কুহেলি

“তুমি যদি শুদ্ধ ইংরেজিতে স্বাভাবিক মানুষের মতো communicate করতে সক্ষম বলে নিজেকে মনে কর, তাহলে আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করব। তবে তার আগে অনূর্ধ্ব ৩০০ শব্দে তিনটি প্যারাগ্রাফ লিখে পাঠাও। যদি ভালো লাগে আমি রেসপন্স করব। ও হ্যাঁ, আমার নাম জেনিফার, বয়স ১৯, কলেজে পড়ি, টেক্সাসের অস্টিনে থাকি।”
জেনিফারের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ ঘটেছিল ইমেইলে, একটা বন্ধু বানানোর ওয়েবসাইটের সূত্রে। আমেরিকায় মানুষ নগদ টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি, সোনা-দানার চেয়েও যে বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক থাকে তা হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা! আর এসব তথাকথিত ‘ডেটিং ওয়েবসাইটে’ কেউ সাধারণত ফোন নম্বর, ফেসবুক প্রোফাইল লিংক, বা ছবি ইত্যাদি দেয় না। জেনিফারও দিয়েছিল শুধু একটা ইমেইল অ্যাড্রেস। সেই ইমেইল অ্যাড্রেসটাও তার ব্যক্তিগত নয়, ওয়েবসাইট থেকে দেওয়া অস্থায়ী ইমেইল অ্যাড্রেস। কিন্তু প্রোফাইলে তার ওপরের ওই পরিচ্ছদটা ছিল আমার কাছে খুব মজার ও আগ্রহ-উদ্দীপক। আগে কখনো ওর মতো এত সিরিয়াস কাটা-কাটা কথা বলা পোস্ট দেখিনি। বন্ধুত্বের আহ্বান তো নয়, যেন চাকরির আবেদন বা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। তবু ইমেইল করলাম।
এই ওয়েবসাইটে নানা বয়সের সুন্দরী মেয়েরা তাদের আকর্ষণীয় ছবি আর নিজেদের মনোগ্রাহী সব বর্ণনা দেয়। ছেলেরা দেয় ম্যাচো সব সিক্স প্যাক, এইট প্যাক পেশিবহুল ব্যায়াম করা পেটানো শরীরের ছবি। আমার তো ওসব প্যাক-ট্যাক এর বালাই নাই, আর প্রোফাইলও খুব সাদামাটা। নিজস্ব পরিচয় যথারীতি গোপন রেখে যতটুকু পারা যায় ততটুকুই লিখলাম তাকে।
তাকে লিখেছিলাম, ‘‘আমি নিউইয়র্কে থাকি। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আমেরিকায় এসেছি। কিন্তু দেশ-পরিবার-বন্ধু সবাইকে মিস করি। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি বলে বেশি সময় পাই না। তাই ফোন বা ডেটিং ইত্যাদি আমার পক্ষে হয়ে ওঠে না। ইমেইলই শ্রেয়। তাই তোমাকে লিখছি। আমার ইন্টারেস্ট হলো মিউজিক, বই, সিনেমা, স্পোর্টস ও জীবনঘনিষ্ঠ সবকিছু। তোমার আগ্রহের বিষয় লিখে পাঠিও। এ ছাড়া আমার ব্যক্তিগত পরিচয়, স্বপ্ন ইত্যাদি ...ইত্যাদি...।’’
রেসপন্স পাব খুব একটা আশা করিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন ইনবক্সে দেখি তার ইমেইল। তবে শত-শত অপঠিত ইমেইলের ভিড়ে তার ওই ইমেইল আলাদা কোনো গুরুত্ব পেল না। একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম। হুঁশ হলো যখন সাত দিন পর আবারও একটা ইমেইল পেলাম, এবার একটা পার্সোনাল ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে। সে লিখেছে, ‘‘তুমি সম্ভবত আমার আগের ইমেইলটি পাওনি তাই আমার ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে আবার লিখছি। আমি জেনিফার। তোমার লেখা আমার খুব ভালো লেগেছে, তাই আবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। আমি তোমার সঙ্গেই নেট-ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই। শর্ত হলো, দু’দিন পরপর আমার কাছে কমপক্ষে দুই প্যারাগ্রাফের ইমেইল লিখতে হবে। তুমি তোমার কাজের ফাঁকে লিখবে তাহলে বুঝব তুমি আসলেই সিরিয়াস। আমি তোমাকে লিখব আমার ক্লাসের ফাঁকে, তাতে তুমি বুঝবে আমি কত সিরিয়াস। তবে, বন্ধুত্ব হলেও আপাতত তা কেবল কলম-বন্ধুত্বেই সীমাবদ্ধ থাকবে।’’
এসব পাগলামির বয়স আমি বেশ ক’বছর আগেই পেরিয়ে এসেছিলাম। তবু কেমন এক ধরনের ছেলেমানুষী রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। ওকে লিখলাম, ‘তা-তো বুঝেছি, কিন্তু লেখার প্রসঙ্গ কে ঠিক করবে? কী নিয়ে লিখব এত কিছু? আর তোমার-আমার বয়সের যে ব্যবধান সেটাও একটা ফ্যাক্টর। আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা ভিনদেশে, ভিন্ন পরিবেশে সম্পূর্ণ বিপরীত আমার সবকিছু। আর তুমি আমেরিকান। আমি তোমাদের এই জীবনটা খুব কাছ থেকে জানি না, তোমার প্রজন্মকেও জানি না- যেমন তুমিও আমারটা জানো না। সেখানে আমাদের common interest ও প্রসঙ্গ পাওয়াই দুষ্কর।”
সে উত্তর দিল, ‘তুমি তো এতক্ষণ সমস্যা না বরং অনেকগুলো সম্ভাবনার কথাই বললে। আমরা এত আলাদা বলেই আমাদের মধ্যে কথা বলার সুযোগ বেশি, যোগাযোগের সুযোগ বেশি। তুমি লিখবে তোমার কথা, আমি আমার।’
আমি লিখলাম, ‘আচ্ছা, তুমি সেদিন নিশ্চয়ই অনেক ইমেইল পেয়েছিলে। তার ভেতর থেকে রেসপন্স দিতে আমার ইমেইলকেই বেছে নিলে কেন?’
ও জানাল, ‘‘খুব সহজ। আমার কাছে বাকি যেসব ইমেইল এসেছিল তার বেশির ভাগই ছিল বিছানায় যাওয়ার অফার, গালিগালাজ, পুরুষের বিশেষ অঙ্গের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি। তোমার ইমেইল পড়ে মনে হয়েছে তুমি একজন রিয়েল হিউম্যান বিয়িং। তা ছাড়া তুমি নিউইয়র্কে থাকো, আমি টেক্সাসে। আমার খুব শখ নিউইয়র্কে যাব। তবে এখন না, এখন আমার হাত খালি।’’
এভাবেই শুরু। দেখলাম ওর কথাই সত্যি হলো। এক-দুই-তিন দিন করে কেমন করে যেন দু’জন অচেনা মানুষ খুব কাছে চলে এলাম। এমন না যে খুব বিশেষ বিষয়ে দু’জন লিখেছি। বরং আমাদের লেখা ও রিপ্লাইয়ের বিষয়বস্তুতে কোনো সামঞ্জস্যই থাকত না। যেমন ধরা যাক আমি হয়তো বলেছি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে, সে হয়তো বলছে কোনো দিন কোথায় পিৎজা খেতে তার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। আমি হয়তো তার উত্তরে লিখলাম ঠিক বলেছ, নিউইয়র্কে এবার বেশ ঠান্ডা পড়েছে, আগামী সপ্তাহে দু’দিন তুষার পড়বে দেখাচ্ছে। সে লিখল, ‘তুমি ঠিক বলেছ, আমার এই সাদা ড্রেসটার স্লিভ ফেলে দেওয়াই ভালো।’ এভাবেই, আগা-নাই মাথা-নাই, কিন্তু যোগাযোগও থেমে নাই। কোত্থেকে কেমন করে যেন দু’জনের মধ্যে এত কথা বিনিময় চলল কিছুদিন।
তবে আমাদের কথায় যে একেবারেই সামঞ্জস্য ছিল না তা না। যদি একে অপরকে কেউ কোনো প্রশ্ন করি, আমাদের আবোল-তাবোল কথার ফাঁকেও তার ঠিকঠাক উত্তর দিই। এভাবেই একে অপরকে যতটুকু জেনে নেওয়া যায়।
যেমন আমি জেনেছি, জেনিফারের বয়স যখন সাড়ে তিন তখন তার বাবা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। একই গাড়িতে জেনিফারও ছিল। অ্যাক্সিডেন্টে সে মাথায়, মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পেয়েছিল। অনেক চিকিৎসার পর সে বেঁচে যায়। এখন সে সুস্থ। কিন্তু মাঝে মাঝে পিঠে আর মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জেনিফারের বাবা মারা যাওয়ার সময় জেনিফারের মায়ের বয়স ছিল কেবল ২১। ওর মা ছিলেন খুব সুন্দরী! বছর ঘুরতেই তিনি আবার বিয়ে করলেন।
জেনিফারের সৎ-বাবা একজন প্লাম্বার। ভীষণ রাগী। রাতে মদ খেয়ে চিৎকার করে পাড়া মাথায় তোলে! মায়ের ও তার গায়ে হাত তুলেছে অনেকবার। তার মায়ের এই পক্ষের একটা ছোট বোন আছে, জেসিকা। জেনিফার তাকে ভীষণ ভালোবাসে।
নাইন্থ গ্রেডে পড়ার সময় লসঅ্যাঞ্জেলেসের একটা ছেলের সঙ্গে জেনিফারের ইন্টারনেটে পরিচয় হয়েছিল। নাম, মার্ক। মার্ক তার চেয়ে ১৫ বছরের বড়। হলিউডের কোনো এক স্টুডিওতে কাজ করত। লসঅ্যাঞ্জেলেসে গেলে মার্ক তাকে হলিউডে কাজ জুটিয়ে দেবে বলেছিল। জেনিফারের সঙ্গে দেখা করতে সে অস্টিনেও এসেছিল একবার। তাদের ঘনিষ্ঠতা চুমু পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু একপর্যায়ে মার্ক তার স্কার্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুব নোংরা আদর করতে আরম্ভ করে যা জেনিফারের ভালো লাগেনি। ওইটুকুই। তবে মার্ক চলে যাওয়ার পর মার্কের কাছে যাওয়ার একটা আকুতি সে অনুভব করতে শুরু করে। সে জানে না মার্ক ছেলেটা আসলেই কেমন। জানতে ভয়ও হয় কেননা আমেরিকায় অনেক স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা চূড়ান্ত ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকার হয়।
জেনিফার একাধিকবার পালাতে চেয়েছে। প্রথম কিছুদিন সাহসে কুলোয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, পালালে সৎ বাবার কাছে তার মা চূড়ান্ত হেনস্তা হবেন। মার্কের সঙ্গে তার সম্পর্কটি ভাঙার পেছনেও সেই একই কারণ তার সৎ-বাবা। তিনি একদিন ফোনের অন্য লাইনে মার্কের সঙ্গে ওর আলাপচারিতা শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। শাস্তিস্বরূপ তিনি মা-সহ ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। প্রবল ঠান্ডার সেই রাতে মা-মেয়ে প্রথমে রাস্তায়, পরে একটা গ্যাস স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। রাতে বিয়ার, সিগারেট বা গাড়ির গ্যাসোলিন নিতে আসা কাস্টমারগুলো আর কখনো কখনো হোমলেস মাতাল লোকগুলো ওদের উদ্দেশ করে কুৎসিত ইঙ্গিত আর ভাবভঙ্গি করেছিল। সে কথা ভাবলে আজও তার গা শিউরে ওঠে! সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, একটু টাকা জমলেই সে পালাবে। পালাবেই। প্রথমেই কিনবে নিজের জন্য একটা মোবাইল ফোন। সে ছাড়া তার ক্লাসের প্রায় সবারই মোবাইল ফোন আছে। এতে তার খুব অপমান বোধ হয়, নিজেকে ছোট লাগে। কিন্তু তার পরিবারে সে আবদারের কথা বলার উপায় নেই।
ওর কাছে ওর সৎ-বাবার আরেকটা রুটিন চাহিদা আছে যার শোধ হিসেবে জেনিফার বড় হয়ে প্রথম সুযোগেই তাকে খুন করবে। কিন্তু কী চাহিদা তাকে পূরণ করতে হয় জেনিফার আমাকে খুলে বলেনি, আমিও চাপাচাপি করিনি। বেশি মানসিক চাপে নাকি তার মাথাব্যথা হয়। ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়ে নাক গলানো আমার স্বভাববিরুদ্ধ।
