'সিলেট নিবাস বাংলাদেশ'

‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’ শামসাদ হুসাম রচিত গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে মরহুম জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী এবং ড. জি সি দেবকে।
শামসাদ হুসাম শুরুতেই বলে নিয়েছেন বইটি তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত না করার অভিপ্রায় নিয়ে তাঁর দীর্ঘ দিবস আর রজনী কেটেছে।
গ্রন্থ রচনার যে ঝক্কি, তা শুরুতেই স্মরণ করে দিয়ে লেখক শামসাদ হুসাম পাঠককে এক ধরনের প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। এ বইয়ের পাঠক শুরুতেই এ আপ্তবাক্যটি ধাতস্থ করতে পারলে লেখকের প্রতি সুবিচার করা হবে।
আমি কোনো বইয়ের প্রবুদ্ধ সমালোচক নই। যদিও এসবের সঙ্গেই জীবনের দীর্ঘ পথ চলেছি। সামসাদ হুসাম আমাদের অগ্রজা। বই নিয়ে কথা বলার আগে লেখক সম্পর্কে শুরুতেই কিছুটা বলে নেওয়া সমীচীন হবে।
শামসাদ হুসাম সাংবাদিকতা করেছেন। সিলেটের রক্ষণশীল বাস্তবতায় নারী-সাংবাদিকতায় শামসাদ হুসামকে আমরা এক অগ্রপথিক হিসেবেই দেখি। তাঁর সাহিত্যকর্মও সিলেট অঞ্চলের পাঠকদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা ‘যুগভেরী’তে সাংবাদিকতা করেছেন, সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেছেন সামসাদ হুসাম। সময়ের ফেরে এখন প্রবাসী। সাংবাদিকতায় জড়িয়ে যাওয়া এক নারী এখনো পরম মমতায় সংবাদপত্র আর লেখালেখিতে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন প্রশংসনীয় উদ্যমের সঙ্গে। তাঁর পরিশ্রমলব্ধ প্রয়াস ‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’।
বইটি আমার হাতে বেশ দেরিতেই আসে। সিলেট অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমাকে দ্রুত চোখ বুলাতে হয়। দ্বিতীয়বার দেখে নিতে হয় শামসাদ হুসাম লিখেছেন বলেই। বইটি নিয়ে লেখার জন্য পরখ করে নিতে হয় আবার!
এ ধরনের বইয়ের গুরুত্ব এখানেই। গল্প-উপন্যাস বা কবিতায় ডুব দেওয়ার জন্য পাঠকের এ বই হাতে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। ‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’ আগ্রহী পাঠকের কাছে তথ্যসূত্রেরই উপাদান। নিজের অঞ্চল নিয়ে আগ্রহী লোকজন এ বই হাতে নেবেন। পড়তে গিয়ে তথ্যের প্রত্যাশা করবেনই।
বাংলা সাহিত্যে বঙ্গীয় অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের শ্লাঘা করার কাজ যে খুব একটা আছে, তা দাবি করার তেমন সুযোগ নেই।
সিলেট অঞ্চলের নানা বিষয় নিয়ে ‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’লেখক শামসাদ হুসাম বইটি রচনা করতে চেয়েছেন। তাঁর প্রয়াসের প্রতি সুবিচার করেই যদি বলি, তাহলে বলতে চাই—বইয়ের বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি শামসাদ হুসামের ছিল না। সিলেট সম্পর্কে প্রচলিত কথাবার্তা নিয়ে বইটি শুরু হয়েছে। আজকের পাঠক এসব প্রচলিত কথাকে যাচাইয়ের কষ্টি পাথরে বিবেচনার মধ্য দিয়ে যেতে চায়। মিথ নির্ভর ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে অনেক কথাই বলার অবকাশ রয়েছে। লোকমুখে চালু থাকা মিথ আর নৃতাত্ত্বিক যোগসূত্রের সঙ্গে সমন্বিত মিথ একাকার করার সুযোগ নেই। লেখককে বেছে নেওয়ার অবকাশ আছে, তিনি কোন পথে যাবেন। শামসাদ হুসাম প্রথম পছন্দের অভিধায় রচনা করেছেন ‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’।
নানা বিষয় নিয়ে তাঁর উপস্থাপনাকে সাজাতে চেয়েছেন ‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। ভূ-প্রকৃতি, আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে নারী জাগরণ—সবই ছুঁয়ে যেতে চেয়েছেন। সিলেট অঞ্চলের লোকজনের প্রবাসযাত্রা, শিল্প-সংস্কৃতিসহ আলোকিতজনকে নিয়ে আসতে চেয়েছেন একই মলাটে। ব্যাপারটা মহা ঝক্কির। একটি অঞ্চলের নানা ঐতিহাসিক যোগসূত্রকে তুলে ধরা এক দুরূহ কাজ। এ বই নিয়ে আলোচনার সময়েই ভাবতে হচ্ছে, সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে অনেক বই রচিত হলেও ব্রিটিশ শাসক রবার্ট লিন্ডস এখনো আমাদের ভরসা। ইতিহাস, ঐতিহ্য বা চলমান সময়ের ভিন্নমাত্রিক সর্বজনীন উপস্থাপনা কঠিন কাজ। এ কাজের একটা প্রয়াস ‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লক্ষ করা যাবে।
সিলেট অঞ্চলের লোকজনের প্রবাস যাত্রা নিয়ে নুরুল ইসলামের ‘প্রবাসীর কথা’ রচনা করতে গিয়ে লেখককে এক দশক গবেষণা করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রবাস যাত্রার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হয়ে আছে।
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু লোকজনের নাম আর তাদের কর্মের খ্যাতি এসব লোকজনকে খুশি করবে। সময়ের ব্যবধানে এসব উপাখ্যান এ ধরনের বইয়ের জন্য জরুরি, তা আলোচনার দাবি রাখে।
‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ রচনা করে এক শ বছর আগে অচ্যুতচরণ চৌধুরী যে প্রামাণ্য গ্রন্থ রেখে গেছেন, আমাদের আশ্রয় এখনো সেখানেই। ধারাবাহিক কর্মের পিপাসা দৃশ্যমান হয়েছে, উসকে উঠেছে। দায় নেওয়ার কঠিন পথে কেউ যাননি, যাওয়ার সামর্থ্যও অনেকের নেই বা ছিল না। শামসাদ হুসামের মতো এক অগ্রসর নারী সাংবাদিক কিছুটা হলেও দায় নিয়ে তাঁর প্রয়াস চালিয়েছেন। এ কারণেই তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।
‘সিলেট নিবাস বাংলাদেশ’ সিলেট অঞ্চলের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে, এমন প্রত্যাশা লেখককে অনুপ্রাণিত করার জন্যই করতে চাই।