উত্তরের স্বপ্ন

বাস্তুভূমি ত্যাগ করে ভিনদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার ধারাটি আদিম যুগ থেকেই চলে আসছে। এর উদ্দেশ্য প্রধানত জীবন মান উন্নত করা। সুদূর উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ধারায় বাংলাদেশ থেকে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় দেশান্তরিত মানুষ নিয়ে এসেছে নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো। সবকিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দেশাত্মবোধের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত বহু প্রজন্মের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। এই ইতিহাসের দৃষ্টিগ্রাহ্য অংশে রাজনীতি কিংবা অর্থনীতিকে দেখা গেলেও ভিত্তিতে আছে সংস্কৃতি। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী ও লেখক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা তাদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে তৈরি করেন সমাজের এই বহিরাবরণ। আর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট হলো সেই বহিরাবরণের রূপকারদের সাংগঠনিক কাঠামো।
একটা মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশে পঁচাত্তরের মতো কালো অধ্যায় ও সামরিক উর্দি থেকে নবপ্রবর্তিত বিশেষ উর্দিতে সুসজ্জিত স্বৈরশাসকদের নির্লজ্জ কুচকাওয়াজের দুঃস্বপ্ন দেখা প্রজন্ম আমরা। মনে পড়ে, ঘরোয়া রাজনীতি নামক পাতানো খেলার যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা। মনে পড়ে সে সময়ের মঞ্চ ও পথ নাটক, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি এবং গণসংগীতের অনুষ্ঠানগুলোর কথা। চার দেয়ালে বন্দী রাজনীতির অঙ্গন যখন এগিয়ে যাওয়ার পথ ও কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধান্বিত, স্থবির, দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন তখন ছিল সরগরম। তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ না থাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন নিয়ে সবার মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় তখন প্রথম একটা প্রাথমিক সাংগঠনিক মোর্চা তৈরি হয়েছিল শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী এবং লেখক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে। প্রচণ্ড থমথমে পরিস্থিতিতে এই মোর্চার নেতৃত্বে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দেয় সাধারণ মানুষ। সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র নিরাপত্তায় স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ পুষ্পস্তবক দিয়ে যাওয়ার পর পুরো শহীদ মিনার চত্বর এই মোর্চার অধীনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের দখলে চলে আসে। এ সময় এরশাদ-সমর্থক কয়েকজন রাজনীতিক ফুল দিতে এলে তাদের গণরোষের মুখে পড়তে হয়। পরে এই মোর্চাই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নাম নিয়ে সারা দেশে ছাত্র ও গণসংগঠনগুলোর সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ শুরু করে। এই যুথবদ্ধ আন্দোলনের কারণেই নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছিল।
স্বাধীনতার আগে সত্তরের নির্বাচনে এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে দেশের সব শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী এবং লেখক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল জাতীয় চেতনা ও মূল্যবোধ গঠন করেছিলেন, যা স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলনীতিসমূহ এবং সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দীর্ঘদিনের কার্যকলাপই বাংলাদেশের সব মানুষকে একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীন বাংলাদেশে বারবার এই স্বাধীনতার চেতনা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এই স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখার কৌশলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আপসকামী, কর্মসূচির ক্ষেত্রে যখন দ্বিধান্বিত, আন্দোলনের নীতি ও কর্মসূচির ক্ষেত্রে তারা যখন দ্বিধাগ্রস্ত, তখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সক্রিয় কর্মীরা ’৮৩ সালের আগে বিচ্ছিন্নভাবে এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট জন্মের পর থেকে সংগঠিতভাবে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় সুসংগঠিত ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে।
২০১৯ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার সক্রিয়তার কুড়ি বছর উদ্‌যাপন করতে গিয়ে মনে পড়ছে নব্বইয়ের সেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আমি আমার জন্মশহর মৌলভীবাজারে। আমরা তখন স্বৈরাচারের চামচাদের হামলা ও পুলিশ বাহিনীর লাঠি-গুলির ভয় ও গ্রেপ্তারের হুমকি উপেক্ষা করে শহরের কেন্দ্রস্থলে রাজপথে মঞ্চ বানিয়ে গণসংগীত আর কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। এখন স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই নিউইয়র্ক শহরে এসেও যখন সেই একই ধারায় কাজ অব্যাহত রাখতে হচ্ছে, তখন মনে হয়, যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং দেশও স্বাধীন হয়েছে সত্য, কিন্তু মুক্তি আজও অর্জিত হয়নি।
মহাকালের হিসাবে কুড়ি বছর হয়তো খুব বড় একটা সময় নয়, কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনের প্রত্যাশা নিয়ে ভিনদেশে এসে জন্মভূমির কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া একজন ব্যক্তির জীবনে কুড়ি বছর একটি উল্লেখযোগ্য সময়। আশার কথা, প্রবাসের এমন অসংখ্য মানুষ বিগত কুড়ি বছর যাবৎ নিরলসভাবে লেগে আছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার সঙ্গে এই প্রত্যাশায় যে, একদিন তারা বাংলাদেশ নামের সেই স্বপ্নের দেশটি গড়ে তুলবে, যে দেশটি তার সব নাগরিকের সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার দেবে, যে দেশে থাকবে না সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা, ধর্মীয় উন্মাদনা।
আসুন, সবাই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার এই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থেকে কাজ করি, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারি।