সন্তানকে ভালোবাসুন

ক্যালিফোর্নিয়ায় বাংলাদেশি দম্পতি নিজ বাড়িতে খুন হয়েছেন জেনে মনটা বেশ বিষণ্ন হলো। কে, কেন খুন করল। এই হত্যার পেছনে কী কারণ?
একটি ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল দম্পতিকে দেখে মনটা আরও খারাপ লাগল। আরেকটি ছবিতে দুই পুত্রসহ দম্পতি। ছবি দেখে মনে হলো বেশ পরহেজগার। ধর্মপরায়ণ পিতামাতার পাশে আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরা ছেলেদের দেখলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত হৃদয়বিদারক খবর জানতে পারলাম সন্তানের হাতেই খুন হয়েছেন পিতামাতা।
আমরা যাঁরা প্রবাসে আছি তাদের মাঝে দুটো প্রবণতা লক্ষ করি। একদল বেশ আনন্দিত চিত্তে প্রবাসে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছেন। আরেক দল থাকেন প্রবাসে কিন্তু সারাক্ষণই দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো ছিল—এমন দোটানায় থাকেন।
প্রথম দল নিজেদের সন্তানদের বেশ নিশ্চিন্তে সব জায়গায় যেতে দেন। সন্তানরা পড়ালেখা করে ভালো ভালো জায়গায় জব করে। তাদের ইউএসএতে বাড়ি আছে। এখানে আমি সন্তান বললাম কারণ ছেলে বা মেয়ে কোনো তফাৎ তাঁরা করেন না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও করেন না।
আর দ্বিতীয় দল থাকেন আমেরিকায় ছেলেদের বাংলাদেশে মাদ্রাসায় রেখে পড়ান। মেয়েদের ইসলামিক স্কুলে পাঠান। সারাক্ষণ কঠিন শাসনে রাখেন। হিজাব পরে পাবলিক স্কুলে যেতে বাধ্য করেন। এই মেয়েরা বাসা থেকে হিজাব পরে বের হয়ে বাসে বা ট্রেনে স্কুলে যায়। স্কুলে ঢুকেই হিজাব খুলে ফেলে। আবার বাড়ি ফেরার সময় হিজাব পরে ঘরে ফেরে। আর এই হিজাব পরা মেয়েদের আমি নিজে দেখেছি সাবওয়ে বা ট্রেনে কিংবা বাসের পেছনে প্রেমিকের বাহুবন্ধনে লুটিয়ে পড়তে। আমি দ্বিধাহীনভাবে বলব আমি দেখেছি সেই ছেলেদের কিছুটা লজ্জিত হতে। কিন্তু মেয়েগুলোই নির্লজ্জ।
এখানে মূল কথা হলো পোশাক বা আবরণ দিয়ে কিন্তু কলুষিত মনকে ঢাকা যায় না। আমরা যেখানেই থাকি না কেন সন্তান সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে কি না সেটা দেখা খুব জরুরি। কী করা উচিত আর কী অনুচিত তা বুঝতে হবে অন্তর থেকে। ধারণ করতে হবে হৃদয়ে, সত্তায়। লোকদেখানো পোশাক পরে নিজের ক্ষতি ছাড়া লাভ কই? মনের কলুষতা হিজাবে ঢাকা যায় না।
একজন সফল বাংলাদেশি বাবা-মা। তাঁদের তিন মেয়ে। তিনজনই মেধাবী। বড়মেয়ে ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে বিশাল বড় কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। ইতিমধ্যে মাস্টার্স করে আরও উচ্চপদে কাজ করছে। বছরে তিন মাস ইউরোপ ট্যুর করে। দ্বিতীয় মেয়েও প্রিমেড ও অ্যাকাউন্টিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে পিএইচডি করছে। বাবা ট্যাক্স ফাইল লইয়ার তাই ট্যাক্স ফাইলের সময় বাবাকে সাহায্য করতে আসে। ছোট মেয়েটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এরা শোভন পোশাকই পরে। বাঙালি আচার-আচরণে যেমন পারদর্শী তেমনি তুখোড় ইংরেজি বলে। শাড়ি সালোয়ার কামিজ পরে বাঙালি ঘরানার অনুষ্ঠানে আসে। আমাদের দেখলে সালাম দেয়। ছোট মেয়েটি স্কুলে পড়াকালীন কতবার আমাদের নানা খাবার বানিয়ে আপ্যায়ন করেছে। নিজের হাত খরচ চালানোর জন্য টিউটরিং করত একটা আফটার স্কুল কোচিং সেন্টারে। এই পিতামাতার সুখী চেহারা দেখেছি।
আরেক পরিবারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে আমেরিকায় প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। সময় সুযোগ মতো পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যায়। বাকি দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবা মাও সুখী।
পক্ষান্তরে আরেক পিতা-মাতাকে দেখেছি মেয়েটিকে এক বছর অনলাইনে মাদ্রাসা শিক্ষায় পড়াতে। মেয়ের তীব্র অসন্তোষে এক বছর পর আবার পাবলিক স্কুলে পাঠাতে। বাড়িতেও কড়া শাসনে রাখতে। ফলাফলে খেয়াল করতাম মেয়েটি বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করত আর মায়ের প্রতিটি কথায় অবাধ্য ছিল।
