রাতারাতি হায়েনার রূপে বন্ধু

[মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব আপন মানুষের চেহারা রাতারাতি কতই না বদলে গিয়েছিল। যে মানুষটার সঙ্গে এই কয়েক দিন আগেও সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে সময় কেটেছিল। সেই মানুষটিই রাতারাতি পরিণত হয়ে গিয়েছিল কতই না হিংস্র এক পশুতে! আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে এমন প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধের আগের দিন পর্যন্ত তারা ছিল বন্ধু। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেই বন্ধুদের কেউ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন আবার কেউ যোগ দেন আলবদর বাহিনীতে। একজন নিজের দেশকে বাঁচাতে গর্বের সঙ্গে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় আরেকজন ভুল রাজনৈতিক দর্শন ও অজ্ঞতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করেন। রাজাকারের খাতায় তাদের নাম লেখান। ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে এমন নির্মম ঘটনা ঘটেছিল। যুদ্ধের আগে ছিল তারা বন্ধু, কিন্তু যুদ্ধের পর রাতের অন্ধকারে তারাই হয়ে উঠে হায়েনার মতো হিংস্র জন্তু। সেই ঘটনাটি বলেছেন সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী সৈয়দা ইসমত আরা। ১৯৭১ সালে সৈয়দা ইসমত আরা ছিলেন ছোট। কিন্তু সেই সময়ের ঘটনা তিনি স্মরণ করছেন তার স্মৃতিশক্তির ওপর ভর করে। স্থান যুদ্ধকালীন সময়ে কিশোরগঞ্জ এলাকা। সৈয়দা ইসমত আরা বর্তমানে ঢাকায় আছেন ]

গল্প-১০
খায়রুলের লাশ দড়ি দিয়ে বেঁধে শহর প্রদক্ষিণ
খায়রুল জাহান ও হোসেন দুই বন্ধু। ১৯৭১ সালে দুজনই কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই খায়রুল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অন্যদিকে হোসেনের বাবা কিশোরগঞ্জ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে সে যোগ দেয় রাজাকার বাহিনীতে। হোসেনের বাবার নাম মাওলানা মোসলেহ উদ্দীন সরকার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোসলেহ উদ্দীন সরকার কিশোরগঞ্জ হয়বৎনগর এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে মোসলেহ উদ্দীনের হয়বৎনগর বাড়িটি রাজাকার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবেই মোসলেহ উদ্দীনের দুই ছেলে হাসান ও হোসেন দুজনই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেখানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি জুনের দিকে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ পৌরসভার পেরাভাঙ্গা এলাকায় একদল রাজাকার বিন্নাটির গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা করে তাদের সর্বস্ব লুট করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা বীর হান্নানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জয় হয় এবং তারা রাজাকারদের ঘেরাও করে রাখে। মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন। হোসেন কাল বিলম্ব না করে গোপন লোকের (নাম নাজিম উদ্দীন) মাধ্যমে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোসলেহ উদ্দীনকে সাহায্যের জন্য একটি চিরকুট পাঠায়। আগেই উল্লেখ করেছি, হোসেন ও খায়রুল দুজনই ছিলেন পরস্পরেরে বন্ধু। একসঙ্গে তাঁরা গুরুদয়াল কলেজে পড়তেন। মোসলেহ উদ্দীন মাওলানা চরের কাছ থেকে গোপন চিরকুট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে সাহায্য চান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মোসলেহ উদ্দীনের চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিন্নাটি গ্রাম এবং হান্নান মোল্লার বাড়ি ঘেরাও করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। শুধু তাই নয়, প্রতিশোধ নিতে তারা হান্নান মোল্লাসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত নেতা হাফিজ উদ্দীন, নিজামউদ্দিন ও মহরম আলীর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সেই যুদ্ধে খায়রুল জাহান বীরপ্রতীক ও তাঁর বন্ধু মোহাম্মদ সেলিম বীর প্রতীকসহ আরও একজন শহীদ হন।
পরের ঘটনা আরও করুণ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এলাকার রাজাকারদের সহযোগিতায় বর্বরতা চালিয়ে এলাকা ত্যাগ করে ও রাজাকার হোসেন তার বন্ধু খায়রুলের মৃত লাশ একটি রিকশার পা দানিতে রেখে সেই রিকশায় চড়ে খায়রুলের বুকের ওপর পা রেখে কিশোরগঞ্জ হয়বৎনগর মসজিদের সামনে আসে। মুক্তিযোদ্ধা খায়রুলের লাশসহ আরও তিনজন মুক্তিযোদ্ধার লাশ মসজিদের সামনে এনে রাখা হয়। সেই লাশের সামনে দাঁড়িয়ে হোসেন একটি বক্তৃতা দেয়। বক্তৃতায় নিজের দম্ভ ও যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা ইসলামের শত্রুসহ অনেক কূট ভাষা ব্যবহার করে একটি বক্তৃতা দেয়। বক্তৃতা দেওয়ার পর লাশগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে টেনে গোটা শহর প্রদক্ষিণ করা হয়। রাজাকার হোসেন এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁর এক সময়ের বন্ধু খায়রুলের এই মৃত্যু সংবাদটি নিজে গিয়ে খায়রুলের মাকে আনন্দের সঙ্গে দিয়েছিলেন। জানা যায়, খায়রুলের মা তখন হোসেনের মুখের ওপর শুধু এক দলা থুতু দিয়ে হোসেনকে তার ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

[এই গল্পটি বলেছেন মু আ লতিফ ও সৈয়দ আজীজুল বারী। লতিফ বর্তমানে কিশোরগঞ্জে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে অবস্থান করছেন। তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি। সৈয়দ আজীজুল বারী বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। তাঁদের দুজনের প্রতি কৃতজ্ঞ]

গল্প-১১
চিশতীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়
পুরো নাম মাইনউদ্দীন চিশতী। সবাই তাকে চেনেন চিশতী নামেই। কিশোরগঞ্জ আখড়াবাজারের পাশেই তাঁর বাড়ি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় চিশতী ছিলেন স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র। গুরুদয়াল কলেজে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই চিশতী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বেশ দক্ষতার সঙ্গেই তিনি কিশোরগঞ্জে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সে কারণে চিশতী হয়ে ওঠে স্থানীয় আল-বদর ও রাজাকারদের অন্যতম টার্গেটে। আল-বদর বাহিনী, রাজাকার বাহিনী চিশতীকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিশোরগঞ্জ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মাওলানা মোসলেহ উদ্দীন। তিনিও নির্দেশ দেন, যেভাবেই হোক এই ইসলামের শত্রু চিশতীকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে হবে। রাজাকার বাহিনীর খুব বেশি দিন তার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। এক গভীর রাতে চিশতী এসেছিলেন তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে তাদের আখড়া বাজারের বাড়িতে। তৎকালীন সময়ে রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর জানার জন্য সবার পেছনেই গোপন নজরদারি করতে সব সময় কিছু মানুষ রেখে দিত। যথাসময়ে আল-বদর বাহিনী খবর পেয়ে চিশতীকে জীবিত ধরতে তাঁদের আখড়া বাজারের বাড়ি ঘেরাও করে চিশতীকে ধরে ফেলে।
জানা যায়, যারা চিশতীকে ধরেছিল তারা সবাই ছিল বয়সে তরুণ, চিশতীর বয়সী ও তাঁর পরিচিত, কলেজের বন্ধু। তারাই চিশতীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনের পাশেই পরিত্যক্ত একটি লাল বাড়িতে নিয়ে যায়। সেই বাড়িটির নাম ছিল মাস্টারের বাড়ি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালে এই মাস্টারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের এনে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হত। মুক্তিযোদ্ধাদের চোখ উপড়ে ফেলা হত, তাদের হাত কাটা হতো, কখনো কখনো জবাই করে হত্যা করা হতো। চিশতীকেও সেই বাড়িতে আনা হলো। সারা রাত তার ওপর চলল পাশবিক নির্যাতন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, চিশতীর ওপর সারা রাত নির্যাতন চালাবে এবং ভোরের দিকে গুলি করে তাকে হত্যা করবে। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই চিশতীকে একরামপুর নামক স্থানে নেওয়া হয় এবং সেখানে রেললাইনের পাশে তাকে দাঁড় করানো হয়। উদ্দেশ্য গুলি করে হত্যা। তারপর কয়েকটা মুহূর্ত। কিন্তু আল-বদর বাহিনী ভাবল, গুলি করলে তো সব শেষই হয়ে যাবে। তার চেয়ে গুলি করে মারার আগে তাকে আবার কিছুক্ষণ নির্যাতন করা যাক। সেই রেললাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল নরসুন্দা নামের একটা নদীর ছোট মোহনা। চিশতী কিছুক্ষণ তাদের নির্যাতন সহ্য করলেন। তারপর চোখ বুজে প্রাণপণ দৌড় দিয়ে নরসুন্দায় ঝাঁপ দিলেন। চিশতী নদীর পানিতে ডুব দিয়ে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলেন। নদীর স্রোতের সঙ্গে নিজেও ভেসে যেতে থাকলেন। কিন্তু আল-বদর বাহিনীর হায়েনারা চিশতীকে এত সহজে ছেড়ে দিতে চাইল না। তারা নদীর পাড় ধরে চিশতীকে অনুসরণ করতে থাকে। সারা রাত নির্যাতনে চিশতী এমনিতেই অনেকটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন। শরীরে কোনো শক্তিই আর অবশিষ্ট ছিল না। বদর বাহিনীর হায়েনারা তাঁকে আবার নদী থেকে ডাঙায় তুলে আনল। তারপর তারা আর কোনো দেরি করল না। চিশতীকে সেই নদীর পাড়েই বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করল। চিশতীর লাশ গড়িয়ে পড়ে সেই নরসুন্দা নদীর জলে। সেই জলের পানি চিশতীর রক্তে রঞ্জিত হয়। সেই লাল রং কিছুদিন পরই জায়গা করে নিল একটা স্বাধীন দেশের গর্বিত পতাকার মাঝখানে। লাল সবুজের সেই পতাকায় চিশতীর রক্ত এখনো আমরা দেখতে পাই। চিশতী মারা যাওয়ার কিছুদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়। না, চিশতীর রক্ত বৃথা যায়নি। তাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।

(চলবে)

মুক্তিযুদ্ধের ওপর আপনার গল্প চাই
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের বিনিময়ে আমাদের এই বাংলাদেশ। এই দীর্ঘ নয় মাসে কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কেউ পরোক্ষভাবে যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কেউ ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, আবার কেউ ঘটনাটি দূর থেকে দেখেছিলেন। কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে মা-বাবা বা কোনো নিকট আত্মীয়দের কাছেও শুনেছেন। যুদ্ধ নিয়ে মানুষের এই মৌখিক বিবরণ নিয়েই শুরু হয়েছে ধারাবাহিক লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্পমালা। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ের গল্পগুলোকে লিপিবদ্ধ করা। আপনার কাছে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো গল্প যদি থাকে তাহলে সেই গল্পটি আপনিও পাঠিয়ে দিতে পারেন এই ঠিকানায়: [email protected]
গল্পের সঙ্গে আপনার নাম, ঘটনার তারিখ, স্থান এবং সম্ভব হলে সময় দিতে ভুলবেন না। আপনাদের গল্পের অপেক্ষায় থাকব।
আদনান সৈয়দ