প্রতারণার 'আজব' পাঠ

নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালনা পেশায় নিয়োজিত আছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। এ পেশায় আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। যেমন আছে স্বাধীনতা, তেমন কষ্টও। সাফল্য আছে যেমন, কম হলেও আছে ব্যর্থতা। এ পেশায় থেকে অথবা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অনেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘর-বাড়ির মালিক হয়েছেন। জীবনে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত। এক-দুজন মন্ত্রী-সাংসদও হয়েছেন।
ইয়েলো ক্যাব, গ্রিন ক্যাব, ব্ল্যাক ক্যাব বা লিমোজিন যারা চালান, তাদের অনেকেরই আছে নিজস্ব গাড়ি, ম্যাডেলিয়ন বা পারমিট। যাঁদের নেই, তারা ভাড়া করে চালান। কারও কারও আছে নিজস্ব গ্যারেজ। ট্যাক্সি ইনস্যুরেন্সের সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন বেশ কিছু বাঙালি। এ পেশার নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারির ভূমিকায় আছে ট্যাক্সি অ্যান্ড লিমোজিন কমিশন (টিএলসি)। পেশায় আছে পদে পদে বিপত্তি, সদা সতর্ক থাকতে হয়। একদিকে সময়, রেগুলেশন, আইন-কানুন, পুলিশ, টিএলসি, টিকিট, শুনানি, জরিমানা—অন্যদিকে যাত্রীসেবা, নিজের আয়-নিরাপত্তা। নগরে উবার চালু হওয়ার পর হঠাৎ করে ম্যাডেলিয়নের মূল্য অস্বাভাবিক কমে যায়। ঋণ নিয়ে যারা ম্যাডেলিয়ন কিনেছিলেন তাদের মাথায় হাত, অনেকেই দিশেহারা। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ট্যাক্সিক্যাব চালকের পেশায় নেমে আসে অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। এরই মধ্যে এই পেশার কয়েকজনের আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হলে কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়, কী করে মোকাবিলা করা যায় এই দুর্যোগ।
আমি এখানে একজন ট্যাক্সিক্যাব চালকের কাহিনি তাঁর ভাষায় তুলে ধরব। অবশ্য এখন তিনি এ পেশায় নেই। এক সময় তার ছিল নিজস্ব ব্যবসা। ব্যবসায় সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসার উপক্রম। এ সময় এক বন্ধুর পরামর্শে টিএলসি লাইসেন্স করে নেমে পড়েন রাস্তায়। ব্ল্যাক ক্যাব ও গ্রিন ক্যাব—দুটিই চালিয়েছেন। প্রায় দুবছর পর সিদ্ধান্ত নেন আর চালাবেন না। তার ধারণা, এ জগৎ তার নয়। গাড়ির ভাড়া, পুলিশ ও টিএলসির টিকিট, দুর্ঘটনা ও এক শ্রেণির যাত্রীর প্রতারণার পর হাতে যা থাকে, তা পরিশ্রমের তুলনায় যৎসামান্য। নিজের খরচই কুলোয় না। এর চেয়ে এই পেশা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। অবশ্য এখনো তিনি মনে করেন, যারা সাহসী ও বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা প্রখর—এই পেশায় তাদের সাফল্য অনিবার্য। আমার কোথাও ঘাটতি ছিল, তাই পারিনি। প্রায় প্রতিদিনই ঠকতাম। ভাড়া না দিয়ে চলে যেত কিছু যাত্রী। সতীর্থরা পরামর্শ দিতেন ভাড়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত দরজা না খোলার। বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে পারতাম না। আমি যেমন উদার তেমন বোকা। মনে-প্রাণে সে দিনগুলোর কথা ভুলে যেতে চা। স্মৃতি থেকে মুছে যাক সব।
এই সাবেক ক্যাবচালকের অভিজ্ঞতা খুবই আকর্ষণীয়, মজার আবার বেদনারও। তিনি বলছিলেন, শুরুতেই ধাক্কা খেলাম। ব্ল্যাক ক্যাব চালাই। জ্যাকসন হাইটসের রুজভেল্ট অ্যাভিনিউ ধরে এগোচ্ছি। কেউ ডাকে কিনা, চোখ-কান খোলা রেখেছি। ৭৪ স্ট্রিট সাবওয়ে স্টেশনের সামনে আসতেই দেখলাম, দুপাশে বেশ লোকজন। ট্রেন অথবা ট্যাক্সিক্যাবের অপেক্ষায় আছে তারা। আমার ডানদিক থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষ হাত ইশারায় আমাকে থামাল। সম্ভবত কোথাও যাবে। ডানদিকে একটু সরে এসে ট্যাক্সি থামিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিলাম। ওরা দুজন ভেতরে ঢুকে সিটে বসল। আমি পেছন দিকে তাকাচ্ছি তাদের গন্তব্য শোনার জন্য। ওটা জেনেই রওনা দেব। কিন্তু না, গন্তব্য নয়, পেছন থেকে একটি ভারী কণ্ঠ ভেসে এল, গাড়ি পাশে নিয়ে পার্ক করো। আমরা টিএলসির লোক। তোমার ড্রাইভিং ও টিএলসি লাইসেন্সসহ সব কাগজপত্র আমাদের দাও। আমি থ’ মেরে গেলাম। কী থেকে কী হয়ে গেল। সবকিছু ভালো করে জানিও না। শুনেছি রাস্তা থেকে যাত্রী পিকআপ করলে জরিমানা গুনতে হয়। টিএলসির লোকজন যাত্রীবেশে এভাবে আটক করে। যাক, সব কাগজপত্র তাদের দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে আছি। তারা সেগুলো নিয়ে কোথাও চলে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম, আর নয় ব্ল্যাক ক্যাব। এবার গ্রিন ক্যাব নেব। ম্যানহাটন ছাড়া সিটির সব জায়গা থেকে যাত্রী নেওয়া যাবে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ওরা ফিরে এল। সব কাগজপত্রসহ হাতে ধরিয়ে দিল একটি টিকিট বা সমন। এক শ ডলার জরিমানা। পরে টিকিট পড়ে জানলাম, অবৈধভাবে যাত্রী পিকআপের জন্য নয়, টিএলসির নিয়ম অনুযায়ী কী একটা কাগজ ট্যাক্সির ভেতরে প্রদর্শনের জন্য রাখার কথা, সেটি তারা পায়নি, এজন্য এই জরিমানা।
এক বিপ্লবী (?) যুবকের কথা চেষ্টা করেও ভুলতে পারি না। একই জায়গা রুজভেল্ট ও ৭৪ স্ট্রিটে আমার ট্যাক্সিতে উঠে সে তার গন্তব্য জানায়, ৯৯ স্ট্রিট নর্দার্ন বুলেভার্ড। আমি রওনা হলাম। সে জানতে চাইল, আমার অরিজিন দেশের নাম কি। বললাম, বাংলাদেশ। সে আমার পেশার প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি জানিয়ে ১০-১২ মিনিটের এক বক্তৃতা দিয়ে থামল। আমি তার বক্তৃতায় অভিভূত। এ যেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা কোনো সমাজতান্ত্রিক নেতার ক্ল্যাসিক্যাল ভাষণ। চে গুয়েভারা, নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে হুগো শাভেজসহ বড় বড় বিপ্লবীর নাম উচ্চারণ করতে সে ভুল করল না। তার বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, এ পৃথিবীর মোট সম্পদের ৯০ শতাংশের মালিক বনে তা কুক্ষিগত করে আছে মাত্র এক শতাংশ মানুষ। বড় বড় করপোরেশন ও ব্যাংক দুনিয়ার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। একই সঙ্গে রাজনীতিও। এই বিশ্ব ব্যবস্থার কারণে গরিব মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অসাম্য ও বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। জনগণ যদি সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ না হয়, তা হলে ভবিষ্যতে আরও অভিশাপ অপেক্ষা করছে।
আমরা কখন যে নর্দার্ন বুলেভার্ড ও ৯৯ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছি খেয়ালই করিনি। বিপ্লবী যাত্রী বলল, বামদিকে টার্ন নাও। তাই করলাম। ২০-২৫ গজ সামনে যেতেই গাড়ি থামাতে বলল। থামালাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল, এক শ ডলারের ভাংতি হবে কিনা। বললাম, না। গাড়ি থেকে নেমে গেল সে। বলল, তোমার ভাড়া হয়েছে দশ ডলার, আমি তোমাকে বিশ ডলার দেব। হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার এটা পাওয়া উচিত। আমি ওই কর্নার স্টোর থেকে নোট ভাঙিয়ে আনছি, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো। মাথা নাড়লাম। সে চলে গেল। গরিবের বন্ধু (?) বিপ্লবী আর ফিরে এল না। তার ভণ্ডামি বুঝতে আমার সময় লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। এই যাত্রায় সতীর্থরা পরামর্শ দিলেন, সঙ্গে প্রচুর ভাংতি রাখবে। এবার অন্য গল্প।
অ্যাস্টোরিয়া থেকে ব্রডওয়ে ধরে আসছি উডসাইডের দিকে। ৫০ স্ট্রিটের পরেই সড়কের দুপাশে উডসাইডের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, সারি সারি বিল্ডিং। সামনে খোলা মাঠ, খেলার মাঠ, বাগান। বাঁ দিকে দেখলাম, খোলা মাঠে দুই তরুণ-তরুণী কথা বলছে। আমার গ্রিন ক্যাব দেখে তরুণীটি হাত তুলল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তরুণকে ‘টা টা’ দিয়ে দৌড়ে আমার গাড়ির পাশে আসল, তারপর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক ঝটকায় সামনের দরজা খুলে আমার পাশের সিটে বসে সিট বেল্ট পরতে থাকল। আমি ‘নো’ ‘নো’ বলছি, কে কার কথা শুনে! বললাম, আপনি পেছনে যাত্রীদের নির্ধারিত আসনে বসুন। এ জায়গা আপনার নয়। প্লিজ,আপনি পেছনে যান। তরুণীটি জবাবে বলল, দেখো, আমি পেছনে বসে গাড়িতে ভ্রমণ করতে পারি না। সামনে বসলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যাও, কোনো অসুবিধে হবে না। আমাকে ম্যানহাটন ইস্ট সাইডে দিয়ে আসো। বললাম, তা দিয়ে আসব, কিন্তু আপনাকে পেছনে যেতে হবে। না, তরুণীটি পেছনে যাবে না। গাড়ি থেকেও নামবে না। এ তো দেখি উটকো ঝামেলা! কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তরুণীটি তাগাদা দিল, চল চল। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে রওনা হলাম। এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। তরুণীটির পরনে জিনসের হাফ প্যান্ট, কিছুটা হয়তো ছেঁড়া (ফ্যাশন?), গায়ে বুক কাটা হাফ শার্ট। উন্মুক্ত হাঁটু, ঊরুর একাংশ, তীব্র সুগন্ধি। কানে হেড ফোন লাগিয়ে সম্ভবত গান শুনছে/দ্রুত বেগে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। ওর দিকে তাকানোর মন-মানসিকতা নেই। পুরো রাস্তায় একবার তার কথা কানে ভেসে এল। সে কী কী পছন্দ করে—যেমন গান শোনা, ভ্রমণ করা ইত্যাদি বলে যাচ্ছিল, তার কথায় আমি সাড়া দিলাম না।
বি কিউ (ব্রুকলিন-কুইস এক্সপ্রেসওয়ে) ধরে উইলিয়ামসবার্গ ব্রিজ পার হয়ে ম্যানহাটনে পৌঁছলাম। তারপর ইস্ট সাইডে দক্ষিণমুখী এফডিআরের পাশে যেখানে উডসাইডের মতো সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং রয়েছে, তার একটির পাশে আমাকে থামতে বলল। থামলাম এবং মিটারে কত উঠেছে তাকে জানিয়ে দিলাম। সে গাড়ি থেকে নেমে পাশের ভবনগুলো দেখিয়ে বলল, এখানে আমার বাসা, কয়েক মিনিটের মধ্যে তোমার পাওনাটা এসে দিয়ে যাব। আমার জবাব শোনার আগেই সে ভবনের দিকে ছুটল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়, কিন্তু তার ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। আমি কোথায় গিয়ে খুঁজব। নাম জানি না, ঠিকানা জানি না, এমনকি তার চেহারাটিও ভালো করে দেখিনি, প্রয়োজনে শনাক্ত করব কীভাবে। কি আর করা, ফিরে এলাম শূন্য হাতে। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, রোজই তো প্রতারিত হই, এই তো আমার নসিব! আবার নিজেকে নিজে শাসাই, শুধু নসিবের দোহাই কেন দিই, বোকামির কথা কেন ভাবি না?
পরে একজন অভিজ্ঞ ট্যাক্সিচালক তার মতামত দিতে গিয়ে বলেন, তরুণী খুবই চালাক, সে জানে সামনে বসলে তার ছবি উঠবে না। পেছনের যাত্রী আসন ক্যামেরার আওতায়। চালকের নিরাপত্তার জন্য গ্রিন ক্যাবেও ক্যামেরা বসানো আছে।’
অবশ্য আমি কখনো জানতে চেষ্টা করিনি ক্যামেরায় সামনের ছবি উঠে কিনা।
আরেকদিন সন্ধ্যায় নর্দার্ন বুলেভার্ড ধরে পশ্চিম দিকে যাচ্ছি, সম্ভবত ৮৫ স্ট্রিটে একজন হাত তুলল। পাশে যেতেই দেখি একজন নয়, ওরা চারজন। করোনা যাবে। তিনজন উঠল পেছনে, একজন সামনে। সাধারণত রওনা হওয়ার আগে আমি দেখে নিই, দরজা লক হলো কিনা। দেখলাম ঠিক আছে, লক। দুতিন গজ যেতে না যেতেই অবাক হয়ে দেখলাম, পেছনের দরজার পাশের মধ্যবয়স্ক যাত্রীটি দরজা খুলে এক পা বাইরে বাড়িয়ে দিল এবং স্প্যানিশ ভাষায় কি সব বলতে থাকল। আমি গাড়ি থামিয়ে দিলাম। পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তিনি দরজা খুলেছেন? একই ভাষায় যাত্রীটি কি সব বলল, তার কিছুই বুঝলাম না। তখন সামনের আসনে বসা বয়সে তরুণ যাত্রী আমাকে ইংরেজিতে বলল, প্যাসেঞ্জারের পা বাইরে রেখেই আমি নাকি গাড়ি চালাতে শুরু করেছি। এটা আমার ভুল এবং এ কারণে যাত্রী পায়ে আঘাত পেয়েছে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসা খরচসহ সব ক্ষতিপূরণ আমাকে দিতে হবে। সে জানতে চাইল পুলিশ ডাকবে কিনা। বললাম, উনি তো বন্ধ দরজা খুলে বাইরে পা রেখেছেন, আমার দোষ কোথায়? উত্তরে সে বলল, আমরা চারজন সাক্ষী, তুমি দায়ী। সে আরও বলল, এক কাজ করো, দু শ ডলার দিয়ে দাও, আমরা ডাক্তার দেখাব, তোমাকে কিছু করতে হবে না, এমনকি পুলিশও ডাকতে হবে না। বললাম, আমি টাকা দেব কেন? তার চেয়ে ভালো পুলিশ ডাকো, হাসপাতালে নিয়ে চলো। জিজ্ঞেস করলাম, হাসপাতালে যাবে কিনা, আমি নিয়ে যাব। তারা রাজি হলো। আমরা চললাম হাসপাতালের দিকে।
পথিমধ্যে তরুণটি আমাকে বলল, পুলিশ, ডাক্তার, মামলা, কোর্ট, অ্যাটর্নি—খরচতো কম নয়, তার চেয়ে কিছু দিয়ে দেওয়া ভালো হতো না? ঝামেলা চুকে গেলো। বললাম, আমিতো এইমাত্র কাজে বের হয়েছি, পকেটে আছে সর্বসাকল্যে চল্লিশ ডলার। বলল, তাই দাও, আমি সামলাব, হাসপাতালে যেতে হবে না, আমাদের জংশন বুলেভার্ডে নামিয়ে দাও। তাই হলো। তাদের নামিয়ে দিলাম ৩৭ অ্যাভিনিউ, জংশন বুলেভার্ডের কাছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ওখানে এক বারের সামনে ওরা চারজন খোশগল্পে মত্ত।
