ছুঁয়ে দিলাম চাঁদের মাটি

স্যাটার্ন-৫-এর এফ-১ ক্লাস্টার ইঞ্জিনের সামনে লেখক
স্যাটার্ন-৫-এর এফ-১ ক্লাস্টার ইঞ্জিনের সামনে লেখক

ইগল (লুনার মডিউল): হিউস্টন, ট্রাকুইলিটি বেইস হিয়ার। দ্যা ইগল হ্যাজ ল্যান্ডেড।
হিউস্টন: রজার, ট্রাকুইলিটি, উই কপি ইউ অন দ্য গ্রাউন্ড...।
১৯৬৯ সাল। অ্যাপোলো ১১-এর লুনার মডিউল থেকে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই হিউস্টনের মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে শুরু হয়ে গেল উল্লাস। ২০১৯ সালের এক হিমশীতল সকালে সেই একই মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে দাঁড়িয়ে আমি যেন আটচল্লিশ বছর আগের উল্লাসধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
দাঁড়িয়ে আছি নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে। নাসা আমার বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের প্রতিবেশী প্রতিষ্ঠান। শুধু যে প্রতিবেশী প্রতিষ্ঠান তা-ই নয়, নাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে মিলিয়ন ডলারের অনুদান। পরিচালিত হয় মহাকাশ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প। প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ইন্টার্নি ও পরে কাজের সুযোগ পায় এখানে। তাই ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেকোনো শিক্ষার্থীর প্রথম কাজ নাসার এই স্পেস সেন্টার ঘুরে দেখা। কে জানে এটাই হয়তো হবে তার পরবর্তী কর্মস্থল!
কন্ট্রোল সেন্টারে জ্বলতে-নিভতে থাকা ইন্ডিকেটর বাতি, আর মনিটরে হাজারো জটিল হিসেব-নিকেশ দেখতে দেখতে ট্রাম চলে এল। এই ট্রাম আমাদের নিয়ে যাবে রকেট পার্কে। ট্রাম থেকেই পাশের গরুর খামার চোখে পড়ে। একটা জঙ্গলের মতো জায়গায় আসতেই সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল এক পাল বল্গা হরিণ। ভাবতেই অবাক লাগে আমরা যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সুন্দরবন ধ্বংসের চিন্তা করি, সেখানে মহাকাশ গবেষণার সূতিকাগার নাসা এত বড় ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছে একেবারে আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রেখেই। গাইড সগর্বে বলে চলছে, ‘এখানকার কোনো বন্য পরিবেশ নষ্ট করা হয়নি; কাটা হয়নি কোনো গাছ।’
আমাদের রকেট পার্কে নামিয়ে দিয়ে ট্রাম চলে গেল। ঢুকতেই পার্কের নামকরণের সার্থকতা বোঝা গেল। আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল লম্বা রকেটগুলো। তারা বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় স্যাটেলাইট নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দিয়ে এখন অবসরে চলে গেছে। বিশাল বড় আর লম্বা এক হলঘরে ঢুকতেই সেই কাঙ্ক্ষিত ‘স্যাটার্ন ৫’ এর দেখা পেলাম। বিশালাকৃতির এই ক্লাস্টার রকেট ইঞ্জিন নিল আর্মস্ট্রং ও অ্যাপোলো-১১-কে সঙ্গে নিয়ে চন্দ্র জয় করে এসেছে। বলাটা একটু কম হয়ে গেল, আসলে অ্যাপোলো সিরিজের সর্বশেষ স্যাটেলাইট অ্যাপোলো-১৭-সহ প্রতিটি স্যাটেলাইটই বহন করেছে তিনটি ‘স্যাটার্ন ৫’ মিলে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এফ-১ ক্লাস্টার ইঞ্জিন যখন গর্জে উঠত, তখন ৭৫ লাখ পাউন্ড থ্রাস্ট তৈরি করত, যা ৮৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন বাঁধের সমান। বিশাল এই ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে মানবজাতি হিসেবে সত্যিই গর্ব করা যায়। ভাবতেই অবাক লাগে এই মহাকাশযান মাত্র চার কিলোবাইট র‍্যামবিশিষ্ট কম্পিউটার দিয়ে চালিত হয়েছে। আপনি গর্ব করতে পারেন যে, আপনার হাতের আইফোনের র‍্যামটি এর চেয়ে প্রায় আট লাখ গুণ শক্তিশালী।
পিট কনরেডের স্পেস স্যুট
রকেট পার্ক থেকে গেলাম ট্রেইনিং ফ্যাসিলিটিতে। নভোচারীরা পরবর্তী মিশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এখানে। কেউ হয়তো দৌড়াচ্ছে, কেউ লাফাচ্ছে, কেউ আবার ক্রেনে লাগানো রশিতে ঝুলে আছে। শুধু মানব নভোচারীই না, যন্ত্রযানগুলোকেও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে—অচেনা গ্রহের এবড়োখেবড়ো-থেবড়ো মাটিতে কতটা ভালোভাবে কাজ করতে পারবে তারা। সবশেষে ঢুকলাম নাসার মূল ভবনে। এক কোনায় পড়ে থাকা মহাকাশযান সয়োজ, সিলিংয়ে ভেসে থাকা নভোচারী, বিভিন্ন স্যাটেলাইটের মডেল, স্পেস স্টেশনের অংশ, শাটল, কৃত্রিম জিরো গ্র্যাভিটি ইত্যাদি দেখে মনে হতে পারে যে ভুল করে মহাকাশের কোনো জায়গায় চলে এসেছি! আসলে সবই তৈরি করা হয়েছে সত্যিকারের যন্ত্রপাতির মতো করে। কিউবিকলে অ্যাপোলো-১২-এর কমান্ডার, চাঁদের বুকে পা রাখা তৃতীয় ব্যক্তি পিট কনরেডের স্পেস স্যুট রাখা। নির্দিষ্ট কিছু স্পেস স্যুট চাইলে পরেও দেখা যায়। তার সঙ্গে রয়েছে নভোচারীদের সঙ্গে লাঞ্চ করার ব্যবস্থা। অনেকেই মধ্যাহ্নভোজের এ সুযোগ লুফে নিচ্ছে। কারণ কিউবিকলে থাকা ‘রবোনাট’ই বলে দিচ্ছে, তাঁরাই হবেন ভবিষ্যতের অ্যাস্ট্রোনট। তখন রোবটের সঙ্গে নিশ্চয়ই এক টেবিলে বসে আপনি মধ্যাহ্নভোজের সুযোগ চাইবেন না। পাশের থিয়েটারে চলছে ‘লিভিং ইন দ্য স্পেস’ নামের বিশেষ মুভি শো।
অন্যদিকে অ্যাস্ট্রোনট আল ড্রিউ মহাকাশ জীবনের সত্যিকারের ডেমন্সট্রেশন দিচ্ছেন। পাশে রাখা মহাকাশযানের একটি টয়লেট দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মহাকাশে মল-মূত্র ত্যাগ ও রিসাইকেল করার ব্যাপারটি মোটেও হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়; বরং নাসার কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য নভোচারীদের যথেষ্ট পরিমাণ প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। টয়লেটে বসার জায়গা খুবই ছোট। কাজেই টার্গেট মিস করলে বিপদ! (নভোচারীরা এই ক্ষেত্রে কাককে দেখে টার্গেট করা শিখতে পারে!) মহাকর্ষজনিত অসুবিধা দূর করতে নিচের দিকে সাকশন পাম্প লাগানো থাকে। ইউরিন রিসাইকেল করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর সলিড ওয়েস্ট আলাদা প্যাক করে পৃথিবীতে ফেরত আনা হয় (মহাকাশযানের ক্ষেত্রে) অথবা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে পাঠিয়ে ঘর্ষণের মাধ্যমে পুড়িয়ে ফেলা হয় (স্পেস স্টেশনের ক্ষেত্রে)।
৩৮০ কোটি বছর পুরোনো চাঁদের মাটি
মূল ভবনেই সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন সময়ে নিয়ে আসা চাঁদ ও মঙ্গলের মাটি। ৩৮০ কোটি বছর পুরোনো চাঁদের মাটি দর্শনার্থীরা চাইলে ছুঁয়ে দেখতে পারে। এই মাটিতে পা রেখে নিল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, ‘এটা একটা মানুষের জন্য ক্ষুদ্র পদক্ষেপ; কিন্তু মানবজাতির জন্য বিরাট এক লাফ।’
আমি প্রায় লাফ দিয়ে মূল ভবন থেকে বের হয়ে এলাম। একের পর এক নভোচারীর কবর পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। মহাকাশ অভিযানের সব মিশনই সফল হয় না। প্রাণ দিতে হয়েছে অ্যাপোলো-১, এক্স-১৫ নাম্বার-৩, চ্যালেঞ্জার ও কলম্বিয়ার যাত্রীদের। মেন পড়ল, ২০০৩ সালে মহাকাশযান কলম্বিয়া সফল মিশন শেষে পৃথিবীতে ফিরছে। পৃথিবীর মাটিতে অপেক্ষায় আছে হাজারো মানুষ। তাকিয়ে আছে নামতে থাকা কলম্বিয়ার দিকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঘটল বিপর্যয়। সাত নভোচারীকে সঙ্গে নিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল মহাকাশযানটি। আকাশের পশ্চিম কোণে ছড়িয়ে পড়ছে ভাঙা টুকরোগুলো। আমি সেদিকে তাকালাম। না, বিধ্বস্ত মহাকাশযানের কোনো ভাঙা টুকরো নেই। তার পরিবর্তে আকাশে তখন অষ্টমীর চাঁদ। চারদিকে মায়াময় রূপালি জোছনা। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা হাহাকার তৈরি হলো। নিজেকে মহাবিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হয়। আসলে আমরা কেউই নির্দিষ্ট কোনো ভূ-খণ্ডের না। বস্তুত প্রতিটি মানুষই নক্ষত্রের সন্তান। কে জানে, চাঁদ কিংবা মঙ্গলের মাটিতে হয়তো রয়েছে আমারই শরীরের কোনো অণু!
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন