কুড়ি বছর পূর্তিতে শ্রদ্ধা

প্রত্যেক সমাজের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব আইডেনটিটি বা পরিচয় নির্ধারিত হয় কতগুলো নির্দিষ্ট উপাদানের ওপর ভিত্তি করে। আর সেই উপাদানগুলো গড়ে ওঠে সেই সমাজের বিভিন্ন ‘শক্তির’ সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের ফসল হিসেবে। তবে সামাজিক পরিচয় প্রলম্বিত সময় ধরে সামাজিক ‘আন্দোলনের’ সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগোতে থাকে। তাই তার আইডেনটিটি নিয়মিত প্রতি-শক্তির আঘাতের শিকার। তাই রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর নেগোসিয়েশনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রিক পরিচয় বদলাতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু উপাদান একই থাকে, যেমন ভাষা বা পঞ্জিকা ও অন্যান্য কিছু। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন শক্তির সংঘর্ষ কেন ঘটে এবং কীভাবে ঘটে তা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর।
আমার প্রিয় সংস্কৃতির তাত্ত্বিকদের মধ্যে রেমন্ড উইলিয়াম ও স্টুয়ার্ট হল। হল জ্যামাইকার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসার কারণে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের বিলেতে রেমনড উইলিয়াম এবং রিচার্ড হগারটের নেতৃত্বে এক ঝাঁক মেধাবী কিন্তু দরিদ্র পরিবার থেকে আসা সমাজবিজ্ঞানী সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, প্রচলিত সংস্কৃতির সংজ্ঞার মধ্যে ভুল রয়েছে, কারণ ‘শক্তির’ সঙ্গে এর নিয়মিত নেগোসিয়েশনে এমন একটি দেওয়া-নেওয়ার স্পেস সৃষ্টি করে যেখানে সংস্কৃতির ‘অর্থ’, মানে যে-অর্থ শক্তি চাপিয়ে দেয় তা এক ধরনের রেজিসট্যান্স সৃষ্টি করে। তার ফলে সংস্কৃতির ‘অর্থ’ বদলে যেতে বাধ্য হয়। রেমন্ড উইলিয়াম বুঝতে পারেন সংস্কৃতি, মানে যা ‘শক্তি’ চাপিয়ে দেয় তা সাধারণত সেই সংস্কৃতি যা ‘শক্তির’ শ্রেণির সংস্কৃতি। কিন্তু জনচিত্তের সংস্কৃতি সেটা থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। তাই অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বা Actors সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। অধিকাংশ সময়েই সেই সংগ্রাম প্রলম্বিত হয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা হেরে গেলে চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয় কখনো কখনো। বাংলাদেশের ইতিহাস তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
২০১৪ সালে মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক হল শিকাগোতে এক আন্তর্জাতিক সন্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন, সংস্কৃতি হলো এক ধরনের ‘পদ্ধতি’ যার মাধ্যমে আমরা সমাজ জীবনের ‘অর্থ’ অন্বেষণ করি, এবং খুঁজে পাই। এটা নিয়মিত Consent এবং Resistance-এর সংগ্রাম।
সংস্কৃতি, জনমানুষের সংস্কৃতি ‘শক্তির’ নির্দেশ উপেক্ষা করে, নিজেকে অবচেতন এবং চেতনভাবে অধিকাংশ মানুষের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করতে লড়ে যায় অবিরাম। তবে সেই সংগ্রামের মধ্যেও ‘শক্তির’ বিভিন্ন স্তর থাকে, এদের সবার সংগ্রাম থেকে বেরিয়ে আসে ‘আত্মপরিচয়ের’ ধরনটি কী হবে। কিন্তু যে সামাজিক এজেন্ট বা Actor এই লড়াইয়ের দিক ও পদ্ধতি সৃজন করে, তারা অবিরাম একটি ‘পরিচয়’ অন্বেষণ করে যা কিনা তাদের আত্মপরিচয়ের নকশাটাও তৈরি করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম শুরু হয়েছে পাকিস্তানের গোড়া থেকেই। বাঙালিদের আত্মপরিচয়ের প্রধান উপাদান ভাষার ওপর আঘাত আসে ‘৪৮ সালে। মূলত সেটা শুধু ছিল জনমানুষের যুদ্ধের উপরি কাঠামো। এর অন্তরালে ছিল অর্থনৈতিক ও অন্য হেজিমনির যুদ্ধ। ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির জনযুদ্ধ শুরু হয়, যার দীর্ঘ পথের শেষ প্রান্ত ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আত্মপরিচয়ের এই দীর্ঘ সংগ্রামে যে সব সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা (Agents/Actors) প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভূমিকা ছিল মূল চালিকাশক্তি। একদিকে পাকিস্তানি রাষ্ট্র-শক্তি বাঙালিদের সংস্কৃতি বা আত্মপরিচয়কে ধ্বংসই করতে চায়নি, বরং সেই ধ্বংস স্তূপের ওপর ভিন্ন এক সংস্কৃতি প্রোথিত করতে চেয়েছিল, যেটা ফ্রাঞ্জ ফানোর তত্ত্ব অনুযায়ী, বাঙালি জনমানুষের মস্তিষ্ককে সম্পূর্ণ কলোনাইজ করে সেখানে যাতে এক বিজাতীয় সংস্কৃতি পুতে দেওয়া সম্ভব হয়। সেটা রুখে দিয়েছিল বাঙালি জনগোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের একটি বড় ভূমিকা।
‘৭১ বাঙালিরা যে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিল, অচিরেই বিরুদ্ধবাদী সামাজিক শক্তিসমূহ বাঙালিদের আত্ম পরিচয়ের সেই উপাদানগুলোকে গলা টিপে ধরে। তার ফলেই এই শিশু রাষ্ট্রের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীরা নতুন করে ৭১ এ পরাজিত শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যেতে বাধ্য হয়। আশির শুরুতে দেশের সব লেখক শিল্পী ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এক মঞ্চে দাঁড়ায়, তৈরি করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। রাষ্ট্রকে দখল করে ৭১ বিরোধী, বাঙালি সত্তা-বিরোধী এক শক্তি। সমাজ, দেশ, দেশের অগণিত মানুষ তাদের ৭১ এর সব অর্জনকে হারাতে বসে। একদল মানুষ স্বাধীনতার মূল উপাদান ও আঁধারকে হত্যা করে ফিরিয়ে আনতে চায় পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছিল বাঙালিকে। নতুন করে আবার আত্মপরিচয় উদ্ধারের লড়াই শুরু করল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এটি হয়ে দাঁড়াল বাঙালি জাতি-সত্তার সংগ্রামের মঞ্চ, যা স্বাধীনতার সব স্তম্ভকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রথমে Resistance ও পরে দীর্ঘ সংগ্রামে রূপ নিল। প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার পক্ষের সব বিবেকী মানুষেরাই দেশের অবৈধ স্বৈর-সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হলো। মানুষের অধিকার, আত্ম-পরিচয় উদ্ধারের সংগ্রাম রূপ নিল তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রামে। প্রায় এক দশকের কাছাকাছি সময় স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো ও সাংস্কৃতিক জোট লড়াইটাকে রাজপথে নিয়ে এল এবং অগণিত মানুষ প্রাণ হারাল সেনা শাসকের বুলেটে। পরিশেষে এই স্বৈর-শাসক পরাস্ত হয়। একটা প্রতিশ্রুতিময় কাল আসে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আত্ম-পরিচয় প্রতিষ্ঠার। কিন্তু সেই পথ মোটেই সহজ হয় না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে দৃশ্য ও অদৃশ্য বিরুদ্ধ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে আবার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হলো, তবে এবার গণতন্ত্রের খোলসে মোড়া স্বৈর-শাসকের বিরুদ্ধে। তাই যুদ্ধটা কখনোই থামল না।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং সামাজিক-ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই চলমান রাখতে হলো তাদের। রাজনৈতিক পরিবর্তন, মানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে, যেমন ৯৬ বা ২০০৮ থেকে পরে আরও দুবার, সন্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কিছুটা অনুকূল বাতাস পায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সামাজিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর, জামায়াত- বিএনপি বা তাদের মিত্রদের মিথ্যাচার এবং রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে তাদের লড়তেই হয়। এর ফলে দেখা যায় সাংস্কৃতিক যুদ্ধটা কোনো দিন বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা এবং বাঙালি জাতি-সত্তা বিরোধী আদর্শের বিরুদ্ধে।