বাংলাদেশি পরিবার শুধু না, এই চিত্র ভারত আর পাকিস্তানেরও। পাকিস্তানিরা তাদের স্ত্রীদেরও বিশ্বাস করে না। তাই স্ত্রী পরিবার দেশে পাঠিয়ে বছরে একবার যায়। কিছুদিন আগে পাকিস্তানি এক টিনএজ ছেলে তার বাবাকে হত্যা করে। সেই বাবাও কট্টর ছিলেন। আদর ভালোবাসার পরিবর্তে কঠোর শাসনে সন্তানদের মানুষ করতে চেয়েছিলেন। বন্ধুদের বাবাদের ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক দেখে ক্ষোভের পাহাড় জন্মেছিল। তারপর একদিন সেই চরম সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল।
ভারতের এক শিখ রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে তার মেয়েকে চড় মেরেছিল। সেই মেয়ে নাইন ডাবল ওয়ানে কল করে। পুলিশ শিখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ফিরে এসে শিখ সাহেব পুরা পরিবারকে দেশে রেখে আসেন। আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়েই যদি বলি তাহলে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখনকার পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশ কি এক? ঐশী নামের মেয়েটি তার পুলিশ কর্মকর্তা বাবা আর মাকে হত্যা করেছিল নিজ হাতে।
তাহলে যাঁরা আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন তাঁরা চান তাদের সন্তান ভালোভাবে লেখাপড়া করুক। হার্বার্ড, কলাম্বিয়ায় পড়ুক। নাসা, আ্যপল, গুগলে কাজ করুক। জোব্বা আলখাল্লা পড়ে ক্লাসরুমে যাক। বাবা-মায়ের সঙ্গে সারাক্ষণই সময় কাটাক। তাহলে ভুল হবে। হিজাব বা আলখাল্লা যদি স্বেচ্ছায় পরে। তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু হিজাব বা আলখাল্লা জোর করে পরতে বাধ্য করলে পরিণাম খারাপ ছাড়া ভালো হয় না।
মনস্তাত্ত্বিক দিকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সন্তান মানুষ করার জন্য বেত রাখতেন। স্কুলশিক্ষকরাও বেত ব্যবহার করতেন ছাত্র পিটিয়ে গাধা থেকে মানোন্নত করতে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ এগিয়ে চলেছে। এখন ঘরে-বাইরে শাসন পরিত্যাজ্য। বাবা-মা সন্তানকে ভালোবাসা আদর দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন। বাবা শাসন করলে মা বুঝিয়ে দেবেন। শিক্ষকও হবেন মায়াপূর্ণ। সন্তান ভুলপথে যাচ্ছে বুঝতে পারলে তার সঙ্গে বসেন খোলামেলা আলোচনা করেন। কোথায় ভুল হচ্ছে বুঝিয়ে দেন। নিজেরা না পারলে শিক্ষকের সহায়তা নেন। ইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংও করাতে পারেন। বাবা মাকে নিজেদের ইগো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সন্তান আমাদের ভালোবাসার ধন। সন্তানের হাতে কোনো মৃত্যুই আর যেন দেখতে হয় না।
কাহলিল জিবরানের কবিতা থেকে
বলছি..
Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.
They come through you but not from you,
And though they are with you yet they belong not to you.

You may give them your love but not your thoughts,
For they have their own thoughts.
You may house their bodies but not their souls,
For their souls dwell in the house of tomorrow,
which you cannot visit, not even in your dreams.
You may strive to be like them,
but seek not to make them like you.
For life goes not backward nor tarries with yesterday.
You are the bows from which your children
as living arrows are sent forth.
The archer sees the mark upon the path of the infinite,
and He bends you with His might
that His arrows may go swift and far.
Let your bending in the archer’s hand be for gladness;
For even as He loves the arrow that flies,
so He loves also the bow that is stable.