জেনিফারের কথায় আমি মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত, মাঝে মাঝে অবাক, আর মাঝে মাঝে খুব মুগ্ধ! মুগ্ধতার ভাগই বেশি। তিন-চার মাসের মধ্যেই একটা অদৃশ্য কিন্তু ভীষণ শক্তিশালী টান অনুভব করতে শুরু করলাম তার প্রতি। সে-ও আমাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করেছে এর মধ্যে একাধিকবার তা জানিয়েছে। আমেরিকায় ডেটিংয়ের ক্ষেত্রে দু’জন মানুষ একে অপরকে তিন-চার মাস না দেখে থাকে তা খুবই অস্বাভাবিক এবং ‘অনেক দীর্ঘ’ সময় বটে। কিন্তু কী এক বিশ্বাসে যেন আমরা একে অপরকে কখনো দেখতে চাইনি। ছবিও না। বলতাম, প্রথম দেখা সামনাসামনি দেখা হবে।
তবে আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইতাম, ওর কণ্ঠস্বর শুনতে চাইতাম। কিন্তু ওর সমস্যাটাও বুঝি। বাবাকে এড়িয়ে বাড়ির ফোন থেকে ফোন করা প্রায় অসম্ভব! তিনি সেটা পছন্দ করবেন না। জেনিফার একদিন আমাকে মনে করিয়ে দিল, ‘‘আমাদের দু’জনের তো কখনো ফোনে কথা বলবার কথা ছিল না।’’ যে কারণে সে আমাকে কখনো বাইরের কোনো ফোন থেকেও ফোন করেনি। করবেও না। তার এক কথা, সে প্রথম সরাসরি আমাকে দেখতে চায়, কথা বলতে চায়। সেই রোমাঞ্চটি সে হারাতে চায় না।
একপর্যায়ে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। মনে হচ্ছিল আসলে সে কোনো কারণে আমাকে এড়াতে চাইছে। অবশ্য একজন বাঙালি যুবকের মনে প্রেমের যে বোধ, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই খাঁটি আমেরিকান মেয়ের মনেও যে একই অনুরণন ঘটবে তা প্রত্যাশা করা মুশকিল! কারণ এরা খুবই বাস্তববাদী হয়।
এবার জেদ করলাম, কথা না বললে আমি আর ইমেইলের রেসপন্স করব না।
আমার জেদে কাজ হলো। একপর্যায়ে সে হার মানল। বলল, আগামী তিন দিন সে ক্লাস প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু তিন দিন পরে আমাকে ফোন করবে।
এই তিন দিন আমার খুব উত্তেজনায় কাটল।
তারপর ঠিক একদিন দুপুর বেলা ফোন এল তার। অদ্ভুত শান্ত এবং মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর আমার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিল। এত দিন অপেক্ষার পর প্রথম কথা। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ?’
বয়সের তুলনায় বেশ গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলে। এক অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় অনুভূতি হলো আমার বুকের ভেতর। ই-মেইলের ভাষার সঙ্গে তাকে ঠিক মেলাতে পারছিলাম না।
তার সৎ-বাবার ওয়ার্কশপ ওদের বাড়িতেই। ফোনটা সেই ওয়ার্কশপের। এ কারণে জেনিফার ফোন রাখার আগে আমাকে বারবার সতর্ক করল এবং প্রতিজ্ঞা করাল আমি যেন বাবার ওই নম্বরে কখনো কল না করি। তাতে মা এবং ওর কপালে দুর্গতি নেমে আসবে।
কথা শেষে জেদ করে সেদিন ইমেইলে লিখলাম, ‘‘এতই যখন বাধা তখন আমিই একদিন অস্টিনে আসব এবং তোমার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করব।’’