কবি আল মাহমুদ স্মৃতিতে সংবেদে

আল মাহমুদ
আল মাহমুদ

আল মাহমুদ চলে গেলেন। নানা রাজনৈতিক–সামাজিক সূত্রে ব্যক্তি আল মাহমুদকে নিয়ে হয়তো অনেক প্রশ্ন আছে অনেকের; আছে অপছন্দের কারণ। কিন্তু বাংলা কবিতারসিক সমাজে তিনি অধিকাংশেরই প্রিয়। কারণ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার প্রবাহে আল মাহমুদ বাংলা কবিতার আধুনিকতার যে পথে হেঁটেছেন তা আবহমানতার উত্তরাধিকারবাহী! তিরিশি আধুনিকতার উপকরণ বহন করেও তাঁর আধুনিকতা লোকজ অনুষঙ্গী, বাংলাদেশের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত। একটা সময় পরে তাঁর ব্যক্তিক পরিমণ্ডল ইসলামি ভাবলোকসূত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবের চেতনাবিরোধীদের পক্ষপাতী হয়ে ওঠে। ফলে আল মাহমুদকে অনেকের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
আমার যখন আল মাহমুদের সঙ্গে সখ্য হয় তখন আমি সদ্য কৈশোর পেরোনো কাল পার করছি। সেটা ছিল আমারও সাহিত্য ভুবনে প্রবেশের সূচনাকাল। সে সময় তাঁর সঙ্গে সামরিকধারার সরকারের যে যোগ ঘটেছিল তাকে খানিকটা চাকরিগত বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখতেন অনেকে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁকে সেই বলয়েরই মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করতে দেখা যায়। ফলে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হিসেবেই তাঁকে বিবেচনা করা হতে থাকে। একদা প্রগতিশীল তাঁকে চলাচল করতে দেখা যায় ধার্মিক পরিমণ্ডলে। সেই ধার্মিকতার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির রাজনীতির যোগ ছিল। সরাসরি তাদের উৎস থেকে চলত তাঁর দিনযাপনের ব্যয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাঁকে কবিতায় সজীব ও সক্রিয় দেখা গেছে সব সময়। এই সক্রিয়তাসূত্রেই সব ধরনের সাহিত্য রসিকেরা আল মাহমুদের সৃষ্টিশীলতার দিকে দৃষ্টি রেখেছেন।
তাঁর সঙ্গে পরিচয়সূত্র নিয়ে মৃত্যুর পর অনেকেই তাঁদের তাৎক্ষণিক আবেগ প্রকাশ করেছেন। স্মৃতিকাতর আমার মনও যে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েনি তা নয়! কিন্তু নিজেকে সংযত রেখেছি। ভেবেছি আমার আবেগ তো আর তাঁর অনুভূতিতে সাড়া জাগাবে না! কী হবে তা প্রকাশ করে। চারপাশে যখন তাঁকে নিয়ে শোক প্রকাশের মাত্রা একটু কমে এসেছে তখনই খুলে বসলাম আমার স্মৃতির ঝাঁপি। দেখলাম আমার সঞ্চয়েও আছে স্মৃতির দু একটা খুচরো পয়সা!
দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের সঞ্চয় হিসেব করলে আল মাহমুদের রচনা পরিমাণে কম হবে না। তবে তাঁকে কখনোই অতিপ্রজ মনে হয়নি। আশির দশকের গোড়ার দিকে তাঁর সঙ্গে আমার সখ্যসূত্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার নব পর্যায়ের জন্য লেখা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঘন ঘন তাঁর অফিসে যাওয়া! মনে পড়ছে তাঁর কক্ষেই আমার পরিচয় ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’ খ্যাত মীজানুর রহমানের সঙ্গে। সেখানেই আমার পরিচয় হয় কবি জরিনা আখতারের সঙ্গেও। কবি জরিনা আখতার আল মাহমুদের কবিতার খুবই অনুরাগী ছিলেন। বুঝতে পারতাম আল মাহমুদের কাছেও ছিল তাঁর কবিতা পছন্দের!
আমার প্রতি আল মাহমুদ ছিলেন খুবই স্নেহময় ও আন্তরিক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার নব পর্যায়ের জন্য আল মাহমুদের কাছে একটি গল্প চেয়েছিলেন। আমার ওপর ভার পড়ল সেটা সংগ্রহের। আমি দু/এক দিন পরপরই যেতাম সেই গল্পের তাগাদার জন্য। আমাকে গল্পের ধারণাও বললেন একদিন। বললেন, লিখতে বসলেই লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু লিখতেও তিনি বসেন না, লেখাও হয় না; সুতরাং আমার যাতায়াতও বন্ধ হয় না। এ রকম করে প্রায় ছয়–সাত মাস ধরে তাঁর কাছে ধর্ণা দিলাম। একদিন শুনলাম তিনি ‘গন্ধবণিক’ নামের সেই গল্পটা লিখে ফেলেছেন। শুধু লিখেই ফেলেননি। অন্য পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দিয়েও দিয়েছেন। যদ্দূর মনে পড়ে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা ডাইজেস্ট নামের একটি পত্রিকায়। গল্পটি যেমন ভালো লেগেছিল ছাপার জন্য না পাওয়ায় মন খারাপও হয়েছিল তেমনি।
এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক মান–অভিমানও হয়েছিল আমার। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও তাঁকে ফোনে উপর্যুপরি তাগাদায় রেখেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরে তিনি বললেন, একটি কবিতা দেবেন। কবিতাটি একটু দীর্ঘ হবে। আমরা গল্প না পেয়ে তাঁর দীর্ঘ কবিতাতেই সন্তুষ্ট থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েক দিন ঘুরে অবশেষে পেলাম তাঁর কবিতা ‘ভারতবর্ষ’। তাঁর কবিতা পাওয়ার পরও কণ্ঠস্বর বের হতে একটু দেরি হয়েছিল। ইতিমধ্যে ছাপা হয়ে গিয়েছিল কবিতার ফর্মাটি। কিন্তু মনে পড়ছে ‘কণ্ঠস্বর’ বের হওয়ার আগেই তিনি ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটি ইত্তেফাকে প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার একটু মনোমালিন্যও হয়েছিল। ওই পর্বে তাঁর সঙ্গে সময় কটিয়ে অনুভব করেছিলাম যে তিনি অনেক প্রেরণাপন্থী। ইচ্ছে করলেই তিনি লিখে ফেলতে পারতেন না। ফলে চাহিবামাত্র তাঁর কাছ থেকে কবিতা বা গল্প পাওয়া বেশ মুশকিল ছিল। লেখা শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তিনি নানা ধরনের গদ্য লিখতেন। নিজের নানা রকমের উপলব্ধির কথা বলতেন সেসব লেখায়। মূলত তখনই তাঁকে বিচিত্র ধরনের গদ্য লিখতে দেখা যায়!
ওই সময়েই তাঁর ‘পানকৌড়ির রক্ত’ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলো চিত্তরঞ্জন সাহার ‘মুক্তধারা’ থেকে। লেখককপি হিসেবে যেদিন বইয়ের কপি হাতে পেলেন সম্ভবত সেদিনই তিনি আমাকে এর একটা কপি লিখে উপহার দিয়েছিলেন। সেই কপিটি আমি যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণে রেখেছি এখনো।
আরেক দিনের কথা মনে পড়ছে। তাঁর অফিসে অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা দিয়ে যখন উঠব ততক্ষণে অফিসের সময় শেষ হয়ে গেছে। আমার একটা কাজে নিউমার্কেটে যাওয়ার কথা। তিনি বললেন তিনিও যাবেন। আমি তখন সাইকেলে করে সারা ঢাকা শহর চষে বেড়াই! বললাম যে, আমি তো সাইকেলে করে যাব। তিনি বললেন, অসুবিধা কি, আমিও তোমার সঙ্গে সাইকেলে চড়েই যাব। সামনের রডে বসলে চালাতে পারবে না! আমার কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেদিন। বাংলাভাষার অগ্রগণ্য কবি আল মাহমুদ সেদিন আমার সাইকেলের রডে বসে সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি অফিস থেকে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে সাইকেল থেকে নামিয়েছিলাম তখনকার বিখ্যাত বইয়ের দোকান এমএম খান মজলিশের নলেজ হোমের সামনে। আল মাহমুদ তখন মাঝে মাঝে ‘নলেজ হোমে’ বা আবদুল কাদির খানের ‘নওরোজ কিতাবিস্তানে’ বা তাঁর অনুজ ‘কবির খানের ‘প্রগতি’ প্রকাশনীর অফিসে আড্ডা দিতেন। সেসব দিনের অনেক কুশীলবই এখন আর ইহজগতে নেই।
আল মাহমুদের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা কয়েক বছর আগে চ্যানেল আইয়ে। কোনো একটা অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন। মনে পড়ছে লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম ও আমি ছবি তুলেছিলাম তাঁর সঙ্গে। কে তুলেছিল মনে নেই। আমার সংগ্রহেও নেই ছবিটি! তবে সেই আশির দশকে, ১৯৮৪ সালে একদিন অফিসের আসনে বসা অবস্থায় তাঁর দুটি স্ন্যাপ নিয়েছিলাম আমার ভাঙা জেনিথ ক্যামেরায়! সেই ফটো দুটি এখন আমার স্মৃতিসঞ্চয়!