সংকট: আমেরিকার পেছনের বারান্দায়

ফেসবুকে ধরা খেলাম নিজের অজান্তে। এই অঙ্গনে আগে কখনো সক্রিয় ছিলাম না। দু’তিন মাস হলো একটু-আধটু ঘোরাঘুরি করি। প্রথম হোঁচট খেলাম বন্ধুত্ব নিয়ে। দেখি, শত শত নাম বন্ধু হওয়ার অপেক্ষায়। ইব্রাহিম চৌধুরী খোকনের কাছে জানতে চাইলাম, আমার করণীয় কী? খোকনের উত্তর, খুব সিম্পল, ‘অ্যাড’ করুন। ‘পুশ’ করে বন্ধুত্ব বাড়ান। তাই করতে থাকলাম। প্রথম সতর্ক বার্তা এল আমার স্ত্রীর কাছ থেকে। —একি করছ তুমি? আবর্জনায় যে ভরে যাচ্ছে তোমার অ্যাকাউন্ট, সে খেয়াল আছে? এভাবে চললে আমার অ্যাকাউন্ট আলাদা করতে হবে।
কেন, কী করেছি?
তখন জানলাম, এ ক’দিনে আমার বন্ধুর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিরতিহীন টিপে গেছি, এ দিকে বানের জলে শুধুতো মাছ আসে না, বিচ্ছু- কাঁকড়াও আসে। তাই হয়েছে। এখন কী করা? এক, বন্ধুত্বের লাগাম টেনে ধরা, দুই, যে বা যারা আবর্জনা ছড়ায়, তাকে বা তাদেরকে ‘আনফ্রেন্ড’ করে দেওয়া। উত্তম সমাধান।
দ্বিতীয় সমস্যা, ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি। প্রথম আলোর বৃহস্পতিবারের আড্ডায় কয়েক বার ধরা খেয়েছি ফেসবুকের রেফারেন্সে খবর পরিবেশন করে। এর কী প্রতিকার। আহমাদ মাযহার একটা পথ বাতলে দিলেন, প্রথমে দেখবেন খবরের উৎস কী। কে এটি পরিবেশন করেছে। হ্যাঁ, এ ওষুধ অনেক কাজে এসেছে।
আজ ( ৩১ জানুয়ারি) ঘুম থেকে উঠে আবহাওয়ার খবর জানার জন্য মুঠোফোন হাতে নিয়ে বিভিন্ন সাইটে যাচ্ছি। এ সময় ফেসবুকে একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। মন্তব্যসহ এটি পোস্ট করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আশীর্বাদ করছেন খালেদা জিয়াকে, পাশে বসা শেখ হাসিনা। দুষ্প্রাপ্য, ঐতিহাসিক ছবি। ভাবলাম, এ ছবি সংগ্রহে রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার করলাম। এরপর আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। অসময়ে ঘুমের কারণ, আমার ওষুধ। দু’তিন ঘণ্টা পর ঘুম থেকে উঠে দেখি এ ছবি নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শুরু করেছেন লন্ডন থেকে রেনু লুৎফা, সর্বশেষ আটলান্টা থেকে বশির আহমদ পোস্ট করেছেন অনেকগুলো ব্যঙ্গ বা কৌতুক ছবি। ভুলটা কোথায়? ছবিতে যাকে খালেদা জিয়া বলা হচ্ছে, তিনি খালেদা জিয়া নন, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ তাইতো। আমি দুঃখিত, লজ্জিত, নিজেকে নিজে ধিক্কার দিলাম। বুঝলাম, শত ভাগ নিশ্চিত না হয়ে আর কোনো শেয়ারও করা যাবে না। তবে মনের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই গেল, যিনি ছবিটা পোস্ট করেছেন, তিনি সত্য কথাটা অর্থাৎ ‘ বঙ্গবন্ধু তাঁর পুত্রবধূ সুলতানা কামালকে আশীর্বাদ করছেন’ লিখে পোস্ট দিলে কি ছবির গুরুত্ব কমে যেত? মোটেই না। এ ছবিতো ঐতিহাসিক।
এবার ইচ্ছে ছিল ভেনেজুয়েলা নিয়ে কিছু লিখি, কিন্তু ফেসবুক বিড়ম্বনায় শুরুতে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। আর ভেনেজুয়েলার ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে, আপ টু ডেট থাকতে হিমশিম খেতে হয়।
মনে পড়ে হুগো শাভেজের কথা। মাদুরোর পূর্বসুরী হুগো শাভেজ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘে এসেছেন। নির্ধারিত সময়ে উঠেছেন পোডিয়ামে। হয়তো কাকতালীয় ছিল, কিছুক্ষণ আগে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। শাভেজ দাঁড়িয়েই প্রার্থনার ভঙ্গিতে ক্রস এঁকে বললেন, ‘একটু আগে এখানে এক শয়তান এসেছিল। নাক সিটকে আরও বললেন, এ জায়গাটি এখনো অপবিত্র দুর্গন্ধময় হয়ে আছে।’
যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সম্পর্কের তিক্ততা কত গভীর এ ঘটনা থেকেই তার আভাস পাওয়া যায়। পার্লামেন্টের স্পিকার গুয়াইদো নিজেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইসরায়েলসহ পশ্চিমা কিছু দেশ। এ দিকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া, চীন, কিউবা, বলিভিয়াসহ কয়েকটি দেশ। দ্বিধাবিভক্ত ভেনেজুয়েলা। অবশ্য দেশের শক্তিশালী মিলিটারি মাদুরোর সমর্থনে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোকে হটানোর জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়ে রেখেছে। আর রাশিয়া এর বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রকে সাবধান করেছে।
মাস দু’এক আগের কথা। সিএনএনের এক রিপোর্ট দেখে তখনই অনুমান করেছিলাম, ভেনেজুয়েলা সংকট ঘনিয়ে আসছে। ওই রিপোর্টটি ছিল, পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম দু’টি অত্যাধুনিক রাশিয়ান যুদ্ধ বিমানের ভেনেজুয়েলা আগমন। বিমানের ক্রুদের উষ্ণ সংবর্ধনা জানাচ্ছেন ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী।
আমেরিকার পেছনের বারান্দায় রাশিয়ান পরমাণু বিমান? আমেরিকা কি সহজে মেনে নিবে?
না মানারই কথা।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল বাষট্টি সালের কিউবা সংকটের কথা। আমেরিকার সীমান্তের কাছে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল মোতায়েনকে কেন্দ্র করে পৃথিবী পরমাণু যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি দেখে শিউরে উঠেছিলাম। এই বুঝি নিউক্লিয়ার বাটনে চাপ পড়ল। রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তগুলো। তখনই কেনেডি-ক্রুশ্চেভের সমঝোতায় পৃথিবী রক্ষা পেল ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধ থেকে। কিউবা থেকে সোভিয়েত মিসাইল সরিয়ে নিলে সমাধান হয় সে সংকটের।
এবারের সংকট সে ধরনের কিছু? জানি না। তবে ভেনেজুয়েলায় রাশিয়ার উপস্থিতি আমেরিকা যে সহজে হজম করবে এটা মনে করলে ভুল হবে।
আমি মাদুরো বা গুয়াইদো, কোনো পক্ষের নয়। তবে একটি পক্ষের, সে পক্ষ ভেনেজুয়েলা। আর পক্ষ আন্তর্জাতিক রীতিনীতির।
ভেনেজুয়েলার বহু খবরের মাঝে দু’টি খবর আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে। এর একটি হচ্ছে, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে গচ্ছিত ভেনেজুয়েলার ১২০ বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ মাদুরো সরকারকে দেবে না ব্যাংকটি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কারাকাস থেকে রাশিয়ান বিমানে করে ২০ টন ভেনেজুয়েলার সোনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য রাশিয়া অস্বীকার করেছে, তারা কোনো সোনা নেয়নি। কিন্তু ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানিয়েছে বলে চোখে পড়েনি। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বা ব্রিটেনের ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বহু দেশের সোনা-দানা, টাকা-কড়ি গচ্ছিত আছে। এখন প্রশ্ন, এ গুলো কি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অর্থাৎ সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত? এটা কি নৈতিক? আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বরখেলাপ কি নয়? যদি তাই হয়, বলা কী অন্যায় হবে ‘জোর যার মুল্লুক তার ‘?
এ লেখার সময় সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের কথা বার বার মনে পড়ছিল। তিনি বলছিলেন, ‘ রেজিম চ্যাঞ্জ’ আমাদের কাজ নয়। ইরাক ও লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্দশা দুর্গতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার উচিত হবে এ নীতি থেকে সরে আসা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প, বুশ-ওবামার নীতিই অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। তবে তার নীতিতে ধোয়াঁশা সৃষ্টি হয় যখন দেখা যায় সিরিয়া ও আফগানিস্থান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। আবার যখন ভেনেজুয়েলা প্রসঙ্গে বলেন, কোনো কিছুই ‘অফ দ্য টেবিল ‘ নয়। এ ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে স্বচ্ছ কিছু জানা বা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করা যেতে পারে?

লেখক নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক