ভিন্ন হোন এবং ভিন্নতা ধরে রাখুন

চোখ বুঝে আপনার জানামতো কিছু বড় মানুষের কথা ভেবে দেখুন তাঁরা সবাই কোনো না কোনো ভাবে ভিন্ন। কেউ চিন্তা-চেতনায়, কেউ ধ্যানধারণায়, কেউ কাজে-কর্মে, কেউ শিল্প-কলায়, কেউ আবার মেধা ও জ্ঞানের পারদর্শিতায়। স্টিভ জবস, মার্ক জাকারবার্গ, বিল গেটস আর নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন ভিন্ন; এপিজে আবদুল কালাম, মহাত্মা গান্ধী বা পদ্মশ্রী পদক প্রাপ্ত হালদার নাগও তেমনি ভিন্ন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমনি ভিন্ন, আমাদের সবার প্রিয় ইত্যাদি অনুষ্ঠানের লেখক, পরিচালক, প্রযোজক, উপস্থাপক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত হানিফ সংকেত স্যার এবং প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক স্যারও তেমনি ভিন্ন। আর মানুষের ভালোর জন্য তাঁদের এই ভিন্নতায়ই তাঁরা অনেক বড়। এই ভিন্নতার কথা আসলেই অনেকেই মনে করেন তাঁরা জন্মগতভাবেই ভিন্ন। হতে পারে; তবে অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণার ফল অনুযায়ী, মানুষ জন্মগতভাবে সবাই সমান হয়। শুধু চিন্তাধারা, পরিবেশ, শিক্ষা, কাজ-কর্ম ও নিজ নিজ চেষ্টাতেই মানুষ ভিন্ন হয়।
আপনি কী কখনো ভেবে দেখেছেন আপনি অন্যদের থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন? যদি তাই মনে করেন, তবে বড় হওয়ার জন্য আপনার ভিন্নতা তুলে ধরার এবং সেই ভিন্নতা ধরে রাখার সময় এখনই। আর, যদি আপনাকে অন্য সবার মতো সমান মনে করেন, তবে বলছি আপনার মধ্যে অন্তত একটা জিনিস খুঁজে বের করুন যা অন্য সবার থেকে ভিন্ন। সেটা হতে পারে আপনার চিন্তা-ধারণা, পছন্দ, খাবার রুচি, পোশাক-আশাক বা আপনার স্টাইলের ভিন্নতা। খুঁজে পেয়েছেন আপনার ভিন্নতা? যদি না পান, তবে বলছি, আপনার চেহারা অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন, আপনার আঙুলের ছাপ অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন, আপনার চোখের রেটিনা অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন এবং আপনার ডিএনএ সবার চেয়ে ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, আপনি নিজেই অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। তাই, অন্যদের অনুসরণ করে আপনি বড় হবেন কীভাবে? কারণ সব তালা একই চাবি দিয়ে খোলা যায় না। সে জন্য আপনার ভিন্নতা ভাবতে থাকুন এবং চলুন দেখি কীভাবে সেই ভিন্নতা ধরে রেখে বড় হওয়া যায় খুবই সহজে।
প্রথমেই বলতে হয় ভিন্নতা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় খুবই সহজে। বাজারে একটা শার্ট অন্য শার্টের চেয়ে ভিন্ন হলে যেভাবে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঠিক সেভাবে। তবে, সে ভিন্নতা দিয়ে বড় হওয়া যায় তখনই যখন এই ভিন্নতা অন্যের উপকারে আসে। শুধু পড়াশোনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেই বড় হওয়া যায় না। যদি এভাবে বড় হওয়া যেত, তাহলে সব পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাই আজ বড় থাকতেন। ভারতে এত পিএইচডি ডিগ্রিধারী থাকতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে হালদার নাগ পদ্মশ্রী পদক পেতেন না। তাঁর মুখনিঃসৃত কথা বা লেখা নিয়ে অন্যরা পিএইচডি করতেন না। কীভাবে সেই ভিন্ন হতে হয় তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে আপনার শপথ যদি হয় বিভিন্ন সমস্যা বা প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে প্রতিদিন আমাদের দেশে রাস্তার দুপাশে দুটা করে গাছ লাগাবেন, মাত্র এক বছরে আপনি ৭৩০টা গাছ লাগাতে পারবেন। এতে আমাদের দেশের সবার উপকার হবে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই হোক না কেন, পাঁচ বছরের মধ্যে এ দেশের মানুষের কাছে আপনি অনেক বড় হয়ে যাবেন। তবে, আপনার এ ভিন্নতা ধরে রাখতে হবে। নিজে গাছ লাগাতে হবে, অন্যকেও গাছ লাগাতে উৎসাহী করতে হবে। এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন মানুষ কী শুধু জন্মগতভাবেই ভিন্ন হয় না তাঁর ইচ্ছা, চেষ্টা ও কাজ তাঁকে ভিন্ন করতে পারে, বড় করতে পারে?
ময়মনসিংহের রিকশা চালক জয়নাল আবেদিন ৬১বছর বয়সে তাঁর এলাকায় ৩০০শয্যা বিশিষ্ট একটা হাসপাতাল নির্মাণ করে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন ৩২বছর রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন সামান্য কিছু টাকা জমা করে! ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল জয়নাল আবেদিনকে চাঁদ সুলতানা পুরস্কার দেয় ঢাকা আহছানিয়া মিশন। ২০০৫ সালে আমেরিকা প্রবাসী শাহনাজ পারভীন নামে এক নারী এক হাজার ডলার হাসপাতালের উন্নয়নে তাঁকে সহযোগিতা দেন। ২০১১ সালে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংগঠন তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সহযোগিতায় তাঁর হাসপাতালের নামে প্রায় চার একর ফসলি জমি কেনা হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২২ হাজার ৩১৫জন রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এটাই হলো তাঁর ইচ্ছা ও স্বপ্নের পূরণের জন্য চেষ্টার ফসল। আপনার দৃষ্টিতে জয়নাল আবেদিন কী ভিন্ন এবং অনেক বড় লোক নন?
বড় হওয়ার প্রত্যাশায় ‘ভিন্ন হোন এবং আপনার ভিন্নতা ধরে রাখুন’ সূত্রটি কাজ করবে তখনই যখন মানুষের সেবা করাই হবে আপনার ভালোবাসা ও বড় হওয়াই হবে আপনার স্বপ্ন। আর এটার জন্য প্রয়োজন আপনার ঐকান্তিক ইচ্ছা, অভ্যাস ও চেষ্টা। তাই, বড় হওয়ার প্রত্যাশায় আজই আপনার ভিন্নতা খোঁজে বের করুন। সেই ভিন্নতা দিয়ে কীভাবে অন্যের উপকার করে নিজে বড় হওয়া যায় ভাবতে থাকুন। ভাবনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিন। এটা আপনার অভ্যাসে পরিণত করুন। আপনি বড় হবেনই।