সেই পরলোকগমন করেন। রানার কাব্য প্রতিভা দিলু ভাইকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, একদিন একান্তে আমাকে বললেন, সে তো (কিশওয়ার) আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। মিলু নিউইয়র্কের পরিচিত প্রিয় মুখ। লেখালেখি, রাজনীতি, সংগীত চর্চা, সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে। একটা ভালো চাকরিও আছে। কুইন্সের উডসাইডে নিজের বাড়ি। সুমনা তার স্বামী লুৎফুর রহমানসহ থাকেন ব্রঙ্কসে। নিজেদের বাড়ি আছে। শিক্ষকতা করেন।
দিলু ভাই নিউইয়র্ক আসছেন—খবরটি শোনার পর খুশিতে আত্মহারা। মনে হলো যেন আবার সিলেটে ফিরে গেলাম। যুগভেরীর টেবিলে আবার আড্ডা। এরই ফাঁকে দিলু ভাই লিখে ফেললেন, ছড়ার সিরিজ ‘সেই দেশ কোনো দেশ’।
দিলু ভাই আসার খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলো। বিভিন্ন পত্রিকায় বের হলো একান্ত সাক্ষাৎকার। প্রবাস জীবনের ব্যস্ততার মধ্যেও দিলু ভাইয়ের সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটানোর জন্য ছুটে যেতাম। মিলু ও সুমনা বাবার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যা যা দরকার, সবই করতে থাকলেন।
এর মধ্যে সিলেট পৌরসভার সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম খান কবি দিলওয়ারের সম্মানে জ্যামাইকার তাজমহল পার্টি হলে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এ এম এ মুহিত। তিনি কবির সঙ্গে তাঁর ইন্টারনেট যোগাযোগের বিষয় প্রকাশ করেন। আমিও সংবর্ধনায় অংশ নিয়ে স্মৃতিচারণ করি। কবি তাঁর প্রতি সবার ভালোবাসায় গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে। এদিকে বাড়ির প্রতি দিলু ভাইয়ের টান যে বাড়ছে তা আমরা ভুলেই গেলাম। আমরা ভুলে গেলে কী হবে, কবি ভোলেননি। মনে মনে হয়তো ছটফট করছিলেন, মুখে বলতে পারছিলেন না। ছেলেমেয়ের সেবা শুশ্রূষা, সুচিকিৎসা, আমেরিকার বর্ণাঢ্য জীবন—সবকিছু ছাপিয়ে তখন একটাই ঠিকানা, ভার্থখলা। আপন বাড়ি। অবশ্য ওখানে তাঁর অন্য সন্তানরা হয়তো বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
একদিন আমাকে ফোন দিলেন। কণ্ঠে সব আবেগ ঝরে পড়ল।...মাহবুব, আমি জানি তুমিই পারবে, মিলু-সুমনা তো কখনো চাইবে না আমি ফিরে যাই, কিন্তু আমি আর পারছি না। মিলুর সঙ্গে আলাপ করে কালই আমাকে দেশে পাঠাও। কণ্ঠে তাঁর আকুতি। আমি অনুভব করলাম, তাঁর মনের অবস্থা। কোনো অবস্থাতেই তাঁকে আর এখানে রাখা যাবে না। আমি ফোন দিলাম মিলুকে। মিলু আগেই টের পেয়েছিলেন, তার বাবা দেশে ফেরার জন্য অস্থির অপেক্ষায় আছেন। বললেন, ...চাচা, আমি আব্বার ফেরার টিকিট করে ফেলেছি।
দিলু ভাই দেশে ফিরে গেলেন। যাওয়ার এক সপ্তাহ পর ঘোষণা হলো, দিলু ভাই একুশে পদক পাবেন। এর আগে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
ষাটের দশকে তাঁর লেখা ও আরতি ধরের গাওয়া গান ‘তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হজরত শাহজালাল আউলিয়া’—গেয়ে সিলেট বেতার কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই আউলিয়ার মাটির প্রতি দিলু ভাইয়ের টান ছিল প্রাণের।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।