ভাঙা পরিবারের শিশুসন্তানের জন্য করণীয়

আমার এক কলিগ (সংগত কারণেই নাম উল্লেখ করা হলো না) তালাকপ্রাপ্ত। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তাঁর। তাদের বয়স ৮ ও ৫ বছর। কর্মক্ষেত্রে তার সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব। রোজ আমাদের দেখা হয়, কথা হয়। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাঁকে প্রায়ই খুব হতাশ মনে হয়।
একদিন জানতে চাইলাম কী সমস্যা তার! উত্তরে জানাল, তাঁর বাচ্চারা একেবারেই কথা শোনে না। মুখে মুখে বেয়াদবি করে। পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। স্কুল থেকেও অভিযোগ আসে প্রায়ই।
তাঁর কথা শুনে আমার মনে হলো বাচ্চারা যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছে না। তাঁকে পরামর্শ দিলাম বাচ্চাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটাতে। কিন্তু সে বলল, বাচ্চাদের সঙ্গে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ সে যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য সে জোরালোভাবে তাদের ছেড়ে যাওয়া বাবাকে দায়ী করল।
আমাদের সমাজে, বিশেষ করে আমেরিকাতে ডিভোর্স কোনো নতুন বিষয় নয়। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় নাক ডাকার কারণেও মার্কিনিদের মধ্যে ডিভোর্স হয়। বর্তমানে শুধু মার্কিনিরা নয়, বাংলাদেশি-মার্কিনরা এই দৌড়ে ভালোই এগিয়ে আছেন। ডিভোর্স অবশ্যই বড় একটা সমস্যা। তবে তার থেকেও বড় সমস্যা দেখা দেয় ডিভোর্সের বাস্তবতাকে আমরা ঠিক কতটা সংগতভাবে বিবেচনা করি তার ওপর।
আমার কলিগ বন্ধুটি যে সমস্যার মোকাবিলা করছে, তা খুবই স্বাভাবিক। এক সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে যত দূর জানি, সে পেশাদার ও খুবই সামাজিক একজন মানুষ। নিজের ব্যক্তিজীবন, আনন্দ, অর্জন নিয়ে সে বেশ সময় ব্যয় করে। সন্তানদের আচরণে শিকল টানার মতো সময় বা ধৈর্য কোনোটাই তার নেই। বরং হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করেন।
বাবা-মায়ের হাত ধরে বেড়ে ওঠা প্রতিটা শিশু বা সন্তানের জন্মগত অধিকার। এটাই প্রকৃতিগত নিয়ম। কিন্তু যখন বাবা-মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়, যখন ঘুম থেকে চোখ মেলে কোনো শিশু বা সন্তান তার পাশে বাবাকে দেখে না বা মাকে দেখে না, তখন তারা স্বভাবতই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়। বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব তাদের মনে আলোড়ন তোলে না। তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয় প্রকৃতিগত নিয়ম ভাঙার কারণে, কোনো একজনকে হারিয়ে ফেলার শোকে। আর এই অবস্থায় দুঃখশ্লোক না গেয়ে, সন্তানের কাছে অপরপক্ষের সমালোচনা না করে, তাকে ভঙ্গুর মানসিক অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়াতে সহায়তা ও সহযোগিতা করা প্রত্যেক বাবা-মায়ের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে আমরা যদি নিজের হতাশা ও ক্ষোভ মেটাতে গিয়ে সন্তানের কাছে অপরপক্ষের সমালোচনা করি, হতাশায় ডুবে থাকি এবং সন্তানের দিকে মনোযোগ না দিই তাহলে সেই সন্তানের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তখনই তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
পিতা-মাতার বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে কঠিনতম বিষয়টি হলো সন্তানের ওপর এর উদ্বেগজনক প্রভাব। বিচ্ছেদের স্বল্পমেয়াদি প্রভাবে সন্তানেরা মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবেগের সঙ্গে লড়া‌ই করে। সন্তান যে বয়সেরই হোক, রাগ ও বিষণ্নতা স্বাভাবিক। আর এই রাগ ও বিষণ্নতা থেকে একাকিত্ববোধ এবং অসামাজিক হয়ে ওঠা, পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে ওঠাও স্বাভাবিক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বল্পমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হলো এই যে, পিতা-মাতার বিচ্ছেদে সন্তানেরা প্রায়ই বিশ্বাস করে যে তারা তাদের পিতামাতার বিচ্ছেদের জন্য দায়ী। বিশেষ করে তিন থেকে আট বছরের মধ্যে এই ধরনের চিন্তাভাবনা তাদের বিশেষভাবে দুর্বল করে দেয়। এটা পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানকে বিশ্বাস করানো যে তাদের বিচ্ছেদের জন্য সন্তানেরা কোনোভাবেই দায়ী নয়।
সন্তানের ওপর পিতা-মাতার বিচ্ছেদের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়াবহ। ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানেরা এ অবস্থায় বিষণ্নতা থেকে মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। গবেষকেরা মনে করেন, সুস্থ ও সম্পূর্ণ পরিবারের সন্তানদের থেকে অসুস্থ ও ভাঙা পরিবারের সন্তানেরা সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকে। এটা শুধু বিবাহ বিচ্ছেদের কারণেই হচ্ছে, এমনটা নয়। পিতামাতার মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্ব সন্তানদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। যাই হোক না কেন, বিবাহ বিচ্ছেদ অবশ্যই সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পিতা-মাতার মাঝে দ্বন্দ্ব যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, সন্তানের ওপর তত বেশি প্রভাব পড়বে। তাই বিবাহ বিচ্ছেদকে একপাশে রেখে প্রতিটি পিতা-মাতার উচিত নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়ানো বা সন্তানকে এর বাইরে রাখা।
কারণ যাই হোক, বিবাহবিচ্ছেদ আমাদের সন্তানদের জীবনের কুৎসিত ও অবাঞ্ছিত দাগ ফেলে। প্রতিটা শিশুর জন্য তাদের জীবনে বাবা-মায়ের উপস্থিত থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর ও সম্মিলিত পরিবারে শিশুসন্তান ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আবেগী বিকাশ, সামাজিক মিলন, মানসিক বিকাশ, শারীরিক বৃদ্ধি ও শিক্ষাগত বিকাশ সাবলীল ও স্বাভাবিক হয়। বিচ্ছিন্ন পরিবারে যখন শিশুরা সুরক্ষিত থাকে তখন তারা উন্নতি করে কারণ তারা অনুসন্ধানে, বিকাশে, এবং শিখতে ও বেড়ে উঠতে যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করে। বিচ্ছিন্নতা অনিরাপত্তার সৃষ্টি করে যা তাদের বিকাশ ও অনুসন্ধানে হুমকি স্বরূপ। তাই প্রতিটি বিচ্ছিন্ন পরিবারের পিতা-মাতাকে অবশ্যই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং পাশাপাশি সন্তানকে নিজেদের বিচ্ছেদ মানিয়ে নিতে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যেমন, সন্তানকে সরলভাবে নতুন জীবন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করুন। সন্তানকে বলতে পারেন, ‘আমি এই বাড়িতে বাস করতে যাচ্ছি এবং বাবা তার নিজস্ব বাড়িতে থাকবে। তুমি উভয় স্থানে বাস করবে। এই বাড়িতে তোমার কাপড় থাকবে। বাবার বাড়িতে তোমার খেলনা থাকবে।’ আপনি যত বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবেন, আপনার সন্তান তত বেশি তৈরি হবে। মনে করে স্থায়ী অবস্থানটি উল্লেখ করতে ভুলবেন না। সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় স্পষ্ট বার্তা দিয়ে সরল ভাষা ব্যবহার করুন। অনেক সময় দুঃখবোধ থেকে আপনার কণ্ঠ ও ভাষা অতি মোলায়েম ও বিভ্রান্তিকর শোনাতে পারে যা আপনার সন্তানের জন্যও বিভ্রান্তিকর হতে পারে। আপনি স্পষ্ট করে কথা বলুন, তবে তা যেন হয় সহনশীল। ‘আমরা এখনো একটি পরিবার’ কিংবা ‘আমরা এখনো একে অপরকে ভালোবাসি’ এই জাতীয় বাক্য পরিহার করুন। কারণ আপনার এমন আশ্বাসে শিশু সন্তানটির মনে মিথ্যে আশ্বাস ও বিভ্রান্তি জন্ম নিতে পারে যে তার পিতা-মাতা আবারও এক সঙ্গে বাস করবে। আপনার সন্তানকে বিশ্বাস করান যে আপনি কখনো তাদের ছেড়ে যাবেন না। অল্পবয়সী শিশুদের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে কোনো ধারণা থাকে না। পরিবারের কেউ বেরিয়ে যাওয়ার ধারণা তাদের কাছে অকল্পনীয়। সন্তানকে জানান যে কখনো কখনো মা-বাবা সম্পর্ক ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক যেমন কিছু বাচ্চারা ভালো বন্ধু না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের বলুন যে বাবা-মা বিবাহবিচ্ছেদ করলেও কখনো সন্তানকে ছেড়ে যায় না এবং আপনি কখনো তাকে ছেড়ে যাবেন না। সন্তানের আরাম-আয়েশের বিষয়ে লক্ষ রাখুন। তাদের আশ্বস্ত করুন। পরিবর্তন স্বভাবতই অনেক শিশুর জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আপনি বিচ্ছেদের কারণে উদ্বেগে আছেন। কিন্তু সেটা আপনার সন্তানকে বোঝাবেন না। তাকে নিয়মের মধ্যে রাখুন ও আশ্বস্ত করুন। তার জামা-কাপড়, খেলনা, বই-খাতা বা ড্রয়িং দুই পক্ষের বাড়িতেই রাখুন। যদি আপনার সন্তান কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে তার বাবা বা মাকে ভিজিট করার কথা থাকে, তবে তাকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেটা বলুন। সকালে বলুন। সে যেন প্রস্তুত থাকে। একে অপরের প্রতি সম্মান রাখুন। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে স্বভাবতই একে অন্যের প্রতি মন বিষাক্ত হয়। এবং প্রায়শই আমরা যে ভুলটা করি তা হলো নিজেকে সঠিক রাখতে সন্তানের কাছে অপরপক্ষ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করি। আর এটাই সন্তানকে মানসিকভাবে আঘাত করে এবং বিষাদে ফেলে সব থেকে বেশি। তাই আপনার সন্তানের সুস্থ বিকাশে তাকে অপরপক্ষ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
সর্বোপরি, নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে সন্তানকে যতটা সম্ভব দূরে রাখুন। আপনি নিজে সঠিক কাজটি করুন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানেরা অবশ্যই বুদ্ধিসম্পন্ন হবে এবং আপনার ত্যাগ ও সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করবে।