হুলিয়া

সেদিন প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস বইছিল। বাতাসের হু হু শব্দের তাণ্ডবে বোঝা গেল, ঝড়ের সাথে মুষলধারে বৃষ্টি আসবে। সফিকের সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা কিছুতেই দমন করতে পারছিলাম না। ভাবলাম ঝড়-বৃষ্টির রেশটা একটু কমলেই বেরিয়ে পড়ব। শুধু দমকা বাতাস, আর হালকা বৃষ্টি থাকলেও আপত্তি নেই। কারণ সফিকের ঘরটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। ওর ঘরের চালটা টিনের। বৃষ্টির দিনে সুন্দর ছন্দ কানে বাজে। আমি টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ শুনিনি অনেক বছর। তার বাসায় তক্তপোষটায় টানটান হয়ে শুয়ে চারদিকে দেখি অসংখ্য বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ঘরের কোণের টেবিলে গাদা করে রাখা। পাশের দেয়ালে ঝুলছে একটা ল্যান্ডস্কেপ। জলরং করা নীল আভা ছড়ানো একটা পড়ন্ত বিকেল। এক পাশে নদীর জলে নৌকাগুলো পিঠ ভাসিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার ভালো লাগে। ঝড়-বৃষ্টির দাপট একটু কমতেই একটা রিকশা ডেকে রওনা হলাম সফিকের বাসার উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে বিকেল গড়িয়েছে মাত্র। কিন্তু বৃষ্টির কারণে মনে হচ্ছে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে দেখা যায় রাস্তার পাশের ঘাসগুলো মাথা উঁচু করে বৃষ্টির পানিতে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মেঘে ঢাকা আকাশটা ক্রমশ নিচু হয়ে একটা বিশাল পর্দার আকার ধারণ করে জনবসতির ওপর ঝুলে আছে। এ সময় বৃষ্টি না হলে মৃদু সূর্যের আলোটা শহরতলির এ জায়গাটির সবুজ গাছগাছালির কোমল আলো ঢেলে পৃথিবীটাকে আদর করত। রিকশায় বসে কাক ভেজা হলেও আমার খুবই ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতে।
সফিকের বাসায় যখন পৌঁছলাম, তখন ঘর অন্ধকার। বৃষ্টি তখনো ঝরছে। সফিকের দরজার কড়া নেড়ে আমার আগমনের জানান দিলাম। কিন্তু দরজা খুলছে না। একবার-দুবার, তারপরও না। শেষে আমার নাম বলে কড়া নাড়তেই সফিক এসে দরজা খুলে ইশারায় ভেতরে যাওয়ার আহ্বান জানাল। কিন্তু এ কী? এ যেন আরেক সফিক আমার সামনে দাঁড়াল। সত্যি বলতে কি, আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তার এমন বিমর্ষতার কারণ জানতে চাইলে সে জানাল তার নামে হুলিয়া। তাই সে দারুণ আতঙ্কে আছে। তার সাথি, যারা বাম রাজনীতি করে, তাদের অনেকেই জেল-হাজতে আছে। তাই সে এখন গা ঢাকা দিয়ে চলছে। এতক্ষণ যে হালকা মন নিয়ে এসেছিলাম, তা যেন নিমেষেই ভারী হয়ে উঠল।
আমাদের আলাপচারিতার মধ্যেই ঝড়বৃষ্টির প্রাবল্য আরও বাড়তে লাগল। মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চলে গেল। হারিকেনের আলোটা কমিয়ে আমরা গল্প করছি। স্নিগ্ধ একটা জ্যোতি দিচ্ছে হারিকেনের আলোটা। সফিক আচমকা দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল জানালার পাশে। জানালার পাট ফাঁক করে বাইরে তাকিয়ে রইল সফিক। আমিও তার পিছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালাম। সফিক টের পেল, আমি ওর পেছনে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছ রাস্তার পাশের রেইনট্রি গাছে কারা যেন টর্চলাইট দিয়ে কিছু খুঁজছে।’ আমিও অবাক হয়ে দেখলাম সত্যিই কারা যেন গাছের ডালে ডালে টর্চলাইট দিয়ে কিছু খুঁজে চলেছে। কে যেন হঠাৎ আমার দৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। আমি নিজের অজান্তে চেপে ধরলাম সফিকের হাত। তারপর বললাম, ‘চলো দোস্ত আমরা এখান থেকে সরে পড়ি। এই মুহূর্তে তোমার বাসায় থাকাটা নিরাপদ নয়।’ তৎক্ষণাৎ আমরা দুজনে দুই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বড় রাস্তা না ধরে আমরা একটু ঘুরে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। তখনো বৃষ্টি যেন আকাশ ফুটো করে ঝরে পড়ছে। এ মুহূর্তে কোথায় যাওয়া যায়। দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম, রানার বাসায় যাব। কারণ, ওর বাবা সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় একজন। ওখানে অন্তত পুলিশ যাবে না।
হাঁটছিলাম দুজন। এত পাশাপাশি থেকেও আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে একে অন্যের ছাতায় সংঘর্ষ মনে করিয়ে দেয় আমাদের পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া। মনের অজান্তেই চলে এলাম রেইনট্রি গাছের নিচে। সফিক জানতে চাইল, এখান থেকে টর্চলাইটের আলোটা দেখতে পাচ্ছিলাম কি না? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ কিন্তু আমার কথা সে শুনতে পেল না। বুঝলাম তার ছাতার আঘাতে।
একটু এগোতেই দেখি একটা লোক টর্চলাইট হাতে কুঁচা দিয়ে মাছ শিকার করছে। লক্ষ্য করলাম, লোকটা যখন বৃষ্টির পানির ওপর লাইট মেরে মাছের সন্ধান করছে। তখন লাইটের ফোকাসটা ওপরের দিকে চলে যায়। তখন পাশে গাছ থাকলে মনে হয় কেউ গাছে টর্চলাইট দিয়ে কিছু খুঁজছে। নিজের মনেই প্রবাদটা জপতে লাগলাম, ‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।’
আমরা দুজন রানার বাসায় পৌঁছে ওর দরজায় জোরে আঘাত করে কোনো সাড়া পেলাম না। একসময় মনে হলো, এত রাতে এভাবে দরজা ধাক্কাধাক্কি ঠিক হচ্ছে না। কারণ, ডাকাত মনে করে রানার আব্বা তাঁর দুনলা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন। সুতরাং অন্য পথে হাঁটতে হবে। হঠাৎ মনে হল মঞ্জুর কথা। গায়েবি মামলায় মঞ্জু জেলে। সুতরাং তার ঘরটা খালি পড়ে আছে। আমরা আবার মঞ্জুর বাসার রাস্তা ধরলাম। তখন বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে। রাস্তার বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলে উঠেছে। লক্ষ্য করলাম দুজনের ছায়া দুটো বাড়তে বাড়তে তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। আবার অন্য লাইটের নিচে গেলেই ছায়ার দৈর্ঘ্য যাচ্ছে কমে। এ যেন ভূতের মতো সঞ্চারণশীল। মঞ্জুর ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকতে আর কোনো বাধা রইল না। আমি আর সফিক মনে মনে খুবই খুশি। যা হোক, এই দুর্যোগের রাতে অন্তত মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই তো হলো। রুমে ঢুকেই দেখি মঞ্জুর বিছানা খালি পড়ে আছে। পাশের বিছানায় তার ছোট ভাই ঘুমিয়ে আছে। আমরা ফিসফিস করে দু-একটা কথা বলেই মঞ্জুর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বড় ক্লান্ত, এলোমেলো, আর বিক্ষিপ্ত মনে হলো নিজেকে।
একটা পাহাড় থেকে নামার পর শরীরটাকে যেমন প্রাণহীন মনে হয়, ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে নিজেকে। এক্ষুনি ঘুম আসবে জানি; দু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। পাশ ফিরে দেখি সফিক গভীর ঘুমে অচেতন। ভোরের আজানের সাথে সাথে সফিককে ঘুম থেকে তুললাম। উদ্দেশ্য, কেউ টের পাওয়ার আগেই সরে পড়া। তাকে বললাম, ‘দোস্ত এভাবে পলাতক না থেকে চল, আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে পুলিশ তোকে খুঁজবে না।’ সফিক তাতে রাজি হয়ে গেল। সব বাধা অতিক্রম করে আমি, আর সফিক এক অনুপম শান্তি বুকে নিয়ে আমার গ্রামের পথে রওনা দিলাম।