আমেরিকার তালা, বাঙালির বিশ্বাস

তালা খোলা সবচেয়ে সহজ মনে হয় আমেরিকায়। তবে সঠিক চাবিটি থাকা চাই। বাংলাদেশে চাবি হাতে থাকলেও অনেকেই তালা খুলতে পারেন না। এখানে তেমনটি হয় না। কোন দেশে চাবির কয় পাকে তালা খোলে ধারণা নেই, তবে আমেরিকায় তালা খোলে চার আনা পাকেই। অর্থাৎ সঠিক চাবি তালার ভেতর ঢুকলেই তালা খুলে যায়। এর অনেক রকম প্রতীকী অর্থও করা যেতে পারে। সত্যি বলতে, সঠিক চাবির সঙ্গে তালা খোলার সঠিক কৌশলটিও জানা চাই। এখানে সে কৌশল জেনে যায় বেশির ভাগ মানুষ। ঝুলে থাকে যারা, তারা সংখ্যায় খুব কম।
এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এক বাঙালি কর্মী আকস্মিক চাকরিচ্যুত হলেন। প্রতিষ্ঠান মালিকও বাঙালি। তিনি প্রথমেই যে কাজটি করলেন, সেটি হচ্ছে তালা-চাবিওয়ালাকে ফোন করলেন। ওদেরকে বলা হয় ‘লকস্মিথ’। মিনিট দশেকেই গাড়ি নিয়ে ছুটে এল সুদর্শন এক রাশিয়ান তরুণ। তাকে বলা হলো, পুরোনো বন্ধ তিনিটি তালা খুলতে হবে, আর সদর দরজার তালার জন্য বানাতে হবে চাবি। লকস্মিথ জানাল, তালা খোলার কোনো ব্যবস্থা তার কাছে নেই। তালা তিনটি কেটে বাদ দিতে হবে। এর জন্য দিতে হবে তিন শ ডলার। আর নতুন দুটি লক ও চাবির জন্য সত্তর ডলার। মানে কী? প্রতিষ্ঠান মালিক একবাক্যে রাজি হলেও অন্য দু-একজন বাঙালি বাঁধ সাধলেন। বললেন, তালা আমরা নিজেরাই ভাঙতে পারব, শুধু নতুন তালা লাগিয়ে নেন। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়, কারণ নিউইয়র্ক এমনকি গোটা আমেরিকায় রাস্তার পাশের দোকানে প্রকাশ্যে ধারালো যন্ত্র দিয়ে তালা কাটা অপরাধ। কারণ, তালা কাটার যন্ত্র একমাত্র লকস্মিথই বহন করতে পারে। এর জন্য তাকে লাইসেন্স দেওয়া আছে। লকস্মিথ তরুণটি এক মিনিটে তিনটি তালা কেটে পরবর্তী দুই মিনিটে দুটি তালা লাগিয়ে তিন শ সত্তর ডলার গুণে নিয়ে চলে গেল।
বাঙালি জীবনে অবিশ্বাস আর অনাস্থা আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এই অবিশ্বাস অনেকটা অর্জনের মতো। ঠেকে ঠেকে শেখা। কিন্তু ঠেকতে ঠেকতে নিজের প্রতিও একসময় অনাস্থা এসে বাসা বাঁধে। তখন আত্মপরিচয়ের সংকট দেখা দেয়। নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালিদের একটি অংশের এই সংকট বেশ স্পষ্ট। ব্রুকলিনে বসবাসকারী ফরিদপুরের এক তরুণ সেদিন বললেন, দেশে বাংলাদেশিরা মোটা দাগে আওয়ামী লীগ কিংবা আওয়ামীবিরোধী—এই দুই ভাগে বিভক্ত। আর এখানে প্রবাসী বাঙালিরা হাজার ভাগে বিভক্ত। মাথা তোলা ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সংগঠনের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রচলিত-অপ্রচলিত অঙ্গ সংগঠনের অজস্র শাখা রয়েছে এখানে। রয়েছে দেশের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়নভিত্তিক সমিতি। এসব সমিতির মধ্যেও দ্বিধাবিভক্তি ও রেষারেষি রয়েছে। রয়েছে নানামুখী অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। বিদেশের মাটিতে কষ্টার্জিত অর্থ তারা এসব সংগঠনের কাজে ব্যয় করে ঝামেলা, সংঘাত আর প্রতিযোগিতাকে ঘরে ডেকে আনেন। কেউ কেউ গড়পড়তা সবকিছুকে মেনে নিয়ে বলতে পছন্দ করেন, এ ছাড়া কিইবা করার আছে? এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্কের আইনজীবীর সহযোগী এক বাংলাদেশির ভাষ্য বেশ গ্রহণযোগ্য। তিনি বললেন, প্রবাসে যাঁরা বসবাস করেন তার বড় অংশটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা থেকে আসা। তাদের কাছে ‘ভিলেজ পলিটিকস’ সংস্কৃতির একটি অংশ। ভিলেজ পলিটিকস মূলত একটি আদি সংস্কৃতি ও কৌশল, যার মূলে থাকে প্রভাব বিস্তার। এখানে সেটির কোনো উপযোগিতা ও আবেদন না থাকলেও তার ব্যবহার আছে। একটি সংগঠনের সাধারণ কোনো পদে থেকে একজন যখন তৃপ্তিকর আত্মপরিচয় খুঁজে পান না, তখন বাধ্য হয়েই তাঁকে অন্য একটি সংগঠন খুলে তার মাথা হওয়ার প্রয়াস নিতে হয়। বাঘের লেজ না হয়ে বিড়ালের মাথা হওয়ার উদ্যোগের মতো। তবে এর সবই থাকে ভাসা ভাসা।
