আত্মহত্যা নয়, বাঁচুন নিজের মতো

অধিকাংশ আত্মহত্যাকারী মানসিক নির্যাতনের শিকার। দীর্ঘদিন সবার অগোচরে মানসিক নির্যাতনের চাবুক সহ্য করতে করতে যখন স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়, তখন তার কাছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হয়। আর তখনই ওই ব্যক্তি পা বাড়ায় আত্মহত্যার দিকে। একদিনের ঘটনায় কেউ আত্মহত্যা করে না। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে জমে থাকা পাহাড়সম অভিমান জমা হতে হতে এক সময় ভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ; মরে যাই সে-ই ভালো।
ভিন্ন ভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। কেউ প্রেমে, কেউ পরকীয়ায়, কেউ বেকারত্বে, কেউ বা প্রতিষ্ঠিত হতে না পেরে। আবার কেউ ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। কারণের ধরন যেমনই হোক, মূল বিষয় এখানে হতাশা ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়া। কিছুদিন আগে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেন; কারণ তাঁর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল তাঁরই শিক্ষকদের কারণে। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও শুধু রাজনীতির শিকার হয়ে শিক্ষক হতে পারেননি তিনি। বিষয়টা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই কষ্টে ও হতাশায় আত্মহত্যা করেন। প্রশ্ন হচ্ছে তাঁকে শিক্ষক হতেই হবে কেন? জীবনে সব স্বপ্ন পূরণ হবে এমন তো নয়। তিনি চাইলে বিদেশে যেতে পারতেন। আসলে তাঁর ভাবনাটা একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ওই বৃত্ত থেকে তিনি বের হতে পারেননি।
আমরা অরিত্রীর কথা জানি; ভিকারুননিসা স্কুলের এই ছাত্রী শিক্ষক দ্বারা বাবা-মায়ের অপমান মেনে নিতে পারেনি। তাই আত্মহত্যা করেছে। শিক্ষকেরা কী এমন অপমান করেছিলেন, যে আত্মহত্যা করতে হবে? আর স্কুল তো একটা নয়। হ্যাঁ, কিছু বছর হয়তো নষ্ট হতো তার; কটুকথা শুনতে হতো আত্মীয়-প্রতিবেশীদের; এই তো। অনেক দিন আগে মডেল জ্যাকুলিন মিথিলা আত্মহত্যা করেছিলেন। মডেল ও অভিনেত্রী রিসিলা আত্মহত্যা করেছিলেন। আত্মহত্যা করেছিলেন দেশের অন্যতম সংগীত পরিচালক মাইলস ব্যান্ডের কি-বোর্ডিস্ট মানাম আহমেদের বড় ছেলে জাহিন আহমেদও। জাহিন নিজেও এই প্রজন্মের অন্যতম ব্যান্ড ম্যাকানিক্স ছিলেন। দুদিন আগে মোস্তফা মোরশেদ আকাশ নামের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। আকাশ আত্মহত্যা করেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ এনে। এমন প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যাবে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও অনেকে আত্মহত্যা করে।
শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ এমন কেন করে? তারা এত সহজে হতাশ হবে কেন? আসলে বিষয়টা নির্ভর করে মানসিকতার ওপর; শিক্ষার ওপর নয়। সবাই আঘাত বা কষ্ট সহজে মেনে নিতে পারে না। যাদের মনের জোর বেশি, তারা সহজে মানিয়ে নেয়। যারা মানসিকভাবে দুর্বল, তারা তা পারে না।
আকাশ মেধাবী ছিলেন। মেধা কখনো ফেলনা না; কোনো না কোনোভাবে তা কাজে লাগে। কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তিটাই মরে গিয়েছিল। আর বেঁচে থাকার এই ইচ্ছাশক্তিটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার মতো জীবনে কেউ এত কষ্ট পায়নি। এই যে এমনটা ভাবছেন, এটাই আপনার ভুল। সব মানুষ কষ্ট পায়, দুঃখ পায়। সেই কষ্ট লুকিয়ে রাখে মনের গভীরে। আপনি তার কষ্ট-দুঃখ দেখছেন না বলেই আপনার মনে হচ্ছে আপনি পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখী। আসলে এমন কোনো মানুষ নেই, যে কষ্টের যন্ত্রণায় জীবন বয়ে বেড়ায়নি।
আমি বলি, জীবনের অঙ্ক জটিল নয়। সরল করে ভাবুন। আপনি জটিল ভাবলেই জটিল। সহজ করে ভাবুন, দেখবেন সহজ। জীবনে এমন সময় আসবে, আপনি যা ভাবেননি হয়তো তা-ই ঘটবে। দেখা যাবে যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছেন, সেই আপনার বুকে ছুরি মারছে। আপনি হয়তো কল্পনাও করেননি এমন পরিস্থিতির। স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আপনার তখন মনে হতেই পারে যে জীবন অর্থহীন। কী লাভ এ জীবন রেখে? কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনি মরে গেলেই কি কোনো কিছুর পরিবর্তন হবে? হবে না। জীবনের প্রতি এই যে আপনার হতাশা তা ঝেড়ে ফেলুন। আপনি আপনার আশপাশে দেখুন, এর চেয়ে চরম দুঃখ-কষ্ট-হতাশা নিয়ে অন্যরা কী সুন্দর জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। তাহলে আপনি পারবেন না কেন? এই প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করুন।
দেখা গেল যাকে আপনি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন, সে-ই আপনার চরম ক্ষতি করল। আপনি ওপরে উঠতে চাইলেন, সে পেছন থেকে টেনে ধরল। আপনার কাছের মানুষেরা আপনার ভুল ধরবে, হিংসা করবে, তাতে কি? জীবন আপনার। আপনি আপনার মতো চলবেন। অন্যের কথায় আসলে কিছুই যায়-আসে না। জীবনের মানে লড়াই করে বাঁচতে শেখা। এই যে জীবন, এটা তো আর ফিরে আসবে না? তাহলে কেন বাঁচবেন না? দুঃখ-হতাশা-বঞ্চনার কারণে? এমন মানুষ কি আছে, যার জীবনের পথটা খুব সহজ? না নেই। তাই কেউ ঠকালে, বঞ্চনা করলে হতাশা নয় বরং ঘুরে দাঁড়ান। কষ্ট পেলে সেই কষ্টকে পুঁজি করেই লড়াই করুন। এ লড়াই করতে হয় নিজেকেই। জীবন আপনার, কাজেই লড়াই অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে না।
আজকাল আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। সামাজিকতা, পারিপার্শ্বিকতা, অর্থবিত্ত, প্রেম, যশ—ইত্যাদির পেছনে ছুটছে মানুষ। চাই, চাই শুধু চাই। আর এগুলো ধরতে গিয়ে মানুষ তার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলছে আনন্দগুলো; সুখ গুলো। জীবনকে উপভোগের জন্য খ্যাতি-বিত্ত নয়, বরং আনন্দের যে পথটা, সেটা জানা দরকার। সেই পথ জানা থাকলে আপনাকে আর আত্মহত্যা করতে হবে না। শুধু ভাবতে হবে এই জীবন আমার; সুখ-আনন্দ এইগুলো আমার। আমি আমার মতো থাকব, আমার মতো ভাবব; অন্যরা যা খুশি ভাবুক।
আপনি ভাবছেন আপনার মত দুঃখী-নিঃস্ব বুঝি আর কেউ নেই। একবার ভাবুন সেই সব মানুষদের কথা, যারা হাসপাতালে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? একবার হাসপাতালে আইসিইউতে ঘুরে আসুন, দেখবেন আপনার কষ্টগুলো তুচ্ছ মনে হবে। ভাবুন যারা অন্ধ, পৃথিবীর কোনো আলো দেখতে পায় না, অথচ মনের আলো দিয়ে, শক্তি দিয়ে কীভাবে নানা চেষ্টা করছে দেখার, বেঁচে থাকার। যে মেয়েটা প্রতিদিন পুরুষের হাত বদল হয়, সেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। জীবনযুদ্ধে লড়াই করার তার সে কী চেষ্টা। মানুষের ধিক্কার, অপমান সহ্য করে তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে। বেঁচে আছে। কারণ তার কাছে বেঁচে থাকার মতো সুন্দর আর কিছু নেই। একজন বেকার চাকরির জন্য নিঃস্ব হয়ে ঘুরে ঘুরে স্বপ্নগুলো হারিয়ে ফেলে হতাশায় ডুবে যায়, সেও কিন্তু একসময় ঘুরে দাঁড়ায়। জীবন হলো ‘ওয়ান ওয়ে রোডে’র মতো। সামনে শুধু এগোনো যায়; পেছন ফেরা যায় না। আর এই সামনে চলতে গিয়ে কষ্ট পাবেন, দুঃখ পাবেন, অনেক মানুষ জীবনে আসবে, আবার অনেকে চলে যাবে। আর জীবনে সব কাজে সফল হবেন—এমন কোনো কথা নেই। তাতে কি! এই জীবনে অনেক অনেক কাজ আছে। আপনি চাইলেই আপনার স্বপ্নগুলো সাজাতে পারেন। একবার ভেঙে যাবে, আবার স্বপ্ন দেখবেন, আবার ভাঙবে, আবার দেখবেন। দেখবেন একসময় ঠিকই সফল হয়েছেন। কেউ আপনাকে ছুড়ে ফেলে দিলে সেখান থেকেই আবার উঠে দাঁড়ান। প্রতিবেশীরা ধিক্কার দেবে? সমাজ ধিক্কার দেবে? ফিরে তাকাবেন না। সমাজ যা বলার বলুক।
জীবনে চলার পথে আত্মবিশ্বাস খুব দরকার। আপনি মরে গেলে দুদিন মানুষ আফসোস করবে; তারপর ভুলে যাবে। অথচ আপনি যদি সমাজের বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন, তবে এই সমাজ, এই মানুষগুলোই মনে রাখবে আপনাকে।