দিয়েছে যা, নিয়েছে তারও বেশি

মানুষটা মূক বধির ছিল জন্মের পর থেকেই। বসন্তের কোকিল কখনোই তার কানে কানে গুনগুন করেনি। অভাগা পৃথিবী কখনো শোনেনি তার কণ্ঠে উচ্চারিত দুটো কবিতার লাইন কিংবা তারও বেশি কিছু। তবু তিনি ছিলেন নীরবে, একান্ত সঙ্গোপনে।
তিনি গতরাতে চলে গেলেন। পৃথিবীর প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না তাঁর। যেতে যেতে হয়তো আশীর্বাদ করে গেছেন আমার বাবা, আমার ভাইদের, সন্তান ও পরিবারকে। কেননা তারাই ছিলেন ফুপুর সব আবদার।
আমি হতভাগী, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশে উন্নতির শিখরে বাস করি। আমি তার সেবা করার সুযোগ পাইনি। শেষ যাত্রায় একই জঠরে জন্ম নেওয়া আমার বাবার বোনকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। আমার বধির ফুপু চলে গেলেন চিরতরে।
দেশ ছাড়ার পর পরিবার থেকে একে একে কতজন গেল! আমাকে না দেখেই গেল। এ কথা কয়জন জানে? এই যে ওপরে পরিপাটি আমি, কোট-জিনস পরিহিত এক দুর্দান্ত স্বাবলম্বী নারী। কয়জন জানে আমার ভেতর দিনরাত কেমন পুড়ে?
তখন সবে আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েছি। এক বছর পর দাদিমা মারা গেলেন। তখন আমাদের বাড়িতে দুটো হোম ফোন কেবল। ফোন দুটোই আব্বুর ঘরে। সেল ফোনের ব্যবহার তখন আমাদের শহরে তেমন ছিল না। আব্বুর সেল ফোন থাকলেও বাড়ির আর কারও ছিল না। মৃত্যুর আগে কোলে করে কে যেন দাদিমাকে নিয়ে এলেন আব্বুর ঘরে। শেষ কথা হলো। জানতে চাইলেন, তাকে দেখতে কবে দেশে যাব! তখন আমি ছিলাম আনাড়ি অবলা এক কিশোরী। চাকরি ছিল না। দাদিমা চলে গেলেন তার মাস খানিক পর। আমি দেখলাম না।
বছর খানিক পর হুট করে চলে গেল বড় ভাই সাব্বির। বয়স ছিল তার ২৫ বছর। যাওয়ার আগে একদিন ফোনে বলল, ‘বোনরে! আমার শুধু ঘাম হয়, স্বাস্থ্যটা বেড়ে গেছে। একটা ওষুধ পাঠা স্বাস্থ্য কমানোর। তোদের আমেরিকা শুনেছি কত কী পাওয়া যায়!’ আমি বললাম, পাঠাব। এর এক মাস পর সে স্টোক করল, পাড়ি জমাল পরপারে। আমার আমেরিকার অলৌকিক ওষুধ আর পাঠানো হল না। কেঁদে কেঁদে অস্থির হলাম। ভাইকে দেখা হল না।
তারপর গেল আমার বাবা। এক কিশোর সন্তানকে তার কবেই মেরে ফেলা হয়েছিল। আরেক যুবক সন্তান তার ৫ বছর পর চলে গেল। বাবা ছিলেন পাহাড়ের মতো অটল, কঠিন এক মানুষ। সন্তানদের হারিয়ে তিনি ঘোলাটে নদীর জলের মতোই তরতর করে বয়ে যেতে লাগলেন। একদিন তিনি ‌সুস্থ্য হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। আমি গেলাম বাবাকে দেখতে। ১৯ দিনের যাত্রা কেবল। ১৮ দিন তাঁর সঙ্গে কাটালাম। পাশে বসে, গা চুলকে দিয়ে, কখনো হাত ধরে ধরে হাঁটিয়ে। আমেরিকার ডাকে একদিন চলে এলাম। তিন মাস পর বাবাও চলে গেলেন। কি যে চিৎকার করলাম! আমেরিকার দায়বদ্ধতা আমাকে যেতে দিল না। বাবাকে শেষবার না দেখার যন্ত্রণা আমেরিকা কি বোঝে?
তারপর এল নানিমার পালা। তিনি মারা গেলেন। পরপর নানাভাই মারা গেলেন। তাদের কোলে কত স্মৃতি! স্মৃতি হয়েই বুকে বিঁধে রইল। দেখা হল না। আমার মা তখন আমাকে সাহায্য করতে আমেরিকা। তিনিও যেতে পারলেন না আমাকে একা রেখে। তিনি যখন আজ নিজ জন্মদাত্রী মাকে শেষবার না দেখার বেদনায় ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারি কি আমি?
কেমন করে ক্ষমা করি!
এখানেই শেষ নয়! আরও আছে! তার কিছুদিন পর হারালাম সবার ছোট যুবক ভাইটিকে। নাম মো. আলী। কী ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মতো যে মনে হল! নয়জন ভাই বোনকে রেখে সবার ছোটটা চলে গেল। তখন আমি নিজ পায়ে বেশ শক্তভাবেই দাঁড়িয়ে। তবু আমেরিকা আমাকে যেতে দিল না। জীবনের কাছে, দায়িত্বের কাছে দায়বদ্ধতা আমায় জড়িয়ে রাখল। ভাইটি চলে গেল হুট করে। শেষবার দেখা হল না। প্রায়ই মাঝ রাতে আঁতকে উঠি। মনে হয় ভাইটি আমার বলছে, ‘আমার পিঠ ডলে গোসল করিয়ে দাও।’ মনে পড়ে, যখন দেশে যেতাম সে প্রায়ই দুষ্টুমি করে বলত, ‘একটা বান্দর হেছরাইতে হেছরাইতে গাছে উঠতাসে’ এটার ইংলিশ করেন তো আপা! কত স্মৃতিমাখা সকাল দুপুর সন্ধ্যা কেটেছে তার সঙ্গে! কত দুষ্টুমি খুনসুটি মারামারি! আজ যখন বুকের ভেতর পাড় ভাঙে, ঠক ঠক হাতুড়ির শব্দে দিন রাত কি যেন ভেঙে পড়ে, তখন কাকে বলি? কে দেখে এ যাতনা?
সবশেষে গেল ফুপু এই মাসেই। হয়তো এই শেষ না। আরও অনেকেই যাবে। কাউকেই দেখা হবে না।
আহা! আমেরিকা! কত কী পেলাম আমেরিকা তোমার বদান্যতায়। প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি, সাফল্য, ঘড়ির কাটা ধরে নিশ্চিত জীবন। আরও কত কী! আমি কি অভিযোগ করতে পারি?
আমেরিকা! তুমি আমায় বহু কিছু দিয়েছ। আবার নিয়েছোও তার ‌অধিক।