আমেরিকান সংস্কৃতির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা সবাই ছুঁতে পারে। বাধ্য হয়েই ছুঁতে হয়। সেটি হচ্ছে কারও ভেতরে প্রবেশ না করা, নিজের বিষয় ছাড়া কোনো কিছুর গভীরে না যাওয়া। কারও বিষয়ে যেহেতু অন্য কারও মাথাব্যথা নেই, তাই যা ইচ্ছে তা করার সুযোগ আছে এখানে। আইনের ব্যত্যয় না হলে কোনো অসুবিধা নেই। গল্পে গল্পে এসব কথা উঠলে কেউ কেউ বলেন, এই অবাধ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতাই বিদেশের মাটিতে বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈভবকে গঠনমূলকভাবে তুলে ধরতে দেয় না। প্রভাব বিস্তারের গঠনমূলক, কার্যকর ও সাংস্কৃতিক কৌশল না থাকার কারণে প্রবাসে মানুষের সংখ্যা বাড়লেও দেশের ভাবমূর্তি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রসারিত হয় না। তবে মোটা দাগে ভাষার প্রসার ঘটছে। এটি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নয়, বরং বহু ভাষা ও সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবেই অন্য ভাষার কদর করতে আন্তরিক আমেরিকা।
অন্য জাতি-গোষ্ঠী এ দেশে যেভাবে এগিয়ে গিয়ে তাদের ভাষা সংস্কৃতির শুদ্ধ জায়গাগুলো চর্চার পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছে, আমাদের প্রবাসীর তা এখনো পারেনি। এখানে তারা নিজের ক্ষুদ্র পরিচয়টিকে কীভাবে চকচকে করা যায়, সেদিকেই বেশি আন্তরিক। কিন্তু বিরাট বৃত্তে নিজস্ব সংস্কৃতির স্বাদ তারা গ্রহণ করতে যেমন জানেন না, একইভাবে এদিকে আত্মনিবেদনের উদারতাও নেই।
কয়েক দিন আগে রেস্তোরাঁয় এক তরুণের সঙ্গে দেখা হলো। ঘুম ঘুম চোখ। এসেই সে চিৎকার করে কয়েকজনের নামোল্লেখ করে খিস্তি করল। আমার কাছে নেশাগ্রস্ত মনে হলো। পরক্ষণেই হাসি দিয়ে সবার সঙ্গে এসে হাত মিলিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল। অনেকেই তাকে নানারকম গালমন্দ মেশানো কথাও বলল। কোন কিছুতেই সে গা করল না। চা খেয়ে উঠে গেল। তারপর মাঝে মাঝেই তাকে দেখি প্রবাসী বাঙালি মহলে পাগলাটে ছোকরা হয়ে ঘুরতে।
কয়েক দিন বাদে ফেসবুকে কোনো এক বন্ধুর বন্ধু হিসেবে ওই তরুণের ওয়ালে দেখলাম একটি পোস্টার। সেখানে লেখা ‘অমুক এলাকার মানুষ তাকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চায়।’ বোঝা যায়, তার জীবনের চূড়ান্ত স্বপ্ন এটি। তাই স্বপ্নের মতো করে তৈরি করেছেন একটি পোস্টারের নকশা। অবশ্য, এখানে তার রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। বড় দলের মনোনয়নও এভাবেই হয়তো জুটে যায়। না জুটলেও অসুবিধা নেই, স্বাধীনভাবে আত্মপরিচয়ের এই চর্চাটি তো করা সম্ভব হলো! এই চর্চার নেশা এখন ছড়িয়ে গেছে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়।
তালাচাবির গল্পের শেষ টানতে চাই। প্রবাসী বাঙালি বন্ধুর যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তালা পরিবর্তনের গল্প নিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, তারও একটি হালনাগাদ তথ্য আছে। তালা পরিবর্তনের দিন দশেক পর তার অফিসের সদর দরজায় পুরোনো তালার একটি চাবি পাওয়া গেছে। বন্ধুটি জানাল, আকস্মিকভাবে এখানে চাবি পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এতে নিশ্চিত করেই বোঝা যায়, বাঙালি যে তরুণ এখানে কিছুদিন কাজ করেছিল, সে–ই নিশ্চয়ই রাতে অফিস খোলার চিন্তা নিয়ে এসেছিল। তালা পরিবর্তন হওয়ায় সে অফিস খুলে ঢুকতে পারেনি। বুঝলাম, আমার বন্ধুটি নিউইয়র্কে অনেক দিন থেকে এখানকার তালা খোলার নিয়মটি জেনে গেছে। বাঙালি কর্মীর প্রতি তার অবিশ্বাস আর অনাস্থা নিয়ে আমি যে আপত্তিটুকু করতে চেয়েছিলাম বোঝা গেল, তা ঠিক ছিল না।