আমার শুভানুধ্যায়ী দু-একজন আমাকে দোষারূপ করে বললেন, ওরা প্রতারক চক্রের সদস্য, আমি এভাবে ছেড়ে দিলাম কেন? পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। ওরা এভাবে ‘ভুয়া’ মামলা সাজিয়ে প্রতারণা করে থাকে।
এটিকে শুধু প্রতারণা নয়, তার চেয়ে জঘন্য। ভাগ্যিস, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সম্ভবত এদিন কলম্বিয়ান কোনো দিবস বা সকার গেম ছিল। নর্দার্ন বুলেভার্ডের বিভিন্ন বার ও রেস্তোরাঁ কলম্বিয়ান অভিবাসীতে পরিপূর্ণ। তারা খুবই উৎসবপ্রিয়। আমার গ্রিন ক্যাবে এক তরুণীসহ চার তরুণ বলতে গেলে জোর করে উঠে পড়ল। তাদের দিয়ে আসতে হবে ইস্ট অ্যালমহার্স্টে লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দরের পাশে। পেছনের আসনে বসেছে তরুণীসহ আরও তিনজন, সামনের আসনে একজন। ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি। পেছনের সিট থেকে তরুণীটি জিজ্ঞেস করল, আমি কি মুসলমান। হ্যাঁ বলতেই বলল ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’। আমি উত্তর দিলাম, ‘ওয়াআলাইকুম ওয়াস্‌সালাম’। মনে মনে ভাবলাম, সে হয়তো মুসলমান অথবা কোনো ধরনের সংযোগ আছে মুসলমানের সঙ্গে।
কলম্বিয়ান সংগীতশিল্পী সাকিরা দক্ষিণ আফ্রিকা ফুটবল বিশ্বকাপে ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গান গেয়ে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শুনেছি, তাঁর বাবা আরব বংশোদ্ভূত। এই তরুণীটির হয়তো এ ধরনের কোনো যোগসূত্র আছে। ইনসাইড গ্লাসে চোখ যেতেই দেখলাম, সে পাশের তরুণের সঙ্গে গভীর প্রণয়ে মগ্ন। আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রহমান, এটা হারাম—কি বলো, এটা হারাম। ঠিক বলিনি? ঠিক বলেছি, এটা পুরো হারাম। আমি কোনো সাড়া দিলাম না। অস্বস্তিতে ভুগছি। কখন যে পথ শেষ হবে! মনে হচ্ছিল, আশপাশে নারকীয় পরিবেশ বিরাজ করছে। ষোলোকলা পূর্ণ হলো যখন সামনের আসনে বসা তরুণ আমাকে বলল, দেখ, পেছনে তাকিয়ে দেখ, ‘দে মেইক লাভ, রিয়েল লাভ’। আমার চোখ সামনের দিকে। তবুও গ্লাসে চোখ পড়ল। তরুণীটি যুবকের কোলে, মুখে নির্লজ্জ হাসি নিয়ে বলছে, রহমান, সত্যি এটা হারাম, হারাম।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।