একুশের লড়াই চলমান

‘বাহন উপযুক্ত না হলে কেউ তার উপযুক্ত স্থানে পৌঁছাতে পারে না। লক্ষ্য লাভ করতে হলে সাহিত্যের বাহন উপযুক্ত হওয়া চাই, যে বাহন হবে মাতৃভাষা’— ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
সাতচল্লিশে র‌্যাডক্লিফ সাহেবের কালির আঁচড়ে বাংলার নতুন নাম হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই মাতৃভাষা বাংলার সংকটজনক পরিস্থিতি এসে গেল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পরেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে ঘিরে ঐতিহাসিক আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে এক চেতনার সূচনা। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ পরবর্তীকালে নিজস্ব ভূখণ্ডের মর্যাদা রক্ষার যে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছেন, তার সূচনা কিন্তু এই একুশেই। একুশ তাই প্রতিবাদের প্রেরণা।
পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই স্বপ্নের মোহভঙ্গ ঘটেছিল। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও মহিমান্বিত। সেই জাতীয় সত্তাকে অস্বীকার করে ধর্মীয় প্রাধান্যকে সাংস্কৃতিক রুচিশীল বাঙালি কখনই মেনে নিতে পারেনি। ফলে দেশভাগের এক বছরের মধ্যেই শুরু হলো মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার লড়াই।
একুশের বিদ্রোহ ভূগোল মেনে নিয়েছে, কিন্তু তাই বলে এই বিদ্রোহ নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। এই বিদ্রোহ আঞ্চলিক নয়-এই বিদ্রোহ গণতান্ত্রিক, এই বিদ্রোহ সমষ্টিগত ঐক্যের। এই বিদ্রোহ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধেও। ‘বাঙালি মুসলমান আগে মুসলমান এবং পরে নিতান্ত অনিচ্ছায় বাঙালি, যেহেতু তার মাতৃভাষা বাংলা হলেও মুসলমানি বাংলা’—এসব সামন্তবাদী পিছুটানের সামান্যতাকে সাহসের সঙ্গে ছিন্ন করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। একুশে ছিল বারূদের স্তূপে অগ্নিসংযোগ।
একুশের আন্দোলন শুধু শোকে ও আনন্দে শেষ হয়নি, তা পরিণত হয়েছে শপথে। তাই একুশের প্রাণ যেখানে ঐতিহ্য সেখানে-বিদ্রোহ শুধু প্রতিবাদ নয়, ইতিবাচক বিদ্রোহ–ই। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের বিদ্রোহ, অন্য সব দিনের চেয়ে তাই ঐতিহ্যগতভাবে আলাদা একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা নববর্ষের দিনটির চেয়েও স্বতন্ত্র একুশে-কারণ ওই বিদ্রোহ।
দীর্ঘকাল ধরেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর উপনিবেশ গড়ার যে লালসা ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে এবং বহু লড়াই সংগ্রামে স্বাধীন দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে যে সব দেশ, তাদের অন্তরে কিন্তু রয়ে গেছে অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সেই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের জোরালো স্বর। রবীন্দ্রনাথ তাই বহু আগেই তার আগমন প্রত্যক্ষ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কিত হয়ে বলোর চেষ্টা করেছিলেন, এক আইন এক প্রভু হলে স্বাধীনতার পক্ষে সংকট। খণ্ড খণ্ড দুর্বল করে যেকোনো দেশ ও জাতিকে গ্রাস আর অবাধ ভোগ করাটাই চরম লক্ষ্য। সেই আশঙ্কাই সত্য হয়েছিল।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের লজ্জাজনক ভরাডুবির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তান অংশটি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত টিকেছিল মূলত বন্দুকের নলের মুখে। বায়ান্ন থেকে সত্তরের নির্বাচন—এই আঠারো বছরের মধ্যে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে উদ্দীপনা ও সাহস সঞ্চারিত হয়েছিল তা ছিল বায়ান্নর একুশের অপরিমেয় এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
তাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ নির্ধারিত হয়েছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। শুরুতেই এই রাষ্ট্র তার সব নাগরিককে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করে। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এই অধিকার অবশ্য বিনষ্ট হতে শুরু করে। স্বাধীনতাবিরোধীরাও একসময় মন্ত্রী পদে আসীন হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি আজ মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত অবস্থাকে ইন্ধন দিয়ে চলেছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে মৌলবাদের প্রসার ঘটছে। সব প্রগতিশীল মানুষই চান, দেশে জামায়াতসহ সব ধর্মভিত্তিক উগ্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। অথচ স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলই জামায়াত ও মৌলবাদকে টিকিয়ে রেখেছে।
আজ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মতো সংকট প্রতিহত করতে, প্রতিরোধ করতে আবারও একুশের চেতনাকেই শাণিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন একুশের চেতনায় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়া, প্রোথিত করা। কারণ একুশের চেতনাই পারবে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে ঠেকাতে।
একুশের আন্দোলন সেদিন যাদের বিরুদ্ধে ছিল, আজও তাদেরই বিরুদ্ধে। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই, লড়াই ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার। একুশের আন্দোলন সংস্কারে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে সমাজবিপ্লবেই। একুশের দৃপ্ত পথে শ্রেণিচেতনার আলোকে সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই জারি থাকুক।