একটা সময় ছিল এই যুদ্ধ আমাদের দেশের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বাঙালি পেশা বা অন্য কারণে বিদেশ বিভুঁইয়ে মাইগ্রেট করে আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে। ইউরোপসহ উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা বিপুল হতে থাকে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের আত্ম-পরিচয়ের চেতনা বিদেশি সংস্কৃতিতে মোহ্যমান হয় না। এরা মূলত বাঙালি আত্ম-পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর থাকে, তাই দেশের রাজনীতির এবং সামাজিক শক্তিগুলোর অন্তর্গত এবং পারস্পরিক সংঘর্ষসমূহ এদের তাড়িত করে এবং তারা দেশের সীমান্তের বাইরে থেকেও মনোজাগতিকভাবে দেশের প্রগতিশীল মানুষদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এভাবেই আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কয়েকজন প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শাখা প্রতিষ্ঠা করেন নিউইয়র্কে, কেন্দ্রীয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সার্বিক অনুমোদন নিয়ে। নিউইয়র্কে যারা এই দুরূহ কাজটি অত্যন্ত মেধা ও শ্রমের সঙ্গে সফলভাবে করেন তাঁরা দেশের কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এঁরা হলেন নাট্যকর্মী ও টিভি শিল্পী ড. সালেক খান, আবৃত্তিকার নাট্যশিল্পী ও সামাজিক রাজনৈতিক কর্মী মিথুন আহমেদ, নাট্যশিল্পী মুজিব বিন হক, সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ, নৃত্যশিল্পী এ্যানি ফেরদৌস, সংস্কৃতিকর্মী ডা. নাজরা চৌধুরীসহ আরও অনেকে। এঁদের সবারই প্রাপ্য শ্রদ্ধা স্বাধীনতার চেতনা ও বাঙালির আত্ম-পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
সংস্কৃতি আপাতভাবে ‘নিরীহ’ বিষয় মনে হলেও তা রাজনীতি বিবর্জিত বিষয় নয় মোটেই। কারণ কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য “Culture and Politics together reinforce an idea of what is acceptable at any given time.”
গত কুড়ি বছর ধরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে উত্তর আমেরিকার মতো বিরূপ সমাজে, নিজেরা বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে আমাদের ইতিহাস ও আত্মপরিচয় অক্ষুণ্ন রাখার সংগ্রাম মোটেই সহজ বিষয় নয়, বিপুল শ্রম, আর্থিক ও মানসিক ক্রিয়াকাণ্ড এবং সবচেয়ে বড় এক বৌদ্ধিক সংগ্রাম চালাতে হয়েছে এই মানুষগুলোকে। যেকোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি একটি মাধ্যম বা ভাষাও বটে, যার মাধ্যমে সে তার আত্মপরিচয় তুলে ধরে, সেটা হারালে তার নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। তাই স্টুয়ার্ট হলের ভাষায় বলা যায়, “People have to have a language to speak about where they are and what are the possible futures are available to them. These futures may not be real; if you try to concretize, you may find that nothing is there. But what is there, what is real, is the possibility of being someone else, of being in some other social space from the one in which you have already been placed.” তাই আত্ম-পরিচয় কঙ্ক্রিটাইজ মূলত করেন সাংস্কৃতিক কর্মীরাই জাতির সম্ভাবনাগুলোকে (Futures) সত্য করে তোলার ক্ষেত্রে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উত্তর আমেরিকা গত দুই দশক ধরে সে কাজটিই করে যাচ্ছে। এই সংগঠন এবং এই প্রতিষ্ঠানের শিল্পীদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব বাঙালির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁদের এই বিংশতি বর্ষে গভীর শ্রদ্ধা জানাই!

লেখক: লেখক, প্রাবন্ধিক ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক