আধুনিক দাওয়াত সংস্কৃতি

গ্রামে আমার জন্ম এবং শৈশব-কৈশোরের বেশির ভাগ সময় গ্রামেই কেটেছে। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠাটাকে আমি প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে পরিণত বয়সে পৌঁছানোর একটা বড় সুযোগ হিসেবেই দেখি। গ্রামীণ সংস্কৃতি, প্রকৃতির লালন, ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথা, ক্ষুদ্র স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিবাদ, সালিশি সমাধান, ক্ষুদ্র চিন্তা, অপার আনন্দ, বাধাহীন বিচরণ, সীমাহীন আবেগ, পরিশ্রমী উদ্যোগ, গ্রাম্য আড্ডা-খেলাধুলা, কাদামাটির গন্ধ, হাটবাজারের কোলাহল, সূর্যের খেয়ালে দৈনন্দিন ব্যস্ততা, এই সবকিছুর মধ্যেই যুক্ত থাকে প্রতিবেশীদের একে অন্যের প্রতি অভিমানী কিছু ভালোবাসা ও সরল আন্তরিকতা।
ছোটবেলায় কোনো বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে ফিরে আসতাম আজীবন মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি নিয়ে। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান পাত্র বা কনে পক্ষের নিজ বাড়িতেই হতো। কালের বিবর্তনে আজকাল বিত্তবান ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কমিউনিটি সেন্টার, পার্টি সেন্টার, হোটেল বা রেস্তোরাঁর ওপর নির্ভরশীল। এর সঙ্গে এখন আবার চালু হয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ওয়েডিং প্ল্যানার, ভিডিওগ্রাফার, ফটোগ্রাফারসহ এক জগাখিচুড়ি বিনোদনের আয়োজন।
কোনো বিয়ের দাওয়াতে গেলে এখনো আমার মানসিক প্রস্তুতি ও প্রত্যাশাটা থাকে অনেকটা সেকেলে ধরনের। যদিও আমি অনুষ্ঠান বা আয়োজনে যাওয়ার তেমন একটা সুযোগ পাই না। আমার পরিকল্পনা থাকে অন্তত পুরোটা দিন আনন্দ ও সামাজিক হৃদ্যতা আদান-প্রদানের মধ্যেই কাটানোর। একটা নতুন জায়গা সম্পর্কে জানব, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হবে, নতুন আত্মীয়তাকে সহজ-সাবলীল করতে সবার সঙ্গে সখ্য করার চেষ্টা, সঙ্গে কিছুটা ঠাট্টা-তামাশা ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে তা খুব একটা হয়ে ওঠে না। এখন যেকোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের মূল ফোকাস থাকে (১) খাবার ও (২) ফটোসেশনে। অতিথিদের অধিকাংশই হাজির হন খাবার পর্বে, যা শেষ হলেই কেটে পড়ার একটা ব্যস্ততা থাকে তাঁদের। আবার অতিথিদের মধ্যেও থাকে একটা বিভাজন। কেউ সাধারণ অতিথি, কেউ কেউ আবার বিশেষ অতিথি! হাল আমলের আধুনিকতার নামে বর-কনের পরিবারের সবাই সেসব বিশেষ অতিথিদের নিয়ে ফটোসেশন ও ভিডিওগ্রাফিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাধারণ অতিথিদের কোনোমতে ভূরিভোজ করিয়ে দেওয়াটাই যেন দাওয়াতকারী পরিবারের একমাত্র দায়।
এই সাধারণ অতিথিদের দাওয়াত করার দরকারটা তাহলে কি? পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখাই তো মূল উদ্দেশ্য। শুধু দাওয়াত করে ভূরিভোজ করিয়ে দিলেই কি সম্পর্কের দাবি আদায় হয়? বর-কনের পরিবার এবং আমন্ত্রিত অতিথি উভয় পক্ষেরই তো কিছু কর্তব্য, কিছু দায়িত্ব থাকে। কিন্তু এ ধারায় আত্মীয়তা কিংবা সামাজিক সম্পর্কের কিছু লেনদেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে এমনও কিছু মানুষ থাকেন, যাদের নিজ পরিবারে মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা না থাকলেও শুধু সম্পর্কের দাবি মেটাতে, শুধু মান-ইজ্জত রক্ষার জন্য অনেক কষ্ট ভেতরে চেপে রেখেই আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে হাজিরা দেন। এমনও কেউ আছেন যারা ধার-কর্জ করে হলেও আপনাদের জন্য উপহার কিনে কিংবা সেলামির টাকা খামে ভরে এসেছেন সম্পর্কের দায় মেটাতে। সেই অতিথিদের সঙ্গে আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দঘন দিনে আপনার আচরণটা কী রকম হচ্ছে, তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? বিরক্তিকর অপেক্ষা আর ভূরিভোজ দিয়েই তাদের বিদায় দিচ্ছেন। পোশাক ও চেহারার সাজ দেখেই শ্রেণিভেদ করে দিচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে অমানবিক আচরণ। এসব আধুনিকতা নয়; সংকীর্ণতা-কপটতা।
আপনাদের নবজীবনের শুভ সূচনালগ্নে আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছ থেকে দোয়া/আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়ার সুযোগটা নষ্ট না করাটাই আপনাদের কর্তব্য। অন্যদিকে শত ব্যস্ততা কিংবা প্রতিকূলতার মাঝে যারা এসে উপস্থিত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আপনাদের সহাস্য কৃতজ্ঞতার বচনও তাঁদের প্রাপ্য অধিকার। আপনাদের খেয়ালি শখ ও অবিবেচক ইভেন্ট ম্যানেজারদের ভুল নির্দেশনায় কোনো অতিথিকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করবেন না। বিয়ের আনন্দের স্মৃতিটুকু শুধু আলোকচিত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টা না করে হৃদয়ের গভীরে সাজিয়ে রাখুন। লোক দেখানোর জন্য পাঁচ/সাত শ মানুষকে দাওয়াত দিয়ে কাঙালিভোজের আয়োজন না করে, ঠিক ততজন মানুষকে দাওয়াত করুন, যাদেরকে আপনি সম্মানটুকু দিতে পারবেন, যাদের হৃদয়ের উষ্ণতা আপনার হৃদয়কে প্রফুল্লিত করে। একবার হলেও, সিনেমাটিক ফটোসেশন ও কৃত্রিমতায় সাজানো মঞ্চ থেকে নেমে আসুন সাহস করে, সশরীরে সবার কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতাটুকু জানান, দেখবেন ভালো লাগছে। দূরে থাকুন অতিথিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে।
আমন্ত্রিত অতিথিদের ব্যাপারেও কিছু কথা এখানে না বললেই নয়। যারা শুধু ভূরিভোজ কিংবা ফটোসেশন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারকেই রেওয়াজ ধরে নিয়েছেন, তাদেরকে বলি, আপনারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন ঠিক কী উদ্দেশ্যে বর/কনে অথবা তাদের পরিবার আপনাকে দাওয়াত করেছেন? মূল উদ্দেশ্য কিন্তু সম্পর্কের দাবি মেটানো, আর পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখা। অপারগতা থাকাটা দোষের কিছু না; কিন্তু চালাকি অভ্যাসটাকে অপারগতা বলে চর্চা করাটা অন্যায় ও লজ্জাজনক। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আনন্দঘন অনুষ্ঠানে যখন কেউ আপনাকে দাওয়াত করেন, তখন আপনার কর্তব্যটুকু শুধু ভূরিভোজ ও ফটোসেশনে সীমাবদ্ধ করে আপন সত্তাকে কলঙ্কিত করবেন না। নিমন্ত্রণকর্তার প্রতি আপনারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে পরিবার আপনার সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে আপনাকে আমন্ত্রণ করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। নবদম্পতির কাছে যাওয়ায় চেষ্টা করুন, তাদের মঙ্গল কামনা করুন। অনুষ্ঠানের আয়োজক পরিবারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করুন, জানতে চান সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আপনার কোনো সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে কি না? প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অন্য অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করুন, চেনা-পরিচয় ও সম্পর্কের পরিধিটা বাড়ানোর চেষ্টা করুন। আপনার হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি দিয়ে নবদম্পতির স্মৃতিকে আলোকিত করার চেষ্টা করুন। আপনার মানবিক পরিচয় ও হৃদয়ের উষ্ণতাটুকু সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করেই ঘরে ফিরুন।
আমার শৈশবের স্মৃতিপট থেকে যতটুকু ভাসা-ভাসা আবেগ ফিরে ফিরে আসে, তাতে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির বিয়ে বাড়ির রীতি-রেওয়াজ অনেকটাই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল বলে মনে পড়ে। প্রতিটা সম্পর্কের লেনা-দেনা খুবই স্বচ্ছতা, উদারতা, আবেগ ও দায়িত্বশীল সহযোগিতায় পরিপূর্ণ ছিল। এখন সবখানেই স্টার প্লাস আধুনিকতার কবলে পড়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাড়া তো আমাদেরই দিতে হবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবক্ষয়গুলো দূরে ঠেলে ফিরিয়ে আনতে হবে ক্লেদহীন পরিবেশ, সহযোগী মনোভাব, মেটাতে হবে প্রতিটি সম্পর্কের পরিপূর্ণ দায়।